ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সেই ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’র জন্মদিন আজ

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২২, ২ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেই ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’র  জন্মদিন আজ

রুহুল আমিন : ‘সখাদ-সলিলে পড়েও অনেক সময় জেলবাস করতে হয়। যেমন পাকিস্তানের ব্হুল আলোচিত নেতা জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কেন্দ্রীয় পরিষদে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইন তীব্র বিরোধিতার মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর পাস করিয়ে নেন। তিনি যে পার্টির প্রধান, সেই আওয়ামী লীগ ঘোষণাপত্র মোতাবেক নিরাপত্তা আইনের ঘোর বিরোধী ছিল। তবু যে-কোন রহস্যজনক কারণেই হোক না কেন, তিনি রাজনৈতিক নির্যাতনের হাতিয়ার কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইন পাসের পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করে পরবর্তীকালে জেনারেল আইয়ুব খাঁ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সেই বহু নিন্দিত কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইন সর্বপ্রথম যার ওপর প্রয়োগ করেন, তিনি পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী!’

(ফয়েজ আহমদ, ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ পৃষ্ঠা নং ১১৫/১১৬)

ফয়েজ আহমদ প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৯২৮ সালের ২ মে তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বাসাইলভোগ গ্রামে ফয়েজ আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম গোলাম মোস্তফা চৌধুরী এবং মা আরজুদা বানু।

ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি গভীর টান ছিল তার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতায় তিনি কলকাতার সওগাত অফিসে হাজির হন। সেখানে পরিচয় হয় বিখ্যাত কবি আহসান হাবীব ও হাবীবুর রহমানের সঙ্গে। তারা তাকে লেখার জন্য উৎসাহিত করেন। দেশ বিভাগের পর ‘সওগাত’ পত্রিকা ঢাকায় চলে আসে। ‘সওগাত’ অফিসেই সম্পাদক নাসিরুদ্দিনের সহযোগিতায় মুক্তবুদ্ধির ধারক হিসেবে পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের জন্ম হয়। ফয়েজ আহমদ এই সংসদের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময় সঙ্গ পান ঢাকার প্রধান লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের। ফয়েজ আহমদের সঙ্গে  সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে এ প্রতিষ্ঠানে যারা প্রকাশ্যে এসেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক অজিত গুহ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সৈয়দ নুরুউদ্দিন, অধ্যাপক সরোয়ার মোর্শেদ, আবদুল গণি হাজারী, মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমানসহ আরও অনেকে।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় ফয়েজ আহমদের সাংবাদিক জীবনের শুরু। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ ও পরবর্তীতে পূর্বদেশে চিফ রিপোর্টার ছিলেন। তিনি সাপ্তাহিক ইনসাফ ও ইনসান পত্রিকায় রিপোর্টিং করেছেন। ১৯৫০ সালে 'হুল্লোড়' এবং ১৯৭১ সালে 'স্বরাজ' পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৬৬ সালে পিকিং রেডিওতে বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান শুরুর জন্য তিনবছর চুক্তিতে নিযুক্ত হন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর নেতৃত্বের ফলে অল্প সময়েই পিকিং রেডিওতে (বর্তমানে রেডিও বেইজিং) বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। এ ছাড়া তিনি ঢাকা রেডিওতে ১৯৫২-৫৪ সালে 'সবুজ মেলা' নামের ছোটদের বিভাগটি পরিচালনা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) প্রথম প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পরে দৈনিক বঙ্গবার্তার প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন ঢাকায় ক্যাম্প স্থাপন করেছিল, তখন ঢাকা নগরীর বনানীস্থ একটি ক্যাম্পে তরুণ পাইলট হিসেবে শিক্ষানবিসের কাজ করেছিলেন ফয়েজ আহমেদ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সরকারবিরোধী ভূমিকার কারণে আইয়ূব খানের আমলে ১৯৫৯ সাল থেকে ৪ বছর কারাবন্দি ছিলেন। এক বছর ছিলেন নজরবন্দি হয়ে। একইভাবে বাংলাদেশে এরশাদের আমলেও  কারাগারে গিয়েছেন একবার। রাজনৈতিক কারণে তিনবার দীর্ঘ সময়ের জন্য আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে তাকে। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত ভিয়েনা বিশ্ব যুব সম্মেলনে বিনা পাসপোর্টে ‘করিম শাহানী’ ছদ্মনাম নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও ওতপ্রোত জড়িত ছিলেন তিনি। ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার নেতৃত্বে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যেমন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছিল তেমনি ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯০ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সাধারণ মানুষের পাশে গিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে দাঁড়িয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর সিণ্ডিকেটের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাতীয় কবিতা উৎসবের প্রথম পাঁচ বছরের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি।

১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমির কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হন। পরে এরশাদের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তি এবং জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে গঠিত কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে এই কমিটি গঠিত গণআদালতের ১১জন বিচারকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। গণআদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে যে ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল তিনি তাদের একজন। ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকার প্রাচীন ও সুবৃহৎ আর্ট গ্যালারি ‘শিল্পাঙ্গণ’। তিনি প্রগতিশীল পাঠাগার ‘সমাজতান্ত্রিক আর্কাইভ’ এর প্রতিষ্ঠাতা।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর আক্রমণ করলে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাব ভবনে আশ্রয় নেন। সেখানেও তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন। রাত ১১টায় প্রেসক্লাবে গোলাবর্ষণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। তিনি বাঁ ঊরুতে আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকেন। ২৬ মার্চ ভোরে জ্ঞান ফিরে পান। পরে নিকটস্থ বাংলাদেশ সচিবালয়ে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচান। ২৭ মার্চ সকাল প্রায় ১০টায় কারফিউ ওঠার পর তিনি চিকিৎসার জন্য বেরিয়ে যান। ঢাকা থেকে তিনি আগরতলা চলে যান। আগরতলায় চিকিৎসার পর তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় কলকাতায় যান। তবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হন। পরে বাধ্য হয়ে কেবিনেটের অনুরোধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করেন এবং সেখানে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ওপর "পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে" যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার এভাবেই যোগদান। তিনি কলকাতা থেকে এসে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের উপর প্রতিবেদন তৈরি করতেন।

ফয়েজ আহমেদ  শিশু-কিশোরদের জন্যও ছড়া ও কবিতা লিখতেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১০০। প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’সবচেয়ে বিখ্যাত। এটা অবশ্য ট্রিলজির প্রথম পর্ব। বাকি দুই পর্ব হলো- ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’ ও ‘নন্দনে নন্দিনী’। তার ছড়ার বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘হে কিশোর’, ‘কামরুল হাসানের চিত্রশালায়’, ‘গুচ্ছ ছড়া’, ‘রিমঝিম’, ‘বোঁ বোঁ কাট্টা’, ‘পুতলি’ ‘টুং’, ‘জোনাকী’, ‘জুড়ি নেই’, ‘ত্রিয়ং’, ‘তুলির সাথে লড়াই’, ‘টিউটিউ’, ‘একালের ছড়া’, ‘ছড়ায় ছড়ায় ২০০’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও তিনি চীনসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচটি বই অনুবাদ করেছেন।

তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলা একাডেমি পুরস্কার,    শিশু একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, সাব্বির সাহিত্য পুরস্কার, নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার।

প্রথিতযশা এই সাংবাদিক ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রম যোদ্ধা। দেশ ও সমাজের অন্যায়-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল আমৃত্যু।  লেখালেখি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মে ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়