ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

কেন সিরিয়াল আমদানী আর বিজ্ঞাপন রপ্তানি?

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেন সিরিয়াল আমদানী আর বিজ্ঞাপন রপ্তানি?

ফিরোজ আলম : বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোতে আজকাল ডাবিংকৃত সিরিয়ালের আনাগোনায় স্থানীয় নির্মাতা এবং কলাকুশলীরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। মানুষ যখন তার আয়-রোজগার তথা অস্তিত্বের প্রতি হুমকি দেখতে পায়, তখন বিচলিত হয়, প্রতিবাদী হয়ে ফুঁসে ওঠে- এটাই স্বাভাবিক। তাদের বেশিরভাগ দাবির সঙ্গে আমিও একমত। কিন্তু বিদেশি সিরিয়াল একেবারে বন্ধ করাটা মনে হয় যুক্তিযুক্ত হবে না। ধরুন, কাল যদি বাংলাদেশের সব লেখক আন্দোলন শুরু করেন আর বিদেশি বই এদেশে বিক্রি করা যাবে না, বিদেশি লেখকদের জন্য আমাদের দেশের বই কেউ পড়ে না- তাহলে কি বিষয়টি জ্ঞানের মুক্তচিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করবে না? বিশ্বায়নের যুগে আমাদের সংস্কৃতির পাশাপাশি অন্য দেশের নির্মাণ কিছু কিছু দেখা উচিৎ। তবে অবশ্যই তা যৌক্তিক মাত্রায় থাকতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে বিদেশি সাহিত্য পড়ে কিংবা নাটক দেখে আমি মজা পাই না। আসলে স্মৃতিশক্তি ভালো না হওয়ায় চরিত্রগুলোর নাম মনে রাখাটাই কষ্টকর। তাই বাংলাসাহিত্য ছাড়া আমার পড়ার গণ্ডি খুব ছোট। তারপরও বিদেশি লেখা পড়তে হয় ক্ষুধার জ্বালায়। মানুষ যেমন স্বাদু খাবারটাই আগে খেতে চায়, তেমনি পড়া কিংবা নাটক-সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই। শুধু দেশি বলে হাতের নাগালে ভালো স্বাদের বিদেশি খাবার রেখে কেউ অল্প স্বাদের দেশি খাবার খাবে না। তেমনি শিল্প-সাহিত্যও ভালোটাই মানুষ গ্রহণ করবে। কোরো আইন দিয়ে এটা রোধ করা যাবে না।

একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, আমরা ‘রমজান’ কিংবা ‘ফুলমতি’ চরিত্রগুলোতে নিজেদের যেভাবে খুঁজে পাই ‘সম্বুলাগা’, ‘গুলাগা’ চরিত্রগুলো আমাদের সেভাবে টানে না। কারণ এমন অদ্ভুত নামে আমরা অভ্যস্ত নই। তবুও কেন আমরা এসব দেখি? এটি ভাবার বিষয়। ওই যে বললাম, ক্ষুধার কথা। সুন্দর অভিনয়, টানটান উত্তেজনাকর ভালো গল্প আর ব্যায়বহুল নির্মাণ। এসবের জন্য মানুষ এখন ক্ষুধার্ত।

বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের নাটক কতটা মানসম্পন্ন হচ্ছে তা কি আমরা কখনো আত্মসমালোচনা করার চেষ্টা করেছি? নাটক যদি সমাজের দর্পণ হয়ে থাকে তাহলে আমাদের নাটকগুলোতে আমাদের সমাজের চিত্র ফুটে ওঠা উচিত। আজকাল নাটকে কি আমাদের সামাজ খুঁজে পাই? গ্রামের প্রেক্ষাপটে নির্মিত নাটকে দেখি যুবকেরা সারাদিন জিন্স-টিশার্ট-সানগ্লাস-সুজ পরে ঘুরে বেড়ায়। আমি আমার গ্রামের যুবকদের বেশিরভাগ সময় লুঙ্গি পরে থাকতেই দেখি। গ্রামের বাজারে গেলে তারা অবশ্য প্যান্ট পরেই যায়, তবে পায়ে সবসময়ই স্যান্ডেল। আমি বাংলাদেশের কোনো এলাকায় গিয়ে ৭০ বছরের বৃদ্ধ জন প্রতিনিধি পাইনি যারা গলায় চার-পাঁচটা পুতির মালা গলায় দিয়ে টিশার্টের উপর বোতাম খোলা শার্ট চাপিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমাদের দেশের স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের শিক্ষার হার কম থাকলেও পোষাকে তাদের খুব মার্জিতই দেখেছি সবসময়। তাহলে নাটকের এই চরিত্রগুলো কোন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন?

এরপর আসি ভাষার ব্যবহার নিয়ে। আমরা যারা মফস্বল থেকে উঠে এসেছি তারা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শিখেছি মূলত নাটক দেখে। আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, বন্ধুরা কেউ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন না। আমরা নাটক দেখে শিখতাম কোন শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ কোনটি। কিন্তু আজকালকার ছেলে-মেয়েরা নাটক দেখে কি ভাষা শিখতে-বলতে পারেন?  বিভিন্ন ধরনের ভুল আঞ্চলিকতায় ভরা একটা খিচুরি ভাষা। আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে নাটক নির্মাণে আমার আপত্তি নেই। তবে অবশ্যই নির্মাণের সময় ওই ভাষায় পারদর্শী একজন সহকারী পরিচালক থাকতে হবে। যিনি আঞ্চলিক ভাষার শুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করবেন। যে অঞ্চলের ভাষায় নাটকটি নির্মাণ করা হবে পুরো নাটকের ভাষা সেটাই হবে। নাটকের শুরুতেই বলে দেওয়া হবে এটা অমুক অঞ্চলের ভাষায় নির্মিত। এক নাটকে ৯-১০ ধরনের ভাষা শুনে শুনে আমাদের শিশু-কিশোরদের ভাষা মিশ্র ভাষায় রূপ নিচ্ছে। বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু নাটক নির্মাণের প্রয়োজন আছে বৈকি। কিন্তু নাটকের মূল ভাষা হওয়া উচিৎ শুদ্ধ বাংলা ভাষা। পাঠ্যবই যে ভাষায় লেখা হয় সেই ভাষা। মনে রাখতে হবে, মানুষ কথা বলতে শেখে শুনে শুনে।

টিভি চ্যানেলগুলোর দায়িত্ব এক্ষেত্রে অনেক বেশি । তারা যদি যোগ্য লোকদের দিয়ে নাটক তৈরি করান তাহলে দর্শক অবশ্যই ভালো নাটক দেখতে পাবে। নাটক বাছাইয়েও যারা কাজ করেন তাদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। অনেক নির্মাতা বাজেটের জন্য আক্ষেপ করেন। সত্যিই তো, ভালো বাজেট না পেলে নির্মাতা ভালো নাটক তৈরি করবেন কী করে? বেশিরভাগ নির্মাতা মনে করেন যে, তাদের পর্যাপ্ত বাজেট দিলে তারা অনেক ভালো নাটক উপহার দিতে পারবেন। চ্যানেলগুলোও আবার বিজ্ঞাপনের মূল্য কম এই অভিযোগ তোলেন। কিন্তু আমরা দেখেছি নির্মাণ ভালো হলে বিজ্ঞাপনদাতারা উচ্চমূল্যে বিজ্ঞাপন দিতে প্রস্তুত আছেন। হালের একটি ডাবিংকৃত সিরিয়ালের বিজ্ঞাপন মূল্য বেশি হওয়ার পরও অনেক প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করতে হচ্ছে। তার মানে বিজ্ঞাপন দাতারা টাকা দিতে প্রস্তুত যদি অনুষ্ঠান দর্শকপ্রিয় হয়। দেখা যাচ্ছে একটি চ্যানেলের কোনো প্রোগ্রামে মিনিটে তিন লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য হুরোহুরি লেগে যায়, আবার সেই একই চ্যানেলকে পাঁচ হাজার টাকা পেতে কষ্ট করতে হয়। তাই বিজ্ঞাপন দাতারা কেন টাকা দিতে চান, আর কেন দিতে চান না এ বিষয়টিও চ্যানেলগুলোকে ভাবতে হবে।

এখন আসি দর্শকের কথায়। টিভি চ্যানেলগুলোর বিদেশে বিজ্ঞাপন পাচার কিংবা নির্মাতা-কলাকুশলীদের বিদেশি সিরিয়াল আমদানী বন্ধের আন্দোলন থেকে আমাদের দর্শক কী পাবেন? দর্শকদের জায়গাটা নিয়ে কেউ কি ভাবছেন? দর্শক কী চান, কেন তারা বিদেশি চ্যানেলের প্রতি দুর্বল- তা কি আমাদের কলাকুশলী-নির্মাতা কিংবা টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ভেবেছেন? টিভি চ্যানেলগুলো কিছুটা ভেবেছে হয়তো। ভেবেছে বলেই তারা দর্শকপ্রিয় বিদেশি সিরিয়াল ডাবিং করে চালাচ্ছেন। তবে একটি সিরিয়ালের ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে বলে সব সিরিয়ালের ক্ষেত্রেই এমন কিছু হবে সে আশা করা ভুল।  আমরা অতীতে দেখেছি, ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিনের সাফল্যে অনেকেই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণে মনোযোগী হয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবে কেউ সফল হতে পারেননি। তার মানে একটা যৌথ পরিকল্পনার প্রয়োজন আছে। দেশি-বিদেশি মিলিয়েই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করতে হবে। সেখানে অবশ্যই বিদেশি অনুষ্ঠানের সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। নতুবা দেশে শিল্প টিকবে না। নির্মাতাদেরও দর্শকদের কথা মাথায় রেখে নাটক-টেলিফিল্ম-সিরিয়াল নির্মাণ করতে হবে।

একজন তরুণ নির্মাতার জন্য পেশাভিত্তিক পরিচয়ের দাবি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। পড়ে আমার মনে হয়েছে বার কাউন্সিলের মতো নির্মাতাদের কোনো সংগঠন করা যায় কিনা, যাতে করে যে কেউ চাইলেই নির্মতা হতে পারবেন না। তখন প্রত্যেক নির্মাতাকেই একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠির যোগ্যতা অর্জন করে আসতে হবে। সিনিয়র নির্মাতারা এই দিকটি ভেবে দেখতে পারেন।

পরিশেষে বলতে পারি, আমরা যে পরিকল্পনাই করি না কেন সবার আগে দেখতে হবে দর্শকের স্বার্থ। দর্শকের বিনোদনের চাহিদা মেটাতে না পারলে তারা অন্য দেশের মিডিয়ার প্রতি ঝুঁকবে। আর দর্শক যেদিকে যাবে অর্থাৎ দেশি-বিদেশি চ্যানেল যাই হোক দর্শক যে অনুষ্ঠান দেখবেন, বিজ্ঞাপনও সেদিকেই যাবে-এটাই স্বাভাবিক। তারপরও ‘দেশপ্রেম’ বলে একটি কথা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতাদের উচিৎ সবার আগে দেশের স্বার্থ যাতে রক্ষা পায় সেদিকটি স্মরণে রাখা। নইলে বিষয়টি আমাদের সকলের পেশার জন্যই হুমকি ডেকে আনবে।

লেখক : মিডায়া সংক্রান্ত পেশায় নিয়োজিত




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়