ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের নয় বছর

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পিলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের নয় বছর

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো দিন ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এই দিনে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদরদপ্তর পিলখানায় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। কিছুসংখ্যক বিদ্রোহী বিডিআর জওয়ানের হাতে নিহত হন ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। ঘটনার বীভৎসতায় গোটা জাতি বিমূঢ় হয়ে পড়ে ।

নির্মম ও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের নয় বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় মামলা হিসেবে পরিচিত।

২০০৯ সালের এদিন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদরদপ্তরের দরবার হলে সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে ফোর্সের কিছু বিদ্রোহ সৈনিক মহাপরিচালকের বুকে অস্ত্র তাক করেন।  ওই সময় বিদ্রোহী সদস্যরা তাৎক্ষণিক কয়েকজন সেনাসদস্যকে হত্যা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করেন ফেলেন।

পিলখানার সবকটি প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণে নেন বিজিআরের বিদ্রোহী সদস্যরা।  তারা চারদিকে গুলি ছুড়তে থাকেন। এতে শুধু ওই এলাকা নয়, গোটা দেশে সৃষ্টি হয় এক ভীতিকর পরিবেশ।  জন্ম নেয় এক বীভৎস ঘটনার।

৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান ঘটলেও ততক্ষণে বিদ্রোহী সৈনিকরা কেড়ে নেয় ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তার জীবন। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে।

ঘটনার পর পিলখানা থেকে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। মাত্র ৩৬ ঘণ্টার এই হত্যাযজ্ঞে ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুইজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, নয়জন বিডিআর সদস্য ও পাঁচজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ফোর্সের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। পরে এটিকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলে নাম, পোশাক, লোগো, সাংগঠনিক কাঠামো, পদোন্নতি ইত্যাদি ব্যাপারে নতুনত্ব এনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) নামে সীমান্ত রক্ষী ফোর্সের জন্ম হয়। পরিবর্তন করা হয় বিডিআর বিদ্রোহের আইন। বর্ডার গার্ড আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়।

মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। মামলায় সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়।

রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড, ২৭৮ জনকে খালাস এবং চারজন আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় মামলার দায় থেকে তারা অব্যাহতি পায়।

আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়।

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিডিআর) সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। একইসঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। অন্যদিকে এ মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টু হাইকোর্টের বিচার চলাকালে মারা যান।

এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দু’জন আসামির মৃত্যু হয়েছে এবং ১২ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সরকারিভাবে এ দিনটিকে ‘পিলখানা হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এ দিবসটির স্মরণে দু’দিনব্যাপী বিশেষ কর্মসূচি পালন করবে বিজিবি।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ মোহসিন রেজা জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদরদপ্তর, পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদ ব্যক্তিবর্গের স্মরণে ২৫ ফেব্রুয়ারি শাহাদাত বার্ষিকী পালিত হবে।

শহীদ ব্যক্তিবর্গের রুহের মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে পিলখানাসহ বিজিবির সব রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সকল মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

এ ছাড়া ২৬ ফেব্রুয়ারি বাদ আসর সোয়া ৫টায় পিলখানায় বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদ ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এতে স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদ ব্যক্তিবর্গের নিকটাত্মীয়গণ, পিলখানায় কর্মরত সকল অফিসার, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবির সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারীগণ অংশগ্রহণ করবেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/নূর/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়