ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দেয়ালের বন্দিদশা থেকে শিগগির মুক্তি পাচ্ছে না পরিবারটি

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেয়ালের বন্দিদশা থেকে শিগগির মুক্তি পাচ্ছে না পরিবারটি

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : খুলনার পাইকগাছায় স্থানীয় এমপি পুত্রের নির্মাণকৃত চার দেয়ালে বন্দিদশা থেকে শিগগির মুক্তি মিলছে না আওয়ামী লীগ নেতার পরিবারের সদস্যদের।

জমির মালিকানার জেরে আদালত ও থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা চলমান থাকায় প্রশাসন অবরুদ্ধ পরিবারটিকে উদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

পাইকগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মারুফ আহমেদ শুক্রবার সন্ধ্যায় রাইজিংবিডিকে বলেন, ওই জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে একটি মামলা চলছে। আদালত রায় দিলে তারা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন। আদালতের নির্দেশ ছাড়া জমিজমা সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলার বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই।

তবে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা দেখা দিলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

খুলনা-৫ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনের ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য শেখ মো. নুরুল হকের ছেলে শেখ মনিরুল ইসলাম আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিজের বাড়ির চারপাশে উঁচু দেয়াল তৈরি করায় বাড়িতে যাওয়া-আসার রাস্তা দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় বন্ধ রয়েছে। ফলে মই দিয়ে দেয়াল টপকে কিংবা দেয়ালের নিচ দিয়ে তৈরি করা গর্ত দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় বাড়ির বাসিন্দাদের। ফলে এক প্রকার বন্দিদশায় জীবন কাটছে আবদুল আজিজসহ পরিবারের সাত সদস্যের।

পাইকগাছা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আজিজ গোলদারের দাবি, সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শেখ নুরুল হকের নির্দেশ এবং তার পোষ্যদের ভয়ে এক বছর ধরে গৃহবন্দি তার পরিবার। প্রভাবশালীদের ভয়ে তার পরিবারের সদস্যরা গত তিন মাস আগেও বাড়ির বাইরে বের হতো না। বর্তমানে বাইরে বের হলেও সারাক্ষণ ভয়ে থাকেন তারা। জেলখানার মতো উঁচু দেয়ালে মই লাগিয়ে ও প্রাচীরের নিচে মাটির সুড়ঙ্গ কেটে যাতায়াত করেন তারা।



সংসদ সদস্য শেখ মো. নুরুল হক বলেন, তার ছেলে ৫০ শতক জমি বায়নাপত্রের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। তার মধ্যে ২০ শতক জমি আবদুল আজিজ অবৈধভাবে দখল করে আছেন। তাকে জমি ছেড়ে দিতে বললেও তিনি ছাড়েনি।

তিনি বলেন, বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য একটি গেট আছে। কিন্তু তারা গেট দিয়ে না বেরিয়ে মই লাগিয়ে এবং গর্ত খুঁড়ে নাটক করছেন।

তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, ‘আবদুল আজিজ গোলদার দীর্ঘ দিন ধরে একই গ্রামের অজিৎ হালদার ও ঠাকুর দাশ হালদারের ৫০ শতাংশ জমি দখল করে আছেন। মালিকরা জমিটি উদ্ধার করতে না পেরে আমাকে জানান। আমি সেখানে একটি মন্দির করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেই। সেই আলোকে অবৈধ দখলদার আবদুল আজিজের জমিসহ হিন্দুদের জমিতে প্রাচীর দিয়েছি। আমরা কারও জমি দখল করিনি বরং দখলমুক্ত করেছি।’

সরেজমিন পাইকগাছা উপজেলার সরল গ্রামে আবদুল আজিজের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির চারপাশে উুঁচ দেয়াল। কোথাও সেই দেয়ালের উচ্চতা ১০ ফুট, আবার কোথাও ১৫ ফুট। বাড়ির পুরুষ সদস্যরা সেই দেয়ালের দুই পাশে মই লাগিয়ে দেয়াল টপকে যাওয়া-আসা করছেন। আর নারীরা দেয়ালের নিচে তৈরি করা গর্তের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করছেন।

আবদুল আজিজ গোলদার জানান, এখানে তার জমির পরিমাণ ২০ দশমিক ৭৫ শতক। প্রায় ৭০ বছর ধরে বাড়িটিতে তারা বসবাস করেন। কিন্তু গত জানুয়ারি মাসে সংসদ সদস্য শেখ মো. নুরুল হকের ছেলে শেখ মনিরুল ইসলাম জমির মালিকানা দাবি করে তাদের জমি ছেড়ে দিতে বলেন। এর কয়েকদিন পর শেখ মনিরুল ইসলাম লোকজন নিয়ে তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও মারধর করেন। এ ঘটনায় তারা থানায় মামলা করেন।

তিনি বলেন, ‘জমি দখলের চেষ্টার অভিযোগে আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুটি মামলায় সংসদ সদস্যের ছেলে শেখ মনিরুল ইসলামসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। এরপর আমাদের বিরুদ্ধে উল্টো চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।’ 



স্থানীয় লোকজন জানান, ১৯৪৬ সালে আবদুল আজিজ গোলদারের দাদি পাগলী বিবি স্থানীয় সতীষ লাল রজত, মতি লাল রজত ও নিবারণ রজতের কাছ থেকে ৬৬ শতক জমি কেনেন। গত ৩০ বছর ধরে আজিজ গোলদার বাড়িঘর তৈরি করে সেখানেই বসবাস করছেন। এর মধ্যে পার্শ্ববর্তী ৫০ শতক জমি সংসদ সদস্যের ছেলে বায়নাপত্রে রেজিস্ট্রি করে নেন। এরই অংশ হিসেবে হঠাৎ করে ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি স্থানীয় সংসদ সদস্য নুরুল হক তার লোকজন নিয়ে সেই জমি থেকে আজিজ গোলদার ও তার পরিবারকে চলে যেতে বলেন। আজিজ বিষয়টির কারণ জানতে চাইলে নুরুল হক তাকে বলেন, ওই জমি তিনি কিনে নিয়েছেন। জমিটি আবদুল আজিজের পরিবারের বলে দাবি করলে নুরুল হকের লোকজন তার পরিবারের ওপর চড়াও হয়। এ সময় সংসদ সদস্যের লোকজন আবদুল আজিজকে সেখান থেকে চলে যেতে শাসিয়ে যান। এরপর থেকে মূলত বিরোধ শুরু। সংসদ সদস্যের লোকজন মেপে দেখেন সেখানে ৩০ শতক জমি আছে। আজিজদের বসবাস করা ২০ শতক জমিও সংসদ সদস্যের ছেলে তার দাবি করে সেখানে দেয়াল তুলে দেন।

আবদুল আজিজের ছেলে সাইফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘সংসদ সদস্য ও তার ছেলে দেয়াল দিয়ে আমাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। বাড়ি থেকে বের হতে গেলে মই দিয়ে দেয়াল টপকাতে হয়। বর্তমানে আমরা দেয়ালের নিচে গর্ত খুঁড়ে বাড়ির নারী-শিশুদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। বাড়ির বয়স্ক লোক ও শিশুদের জন্য এটা ঝুঁকিপূর্ণ।’ তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিপক্ষ সংসদ সদস্য হওয়ায় প্রশাসনের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না।

আবদুল আজিজের আরেক ছেলে মো. আসাদ অভিযোগ করে বলেন, ‘সংসদ সদস্যের লোকজন আমাদের পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করছেন।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মো. মোমিনুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি অমানবিক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

পাইকগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক গাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, সরল গ্রামের ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পাইকগাছা পৌরসভা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কামরুল হাসান টিটু জানান, আবদুল আজিজ পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি একজন প্রবীণ নেতা। দলে তার অনেক অবদান রয়েছে। দ্রুত এ বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান হওয়া উচিত।

আবদুল আজিজের পরিবারের দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পাইকগাছা থানার এসআই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ওই জমিতে আবদুল আজিজের পরিবার নিয়মিত খাজনা দিয়ে বসবাস করে আসছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিগগিরই এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

সংসদ সদস্যের ছেলে শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি অমূল্য হালদার ও তার ভাই অজিত হালদারের কাছ থেকে জমি বায়নাপত্রে রেজিস্ট্রি করে নিয়েছি। আমার জমি আবদুল আজিজ অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। উল্টো আজিজ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন।’ 



রাইজিংবিডি/খুলনা/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/মুহাম্মদ নূরুজ্জামান/বকুল/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়