ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

আমাদের রাশেদ স্যার

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৮, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আমাদের রাশেদ স্যার

|| শাহেদ হোসেন ||

সদ্য ভাঁজখোলা শার্ট-জিন্সের প্যান্ট পরা সাড়ে পাঁচ ফুটের কৃষ্ণকায় তরুণ তার কাঁধ ছুঁইছুঁই উচ্চতার এক সদ্য কিশোরকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। উঠানে থাকা বাড়ির ‍লোকজন বেশ বিব্রত। বেশি বিব্রত বোধ করছেন তরুণের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা চাপ দাড়িওয়ালা ব্যক্তিটি।বেশ কিছুক্ষণ পর কঠোরভাবেই তিনি বললেন, ‘রাশেদ, এয়ারপোর্ট যেতে সময় লাগবে, ওঠো।’

‘আহারে তুমি তো কয়েক বছর পরে আসতেছো। তুমি পৌঁছেই চিঠি লিখো, ওরাও তোমাকে চিঠি দেবে।’- কিশোরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার বাবাও এবার বোঝাতে শুরু করলেন তরুণকে। ইতিমধ্যে হয়তো তরুণের আবেগও কিছুটা থিতু হয়ে এসেছে। শেষমেষ চোখ মুছতে মুছতে তরুণ বললো, ‘চিঠি লিখিসরে শাহেদ, আমার কাছে ছবি পাঠাবি।’ তার কথায় সবাই যেন একটু হাফ ছাড়লো, যাক! বিদেশ যাচ্ছে তাহলে।

এই হলো আমার ‘রাশেদ স্যার’। আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ গৃহশিক্ষক। হাতেখড়ি থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত- টানা নয় বছর পড়েছিলাম তার কাছে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষকের পরিবর্তে আমাদের দুজনের সম্পর্কটা ঠেকেছিল ছোট ভাই-বড় ভাইয়ের সম্পর্কে।

সেই চাপ দাড়িওয়ালা লোকটি ছিল রাশেদ স্যারের বড় ভাই মিজানুর রহমান। তিনি আমার আম্মারও গৃহশিক্ষক ছিলেন। সবেমাত্র আমাকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। দুপুরে মিজান সাহেব তার ভাইকে আমাদের বাসায় নিয়ে হাজির। আম্মাকে বললেন, ‘তোমার তো দুই ছেলে। ‍দুটোই পিঠাপিঠি। আমার ছোটভাইকে দিয়ে গেলাম। ও তোমার দুই ছেলেকে পড়াবে।’

আম্মা শুধু বললেন, ‘ঠিক আছে স্যার।’

ওই দিনই বাড়ির উত্তর দিকের খালি ঘরটি রাশেদ স্যারের জন্য নির্ধারিত হয়ে গেল। ওটাই স্যারের থাকার জায়গা, আমাদেরও পড়ানোর ঘর। পড়া হতো দুই বেলা, বিকেলে ও রাতের খাবারের আগে।

স্যার বেশ আমুদে স্বভাবের ছিলেন। প্রথমদিনেই ভাব জমিয়ে ফেলেছিলেন। আমাকে কোলে বসিয়ে হাতের লেখার চর্চা করাতেন। রাতে পড়ার ফাঁকে চলতো ভূত-পেত্নির গল্প।

তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর দুষ্টুমির মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ভয় দেখানোর জন্য টেবিলে কাঠের স্কেল রাখা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে দু’এক ঘা খেতামও। তবে এরপরই মিলতো আদর, সঙ্গে চারআনা দামের আরবি চকলেট ফ্রি।

একদিন কী এক কারণে যেন পড়তে ইচ্ছা করছিল না। আম্মা জোর করে স্যারে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। পড়া না পারায় সেদিন স্যার স্কেল দিয়ে দুটো বাড়িও দিয়েছিলেন। হঠাৎ কী যে হলো, স্যারের হাত থেকে দুম করে স্কেলটা নিয়ে ভেঙ্গে ফেললাম। কপাল এমন মন্দ, আম্মাও ওই সময় স্যারকে কিছু একটা বলার জন্য ঘরে ঢুকেছিলেন। আমার কারবার দেখে তিনি থ! দাঁত কিড়মিড় করে আম্মা বলে গেলেন,‘তোমার আব্বা বাসায় আসুক।’

রাতের খাবার শেষে সবে স্যারের ঘরে পড়তে বসেছি। আব্বা রীতিমতো ঝড়ের বেগেই ঘরে ঢুকে স্যারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাশেদ তোমাকে তো প্রথমদিনই বলেছিলাম, হাড্ডি আমার মাংস তোমার। তোমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছে, তুমি কিছুই বললা না কেন?’

স্যার যখন আমতা আমতা করছিলেন, আব্বা তখন বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে আমাকে চেয়ার থেকে তুলে আনলেন। এরপর শুরু হলো ধোলাই। বেতের একেকটা বাড়িতে মনে হচ্ছিল গায়ের চামড়া উঠে আসছে। আব্বা পেটাচ্ছেন, আর চিৎকার করে বলছেন, ‘বেয়াদব, তোমাকে আমি এই শিক্ষা দিয়েছি? স্যারের সঙ্গে বেয়াদবি!’

আমার অবস্থা দেখে রাশেদ স্যার চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে আব্বার হাত ধরে ফেলে বললেন, ‘দুলাভাই এবারের মতো মাফ করে দেন। ও ছোট মানুষ। আর করবে না।’

আব্বা রাশেদ স্যারকে বললেন, ‘তুমি ছাড়। ওকে আজ মেরেই ফেলব। আমার এমন ছেলের দরকার নাই। কত্ত বড় সাহস!’

বেত নিয়ে দু’জনের ধস্তাধস্তির ফাঁকে আমি ঘরের এক কোণায় গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। এক পর্যায়ে রাশেদ স্যার আব্বার পা ধরে বসলেন। আব্বা তখন বাধ্য হয়ে হাতের বেত ছুঁড়ে মারলেন। স্যার পা ছেড়ে দিতেই দুপদাপ করে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলেন তিনি।

পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য একটা জগৎ আছে সেটা চিনিয়েছিলেন রাশেদ স্যার। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় ‘ছোটদের ঠাকুরমার ঝুলি’ বইটি তিনিই কিনে দিয়েছিলেন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর হাতে দিয়েছিলেন সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা সিরিজের বই। জীবনে প্রথম দুর্গাপূজার মেলায় তিনিই নিয়ে গিয়েছিলেন।

সবেমাত্র সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছি। একদিন পড়ার টেবিলে স্যার জানালেন, তিনি মালয়েশিয়া চলে যাবেন। তার ভিসা হয়ে গেছে। আগামী মাসে ফ্লাইট। ওই সময় কথাটা মনে অতোটা বাজেনি। বিদায়ের ক্ষণ যতো ঘনিয়ে আসতে লাগলো মন খারাপ ভাবটাও বাড়তে শুরু করেছে। যেদিন বিকেলে রাশেদ স্যারের ফ্লাইট সেদিন সকালে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এই দুই পুঁচকিকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।’

সকালে স্যারের ভাই আমাদের বাড়ি এসে উঠেছিলেন। তিনি ছোট ভাইয়ের ঘোষণা শুনে ভড়কে গিয়েছিলেন। স্যারের বাবা ছিলেন কৃষক। সংসারের উপার্জনও খুব একটা ভালো ছিল না। স্যারকে মালয়েশিয়া পাঠানোর খরচ জোগাতে কিছুটা জমিও বেঁচতে হয়েছিল তার বাবাকে। স্বাভাবিকভাবেই আবেগের চেয়ে বাস্তবতার মূল্য বড় ভাই স্যারের চেয়ে বেশি বুঝতেন। তিনি আম্মাকে বিষয়টি জানালেন। আব্বা সেদিন স্যারের বিদায় উপলক্ষে ছুটি নিয়েছিলেন। তিনি এবার স্যারকে বোঝালেন।

উহু, রাশেদ স্যারের এক কথা, ‘আমি এগুলোরে মানুষ করছি। এগুলো এখন আমার ছোট ভাইয়ের চেয়ে বেশি। আমি আপনাদের কাছে অনেক পেয়েছি। চাকরি-বাকরি দেশে একটা হয়ে যাবে। আমি যাব না।’

যেতে অবশ্য স্যারকে হয়েছিল। বাস্তব অনেক নির্মম। এক বছরের মাথায় স্যার মালয়েশিয়া থেকে ফিরেছিলেন কঙ্কালসার দেহ নিয়ে। শুনেছিলাম, তাকে জাল ভিসা দেওয়া হয়েছিল। পুলিশের হাতে আটক হয়ে কারাগারে ছিলেন। ঢাকায় ফিরে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আমি তখন স্কুলে থাকায় দেখা হয়নি তার সঙ্গে। ওই দিনই তাকে চলে যেতে হয়েছে যশোর- নিজের বাড়িতে। বেশ কিছুদিন পর স্যারের বড় ভাই বাসায় এসেছিলেন। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আম্মার কাছে শুনেছিলাম, এক সপ্তাহ আগে রাশেদ স্যার মারা গেছেন। ব্রেন স্ট্রোক করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি একটিবার আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। ঢাকায় আসার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কিন্তু আসা হয়নি। কারণ ভালোবাসতে গেলেও যে পয়সা লাগে!  



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়