ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দুদকের গণশুনানি : ঘুষ ও দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ ওয়াসার গ্রাহক

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৪, ১৪ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুদকের গণশুনানি : ঘুষ ও দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ ওয়াসার গ্রাহক

নিজস্ব প্রতিবেদক : অবৈধ লা্ইনের ছড়াছড়ি, ঘুষের বিনিময়ে বিল টেম্পারিং, বাড়তি বিল, নিয়মিত পানি না পাওয়াসহ বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ ও দুর্নীতিতে ক্ষুব্ধ রাজধানীর মিরপুর এলাকার অধিকাংশ গ্রাহক।

বুধবার দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের গণশুনানি অনুষ্ঠানে ঢাকা ওয়াসার সেবাগ্রহিতারা এমন নানা অভিযেোগ তুলে ধরেন। ‘এবার আওয়াজ তুলুন’ স্লোগানকে সামনে রেখে হয় এ গণশুনানি।

রাজধানীর মিরপুর-২ এ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে দুদকের কমিশনার মো. নাসির উদ্দিন ও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিন এ খানের উপস্থিতিতেই সেবাগ্রহিতারা ওয়াসার কর্মকর্তাদের অনিয়ম এবং দুর্নীতিসহ নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন।

দুদকের গণশুনানিতে অংশ নিতে মিরপুরের বাউনিয়াবাদ থেকে এসেছেন ঢাকা ওয়াসার সেবাগ্রহিতা মো. মোশারফ হোসেন। তিনি অভিযোগ করেন, নিজের বসতবাড়ির পানির বিল পরিশোধ নিয়ে একাধিকবার ওয়াসার স্থানীয় কার্যালয়ে গিয়েও কোনো সমাধান পাননি। কারণ একটাই- ওয়াসার কর্মকর্তারা সমস্যা সমাধানের জন্য ঘুষ চেয়েছেন, কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি।

দুদকের শুনানিতে মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আমার বাড়ির বকেয়া বিল ৪০ হাজার টাকা হয়েছে। এসব বিল আমি একসঙ্গে পরিশোধ করব। বিষয়টি মিরপুরের ওয়াসার পরিদর্শক কাজী ফখরুল ইসলামকে জানালে বিল কমিয়ে দেওয়ার জন‌্য অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন। এতে আমি রাজি না হওয়ায় সমাধান করে দেওয়া হয়নি।

অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ার এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার অভিযুক্ত কর্মকর্তা কাজী ফখরুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ওই সময় ভূক্তভোগী মোশারফ হোসেনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরবর্তী সময়ে কাজী ফখরুল নিরব থাকেন। পরে সমস্যাটি তিন দিনের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস দেন ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

মিরপুর বড়বাগ এলাকার তৌফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা মাসের পর মাস পানি পাই না। কিন্তু এক মাইল দূরের মানুষ পাম্পের লোকদের সঙ্গে আঁতাত করে পানির লাইন নিয়েছে। কিন্তু পাম্পের পাশেই পানি পাই না। কারণ, একটি জায়গা থেকেই ৮০ থেকে ৯০টি অবৈধ পানির লাইন দেওয়া হয়েছে। ওয়াসার কর্মকর্তারা ওইসব অবৈধ লাইন থেকে মাসে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

একই এলাকার নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এলাকার কিছু অংশ দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা উচিত। ১০ বছর ধরে আমরা পানির জন্য কষ্ট করছি, কিন্তু পানি পাই না। এই পানির জন্য ঘুরতে ঘুরতে পায়ের জুতা কয়েক জোড়া ক্ষয় করছি, কিন্তু সমাধান পাইনি। কবে সমাধান পাব সেটাও কর্মকর্তারা আমাদের জানান না।’

এ প্রসঙ্গে দুদকের পরিচালক নাসিম আনোয়ার ওয়াসার কর্মকর্তা আব্দুল মজিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘বড়বাগসহ আশপাশের এলাকা অনেক জনবহুল। সেখানে পানির চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হচ্ছে। আশা করছি, আগামী এক মাসের মধ্যে বড়বাগের পানির সমস্যা চিরদিনের জন্য শেষ হবে।’

উত্তর ইব্রাহিমপুরের শহিদুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘দিনের পর দিন যায় কিন্তু আমরা ঠিকমতো ওয়াসার পানি পাই না। টাকা দিয়ে পানি কিনে চলতে হয়। পানির জন্য বার বার ওয়াসার কার্যালয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পানির সমস্যার সমাধান করে দেন না। আমাদের কথা শুনবে তো দূরের কথা, অফিসে গেলে পাত্তাই দেয় না কর্মকর্তারা। কিন্তু কেউ টাকা দিলেই সব সমস্যা সমাধান হয়। টাকা দিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাড়িতে করে পানিও দিয়ে আসে ওয়াসার লোকরা।’

ইব্রাহিমপুর এলাকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মজিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি তিন মাসের মধ্যে ওইসব এলাকার পানির সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দেন গণশুনাণিতে।

গণশুনানিতে ভূক্তভোগী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এলাকায় অবৈধ লাইন দিচ্ছে কয়েক শত। দিনের বেলায় ওয়াসার কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে লাইন কেটে দিয়ে গেল। কিন্তু রাতের বেলায় সেই ওয়াসার লোকজন এসেই অবৈধ লাইনগুলো সংযোগ দিয়ে গেল। স্থানীয় দালালদের সঙ্গে ওয়াসার কর্মকর্তারা আঁতাত করেই এমন জালিয়াতি করে গেলেও আমরা বৈধ গ্রাহকরা পানি পাই না। সেবা চাইতে গেলে আমাদেও পাত্তা দেয় না, খারাপ ব্যবহার করে।’

এভাবে অর্ধশত ভূক্তভোগী দুদকের গণশুনানিতে নিজ নিজ এলাকার সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি হয়রানি এবং ওয়াসার কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ উপস্থাপন করেন।

এদিকে ওয়াসার কর্মকর্তারা বৃহত্তর মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের নিজেদের পরিচিত স্বজন কিংবা ভাড়াটে লোক এনে গণশুনানি অনুষ্ঠানে উপস্থিত করার অভিযোগ পাওয়া যায়। গণমাধ্যমের একজন কর্মী এ বিষয়ে দুদকের কমিশনারের দৃষ্টি আর্কষণ করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেন দুদকের কর্মকর্তারা।

পরবর্তী সময়ে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা প্রকৃত ভূক্তভোগীরা গণশুনানিতে অংশ নিয়ে নিজ নিজ এলাকার সমস্যাসহ ওয়াসার কর্মকর্তাদের অনিয়ম এবং দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন। পাশপাশি দুদক কর্মকর্তা ভূক্তভোগীদের সমস্যাগুলো কতদিনের মধ্যে সমাধান করা হবে সে প্রতিশ্রুতিও আদায় করেন।

গণশুনানির শেষ পর্যায়ে অভিযোগ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিন এ খান বলেন, ‘আমাদের সংস্থায় আগামীতে কোনো মিটার রিডার থাকবে না। ওয়াসাকে শতভাগ অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ অটোমেশনের আওয়াতায় চলে এসেছে। আশা করছি, আগামীতে শুধু মিরপুর নয়, সারা ঢাকা শহরের মানুষ ভোগান্তিমুক্ত ঢাকা ওয়াসা পাবে। দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা জড়িত হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গণশুনানিতে দুদকের কমিশনার ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ওয়াসা ইতিমধ্যে বেশকিছু উন্নতি করেছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সেবা পাচ্ছে। কিন্তু ওয়াসার ওপর মানুষের পুরোপুরি আস্থা আসেনি।’

ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক উত্তম কুমার রায়, শহীদউদ্দিন এবং দুদক পরিচালক মো. মনিরুজ্জামানসহ ওয়াসার সংশ্লিষ্ট জোনের কর্মকর্তারা গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মার্চ ২০১৮/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়