ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কেন শিশুদের প্রোগ্রামার বানানো জরুরি || মোস্তাফা জব্বার

মোস্তাফা জব্বার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২০, ২৫ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেন শিশুদের প্রোগ্রামার বানানো জরুরি || মোস্তাফা জব্বার

অনেক আগে থেকেই ভাবছিলাম শিশুদের থেকেই শুরু করতে হবে প্রোগ্রামিংয়ের জগত। কারও কারও সামনে প্রসঙ্গটি উপস্থাপনও করেছি। কিন্তু জবাবটা বরাবরই হাতাশাজনক হয়েছে। কেউ ভাবতেই পারেন না যে, প্রোগ্রামিংয়ের মতো জ্ঞান শৈশব থেকেই নেওয়া যেতে পারে। এখন থেকে ৯ বছর আগে নিজের ঘরে বসে বিজয়কে দেখেছি শৈশবেই অতি চমৎকারভাবে স্ক্র্যাচ দিয়ে প্রোগ্রামিং করতে। বিজয়ের বয়স যখন ৯ তখন এমআইটি ল্যাব এই প্রোগ্রামিং ভাষাটি প্রকাশ করে। তখন থেকেই স্ক্র্যাচ তার প্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়। তবে স্কুলের লেখাপড়ার ভারে স্ক্র্যাচের দিকে তেমন মনযোগ দিতে পারেনি। যখন স্নাতক স্তরে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়তে মালয়েশিয়ার মনাসে সে যায় তখনও দেখলাম প্রোগ্রামিং শেখার প্রথম পাঠ হলো স্ক্র্যাচ। যাদের আগ্রহ আছে তারা স্ক্র্যাচ বিষয়ে ইন্টারনেটে আরও বিস্তারিত জানতে পারেন। ওখানে বলা আছে : The Scratch project, initiated in 2003, has received generous support from the National Science Foundation (grants 0325828, 1002713, 1027848, 1019396), Intel Foundation, Microsoft, MacArthur Foundation, LEGO Foundation, Code-to-Learn Foundation, Google, Dell, Fastly, Inversoft, and MIT Media Lab research consortia. (https://scratch.mit.edu/about/)

 

ভেবেছিলাম দেশের শিশুদের মাঝে স্ক্র্যাচ ছড়িয়ে দেব। কিন্তু করা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে গত কয়েক মাস ধরে আমি চেষ্টা করছি শিশুদের সাথে সফটওয়্যার প্রোগ্রামিং বিষয়টি পরিচিত করাতে। প্রথমে নিজে এমআইটি ল্যাব উদ্ভাবিত স্ক্র্যাচ নামক এই প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ পরীক্ষা করে দেখি। ৮-১৬ বছর বয়সের শিশুর জন্য খুব সহজে প্রোগ্রামিং ধারণা পাওয়ার জন্য এটি অতি চমৎকার একটি প্রোগ্রামিং ভাষা।  এমআইটির মন্তব্য হচ্ছে : Scratch is designed especially for ages 8 to 16, but is used by people of all ages. Millions of people are creating Scratch projects in a wide variety of settings, including homes, schools, museums, libraries, and community centers.

 

এরপর এর প্রশিক্ষণ সামগ্রী রচনার দিকে মনযোগী হই। আমার কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক স্তরে পড়ুয়া ছেলে বিজয়কে প্রশিক্ষণ সামগ্রী প্রস্তুতের অনুরোধ করলে সে সাগ্রহে কাজটি শুরু করে এবং এখন এটি একটি কর্মশালায় উপস্থাপনের স্তরে রয়েছে। ১৫ সালের নভেম্বর মাসে এই বিষয়ে উৎসাহব্যঞ্জক আরও একটি ঘটনা ঘটে। সরকারের আইসিটি বিভাগ শিশুদের প্রোগ্রামিং শেখার কর্মসূচি হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটি এখন বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করছি সহসাই সরকারিভাবেও এই ধারণাটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমি এখন আরও উৎসাহিত বোধ করছি এজন্য যে আমাদের দেশের মানুষের মাঝেও কম বয়সে প্রোগ্রামিং শেখার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।

 

আমাকে অবাক করে দিয়ে দৈনিক ‘প্রথম আলো’র ১৭ জানুয়ারি ২০১৬ সংখ্যায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ‘শিশুরাই হোক প্রোগ্রামার’। খবরটি এ রকম : ‘‘ব্ল্যাকবোর্ডে ইংরেজি হরফের ‘খটমট’ কিছু শব্দ ও সংকেত। বীজগণিতের সঙ্গে মেলে, আবার কোথায় যেন অমিল। চট করে বুঝে ওঠা কঠিন। অথচ ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে বসা মুখগুলো দিব্যি এ নিয়ে আলোচনায় মত্ত। ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষকের করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। ছাত্র-শিক্ষকের আলোচনায় একের পর এক সমাধান। শিক্ষকের চোখে তৃপ্তির আভা। এমন কাঠখোট্টা বিষয়ও যেন আনন্দ নিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। বলছিলাম আউটসবুক প্রোগ্রামিং পাঠশালার কথা। আর ‘খটমট’ শব্দ ও সংকেত প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা। আউটসবুক তরুণদের একটি সংগঠন। যাঁরা স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে পারদর্শী করতে মাঠে নেমেছেন। তাঁদের স্বপ্ন, একদিন স্কুল শিক্ষার্থীরাই বানাবে নতুন নতুন সফটওয়্যার ও গেম। এর অংশ হিসেবে প্রোগ্রামিং পাঠশালা শুরু। যেখানে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের সফটওয়্যার তৈরি থেকে শুরু করে প্রোগ্রামিংয়ের সবকিছু পড়ানো হয়।’’

 

না, ওরা ঠিক শিশু নয়, আমি যাদের কথা ভাবছি। তবে ওদেরও শৈশব আছে এবং বাংলাদেশের সংজ্ঞা অনুসারে তারা ১৮ বছর পার না করায় শিশুই রয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই এটি একটি শুভ সূচনা। কিন্তু আমার ভাবনাটি একেবারেই ৮-১৬ বছরের শিশুদের প্রোগ্রামার বানানোর। একই সাথে আমি বড়দের প্রোগ্রামিং ভাষা দিয়ে শিশুদের ভারাক্রান্ত করতে চাই না।

 

যদিও এই স্কুলটি শিশুদের কেন্দ্র করে গড়ে তোলা নয় এবং বস্তুত স্কুল-কলেজের পাঠ্য বিষয় হিসেবে প্রোগ্রামিং শেখার যে চাপটা আছে তার চাহিদা মেটায় তবুও এমন উদ্যোগ প্রশংসা করার মতো। দেশের অনেক স্থানেই বাধ্যতামূলক আইসিটি শিক্ষাকে ঘিরে এ ধরনের স্কুল বা কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে এবং এটি হয়তো এক সময় বেশ লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে কেন শিশুদের প্রোগ্রামার বানাতে হবে?

 

আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর শেখ হাসিনার সরকার তথ্যপ্রযুক্তিতে যে নতুন জোয়ার আনেন তার অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিলো দেশে প্রোগ্রামারের সংখ্যা বাড়ানো। শেখ হাসিনা নিজে এক সময়ে বছরে দশ হাজার প্রোগ্রামার বানানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে ২০০১ সালের নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার সেই স্বপ্নকে আতুড় ঘরেই মেরে ফেলেন। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর দেশে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কিন্তু একটি বড় ধরনের গলদ এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। আমি বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের মহাসচিব জনাব মুনির হাসানের উদ্ধৃতি থেকে এই বিষয়টি জানাতে পারি যে, আমাদের দেশে যারা কম্পিউটার  বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করে তাদের মাঝে প্রোগ্রামার হওয়ার প্রবণতা নেই বললেই চলে। তার মতে শতকরা মাত্র ৭ জন কম্পিউটার গ্রাজুয়েট ছেলে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হয়। মেয়েদের অবস্থা আরও নাজুক। শতকরা মাত্র একজন মেয়ে প্রোগ্রামার হতে চায়। এই ভয়ংকর অবস্থার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, প্রোগ্রামিং শেখাটিকে ঐ বয়সে কঠিনতম মনে হয়। আমরা আরও লক্ষ করেছি যে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এই দুর্বলতার জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ে ছেলেমেয়েরা চাকরি খুঁজে পায় না। আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের স্নাতকেরা প্রোগ্রামিংয়ের বদলে অন্য দক্ষতাকে প্রাধান্য দেয়। সাধারণভাবে দেশের শিক্ষিত মানুষদের বেকারত্বের চিত্রটিও সুখকর নয়। এ বছরের জানুয়ারিতে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেশের বেকারত্বের যে চিত্র দেখানো হয়েছে সেটি এ রকম :

 

‘দেশে কর্মক্ষম ২৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ বেকার। এর মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, নারী ১২ লাখ ৩০ হাজার। যা মোট শ্রমশক্তির সাড়ে ৪ শতাংশ। তিন বছর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এক দশক আগে ছিল ২০ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী এ তথ্য পাওয়া গেছে।’

 

এই খবরেই বলা হয়েছে যে, ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস-এর দেওয়া তথ্য সঠিক নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা শতকরা ১৪.২ ভাগ। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর নতুন করে ১৩ লাখ বেকার যোগ হচ্ছে।

 

অন্যদিকে একই খবরে বলা হয় ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) ‘বিশ্ব কর্মসংস্থান ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে বেকারত্ব বৃদ্ধির হার ৪৩৩ শতাংশ। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৬ সাল শেষে মোট বেকার দ্বিগুণ হবে। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। আবার লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্য মতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার।’

 

শিক্ষিত বেকারদের দুর্ভাগ্য যে, তারা একটি অচল শিক্ষাব্যবস্থার বলী। এই ব্যবস্থায় এমন সব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে দেশে তো দূরের কথা দুনিয়াতেই যার কোনো কর্মসংস্থান নেই। বস্তুতপক্ষে এই অবস্থা দিনে দিনে ভয়াবহ হচ্ছে। প্রচলিত শিক্ষা যে ধরনের দক্ষতা দিচ্ছে সেটি দিয়ে আগামী দিনে কোনো ধরনের কাজের যোগ্য হওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে দুনিয়াজুড়ে রয়েছে প্রোগ্রামারদের বিপুল চাহিদা। পৃথিবীর সকল উন্নত দেশ প্রোগ্রামার খুঁজে বেড়ায়। বাংলাদেশেও প্রোগ্রামারদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমরা আমাদের সফটওয়্যারের কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোগ্রামার পাই না।

 

আমরা খুব সংযতভাবেই জানাতে চাই যে, বিশ্বে প্রোগ্রামাররা কেবল চাহিদার শীর্ষে নয়, তারাই পায় সর্বোচ্চ বেতন। আমি  সে কারণে মনে করি ডিজিটাল দুনিয়াতে সেরা পেশাটির নাম প্রোগ্রামার। আমাদের কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়লেও প্রোগ্রামারের সংখ্যা একদমই নগন্য। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্নাতক বা কলেজ স্তরে প্রোগ্রামিং শেখানোর উদ্যোগ  নিলে হবে না। ওরা যদিও কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়তে চায়, তথাপি প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি তাদের আগ্রহ জন্মে না।

 

এ জন্য আমরা বিষয়টিকে ভিন্নভাবে একটি শিক্ষা বা তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলন হিসেবে নিয়েছি। আমরা চাই শৈশব থেকেই শিশুদের প্রোগ্রামিং সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হোক।  আমরা বড়দের প্রোগ্রামিং ভাষা নিয়ে শিশুদের মাথা ভারী করতে চাই না। স্ক্র্যাচ এমন একটি প্রোগ্রামিং ভাষা যা দিয়ে কোনো কোড লিখতে হয় না এবং কেউ একে খেলা হিসেবেই নিতে পারে।

 

আমি মনে করি, শিশুদের হাতে ছোট আকারের ল্যাপটপ, ট্যাব প্রদান করে ওদের সাধারণ লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রোগ্রামিং শেখার কাজটাও যুক্ত করা যেতে পারে।

 

এবার ভাবুন তো দুই কোটি বিদ্যমান শিশু এবং প্রতি বছরে ২৫ লাখ নতুন শিশু, তাদের সবার হাতে ডিজিটাল যন্ত্র, তাদের শিক্ষার ডিজিটাল কনটেন্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ডিজিটাল ক্লাসরুম, শিক্ষার ব্যবস্থাপনার জন্য হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির বাজারটা কতো বড়?

 

এর ফলাফলটাও ভাবুন। ১০ বছর পরে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি এবং প্রোগ্রামিং জানা কতো বিশাল একটি তরুণ প্রজন্ম আমরা পাবো। আসুন সেই স্বপ্নপূরণে শিশুদের প্রোগ্রামার বানাই।

 

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, নিবন্ধকার

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ নভেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়