ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আগরতলা মামলার সময় থেকেই গণসংগীত গেয়েছেন তিনি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৪, ৩০ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আগরতলা মামলার সময় থেকেই গণসংগীত গেয়েছেন তিনি

হাসান মাহামুদ : আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে মনে করা হতো একটি বিশেষ সেক্টর। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে, প্রেরণা যোগাতে ও মনোবল বাড়াতে আমাদের কণ্ঠযোদ্ধাদের অবদান ভুবনবিখ্যাত। এখানের শিল্পীদের এক একটি গান ছিল এক একটি বুলেটের মতো।

শিল্পীরা তাদের কণ্ঠ দিয়ে লড়েছিল পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। মুক্তিসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান গেয়ে তাদের উজ্জীবিত করেছিল, সাহস যুগিয়েছিল শরণার্থীদের। কণ্ঠসৈনিকদের অবদান ছিল অনবদ্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের জাদুকরী কণ্ঠে উজ্জীবিত হয়েছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠিত হয়েছিল দেশের মানুষ। এই বিশেষ সেক্টরের উল্লেখযোগ্য একজন ছিলেন সদ্যপ্রয়াত কণ্ঠশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বার।

আবদুল জব্বারের অনন্যতা হচ্ছে, তিনি মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময় বলিষ্ঠ অবদান রেখেছেন। এর আগে ষাটের দশকের শেষদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা গ্রেপ্তারের সময় থেকে প্রতিবাদী গণসংগীতে কণ্ঠ দিতেন। বিষয়টি আবদুল জব্বারকে অন্য সবার থেকে অনন্য করে রেখেছে ইতিহাসে।

ওই সময় থেকেই স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করতে থাকেন তিনি। ওই সময় প্রতিবাদী গান ‘তুমি কি দেখেছ বন্ধু আইয়ূবের পরাজয়’, ‘শহরবাসী শোন’, ‘তোমরা যাদের মানুষ বল না’র মতো গানগুলোর মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এই সময় থেকেই শেখ মুজিব পরিবারের সঙ্গেও ঘণিষ্ঠতা বাড়তে থাকে তার।

১৯৬৯ সালে ‘বিমূর্ত’ নামের একটি সংগীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন আবদুল জব্বার। একই সময়ে তিনি গঠন করেন ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পীগোষ্ঠী’, যার সভানেত্রী ছিলেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।

কলকাতার তৎকালীন মাসিক পত্রিকা প্রসাদ-এর সংস্কৃতি সম্পাদক আশীষ চট্টোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুল জব্বার শুনিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তার শব্দসৈনিক হয়ে ওঠার পেছনে বঙ্গবন্ধুর অণুপ্রেরণার কথা।

তিনি বলেছিলেন, ২৪ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গুবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় আবদুল জব্বারের। বঙ্গুবন্ধু তখন তাকে বলেছিলেন, ‘সাবধানে থেকো, অনেক কাজ আছে তোমার।’

২৫ মার্চের পর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে আগরতলায় রওনা দেন আবদুল জব্বার। সেখানে পৌঁছে দেখা পান আপেল মাহমুদের। এরপর মুজিবনগরে পৌঁছে তারা যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। পরবর্তী নয় মাসে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘অনেক রক্ত দিয়েছি মোরা’, ‘আমি এক বাংলার মুক্তিসেনা’, ‘বাংলার স্বাধীনতা আনল কে- মুজিব মুজিব’ গানগুলো দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগানোর কাজ করে গেছেন তিনি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও প্রেরণা জোগাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ অসংখ্য গানে কণ্ঠ দেন। তার গানে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

এ ছাড়া যুদ্ধের সময় তিনি প্রখ্যাত ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মুম্বাইয়ের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে কাজ করেন। তখন কলকাতায় অবস্থিত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ঘুরে প্রেরণা জোগাতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গণসংগীত পরিবেশন করেছেন। সে সময় গণসংগীত গেয়ে পাওয়া ১২ লাখ রুপি তিনি বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেছিলেন।

এই বীরকে আগামী কয়েক শতাব্দী মনে রাখবে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালিরা।

আবদুল জব্বারের জন্ম ১৯৩৮ সালের ৭ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলায়। বাউল-বৈষ্ণবের দেশ কুষ্টিয়ার উদার প্রাকৃতিক পরিবেশে কেটেছে শৈশব। লালন সাঁইয়ের দেশ কুষ্টিয়ার নদীর ঢেউ আর প্রাণখোলা বাতাসেই যেন রয়েছে সুরের ছোঁয়া। আবদুল জব্বারের কণ্ঠে সেই সুরেরই স্পর্শ ছিল।

মায়ের অণুপ্রেরণায় ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন কুষ্টিয়ায় মুহম্মদ ওসমানের কাছে গান শিখতে শুরু করেন। এরপর মকসেদ আলী সাঁই ও লুৎফেল হকের কাছেও গানের তালিম নেন।

ওপার বাংলার উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী শিবুকুমার চ্যাটার্জির কাছে গান শিখতে কৈশোরে দশ মাস কলকাতায় ছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৫৭ সালে একটি বিচিত্রা অনুষ্ঠানে তার কণ্ঠে নজরুল সংগীত ‘ঘুমিয়ে আছো বুলবুলি গো মদিনার গুলবাগে’ গানটি শুনে ঢাকা বেতারের গীতিকার আজিজুর রহমান তাকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন। ১৯৫৮ সাল থেকে বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি।

বেতারেই তার কণ্ঠে নজরুল সংগীত শুনে সংগীত পরিচালক রবীণ ঘোষ তাকে সিনেমায় প্লেব্যাকের প্রস্তাব দেন। এহতেশাম পরিচালিত ও রবীণ ঘোষের সংগীত পরিচালনায় ১৯৬২ ‘নতুন সুর’ সিনেমার মাধ্যমে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে অভিষেক ঘটে তার। দুই বছর পরে বিটিভিতে নিয়মিতভাবে গান গাইতে শুরু করেন তিনি।

বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে তিনি ছিলেন এর নিয়মিত গায়ক। ১৯৬৪ সালে জহির রায়হানের সংগম ছবিতে প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন আবদুল জব্বার। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ‘এতটুকু আশা’। এ ছবিতে সত্য সাহার সুরে ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান আবদুল জব্বার।

আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ও ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান তিনটি ২০০৬ সালে মার্চ মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

আবদুল জব্বার সারা জীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার, ২০০৩ সালে বাচসাস পুরস্কার, ২০১১ সালে সিটিসেল-চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননা এবং জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ আগস্ট ২০১৭/হাসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়