ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

অন্ধ জনেও এখন ডিজিটাল আলো

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৩, ৬ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অন্ধ জনেও এখন ডিজিটাল আলো

হাসান মাহামুদ : বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে-এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির জাদুর স্পর্শে দেশের প্রায় সকল খাতের কাঠামো এবং কার্যক্রমের ধরণ পাল্টে যাচ্ছে দিন দিন। বলতে গেলে, দেশের সর্বত্রই এখন ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া।

 

শিক্ষা খাতেও ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া অন্য যে কোনো খাতের তুলনায় খুব একটা কম নয়। দেশজুড়ে সরকার সাড়ে পাঁচ হাজার ডিজিটাল সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করেছে। ঢাকার বাইরে ২৩১ একর জায়গার ওপর বিজনেস পার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ৬০ হাজার বর্গফুটের একটি টেকনোলজি পার্ক উন্মুক্ত করেছে। এ রকম মোট সাতটি পার্ক স্থাপন করা হবে। সরকার দেশজুড়ে ডিজিটাল ডাটা সেন্টার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জন্য ইনকিউবেটর প্রোগ্রাম তৈরি করেছে। এক লাখ ৭০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল ক্লাসরুম ও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

 

দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের হাজিরা নেওয়া হয়। এমনকি সম্প্রতি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দুর্নীতি খতিয়ে দেখা ও তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) কর্মকর্তাদের জন্যও বায়োমেট্রিক হাজিরা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আনার লক্ষ্যে চালু করা হচ্ছে ‘ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম’ বা ‘পিয়ার ইন্সপেকশন’ নামে একটি অত্যাধুনিক সফটওয়্যার। এ সবই শিক্ষাখাতে প্রযুক্তি তথা ডিজিটাল ব্যবস্থা চালুর ফসল।

 

এই তো কয়েকদিন আগেই বছরের প্রথম দিনে একযোগে সারাদেশে ‘পাঠ্যপুস্তক দিবস’ উদযাপনের মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে ৩৬ কোটির বেশি বই। সরকারের তথ্য মতে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বছরের প্রথম দিবসে মোট ২৬ কোটি ২ লাখ ২১ হাজার ৮৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৮৯ কোটি ২১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯৫টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করেছে। নিঃসন্দেহে এটি বিশ্বে অনন্য উদাহরণ।

 

বিষয়টি এভাবে কখনো আলোচনায় না এলেও, এটি সত্য যে, একযোগে এতো বেশি বই পৃথিবীর কোনো দেশে বিতরণ করা হয় না। এটি অবশ্যই বাংলাদেশের তথা বর্তমান সরকারের একটি রেকর্ড। এই অর্জনে বাদ পড়েনি দেশের কোনো স্তরের শিক্ষার্থী। এমনকি দেশের দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরাও এখন শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বঞ্চিত নয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে বাংলাদেশে। সুখের বিষয় হচ্ছে, তারাও এখন ডিজিটাল শিক্ষা পদ্ধতির অধীনে।

 

এ ক্ষেত্রে লুইস ব্রেইলের নাম খুব প্রাসঙ্গিক হিসেবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। শত শত বছর ধরে দৃষ্টিহীন লোকেরা পড়তে পারত না। কিন্তু উনিশ শতকে একজন আন্তরিক যুবক তাদের কথা চিন্তা করে একটা পদ্ধতি বের করেন। এই পদ্ধতি আবিষ্কারককে তো বটেই বিশ্বের সকল দৃষ্টিহীন ব্যক্তিকে আশার আলো দেখিয়েছে। এই পদ্ধতির নাম ‘ব্রেইল সিস্টেম’। ১৮২০ সালের শেষ দিকে বিন্দু দিয়ে কীভাবে ব্রেইল অক্ষর লেখা হয়, তা বুঝিয়ে প্রথমে একটা বই ছাপানো হয়। ব্রেইল অক্ষর বাঁ দিক থেকে ডান দিকে এক হাত বা দুহাত বুলিয়েই পড়া যায়। প্রত্যেকটা ব্রেইল কুঠুরির বিন্দুগুলোকে ৬৩ রকমভাবে সাজানো যায়। আজকের এই দিনে (১৮৫২ সালের ৬ জানুয়ারি) অন্ধদের জন্য বর্ণমালা ও পাঠ পদ্ধতির উদ্ভাবক লুইস ব্রেইল নামের সেই মহান মানুষটি মৃত্যুবরণ করেন।

 

বাংলাদেশে ব্রেইল পদ্ধতি বেশ কয়েক বছর ধরেই চর্চা হচ্ছে। তবে গত বছর দেশে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রথমবারের মতো ‘ডিজিটাল ব্রেইল বই’ প্রকাশ হয়। এর মাধ্যমে কম্পিউটার অথবা মোবাইলের সঙ্গে যোগাযোগ করে টেক্সট ফাইলকে দ্রুত ব্রেইল পদ্ধতিতে কনভার্ট করে একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের হাতে অনুভূতির সৃষ্টি করে। ডিভাইসটি ব্যবহার করলে পড়াশোনার জন্য আর নতুন করে ব্রেইল শিখতে হবে না। ব্রেইল প্রিন্ট করাও লাগবে না। ডিভাইসটি যেহেতু মোবাইল ফোনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে, সেহেতু দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের স্কুলে এটি সহজেই ব্যবহার করা যাবে। তাতে প্রিন্ট না করেই বই পড়তে পারবে প্রতিবন্ধীরা।

 

ব্রেইল হচ্ছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়ার জন্য ডটভিত্তিক পদ্ধতি। চোখে দেখতে না পারার কারণে প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়া করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়া করার একটি ভালো মাধ্যম এটি। আমাদের দেশেও বেশ কয়েক বছর ধরে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়ালেখা করে আসছেন অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কিন্তু ব্রেইলের উপকরণ অনেক ব্যয়বহুল ও সহজলভ্য না হওয়ার ফলে অনেকের ইচ্ছা থাকার পরও লেখাপড়া করতে পারেন না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে ব্রেইলের মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য এখনো বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বাংলা ব্রেইল প্রিন্টিংয়ের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের প্রিন্টার। সেটি হলো ইনডেক্স প্রিন্টার, যার দাম দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। এছাড়া ব্রেইলের বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা কম হওয়ায় সমস্যায় পড়েন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।

 

সরকারের আরেকটু মনোযোগ প্রয়োজন এই পদ্ধতিটিকে শতভাগ বাস্তবায়নযোগ্য করার ক্ষেত্রে। এই ডিজিটাল পদ্ধতি আরো ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি সহজলভ্যও করা উচিত। তাহলে আমাদের মূলধারার শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দৃষ্টি প্রতিবন্ধি শিক্ষার্থীরাও দেশের সম্পদে পরিণত হতে পারে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জানুয়ারি ২০১৭/হাসান মাহামুদ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়