ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পাইরালাইজিং প্রযুক্তিতে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব

ড. এসএম আবু হানিফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ২২ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাইরালাইজিং প্রযুক্তিতে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব

ড. এসএম আবু হানিফ : আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে মানব বর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্য রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে সম্পদে পরিণত করার বিষয়টি আমাদের দেশে এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ সার্বিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই বর্জ্য আমাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারসংকট নিরসনে কার্যকর ও টেকসই ভূমিকা রাখতে পারত। বলাবাহুল্য আমাদের গ্যাস ও বিদ্যুতের ওপর ক্রমেই চাপ বেড়ে চলেছে। অথচ বিদ্যুৎ একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি।

আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের Terralogix Group কর্তৃক আবিষ্কৃত অত্যাধুনিক পাইরালাইজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মানব ও অন্যান্য সুয়ারেজ প্রবাহিত বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও বিবিধ বায়োপ্রোডাক্ট উৎপাদন করা সম্ভব। পাইরালাইজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতি ১০ হাজার লোকের মানব বর্জ্য (night oil) হতে দশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎসহ প্রতিদিন ‘বায়োচার’ নামক পরিবেশ বান্ধব ও কেমিক্যাল মুক্ত জৈবসার উৎপাদন করা যাবে যা জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া বায়ো-গ্যাস, বায়ো-ডিজেল ও বিশুদ্ধ খাবার পানির মতো বাই প্রডাক্ট উৎপাদনও করা সম্ভব।

বায়োচার নামক এই জৈবসার জমিতে ব্যবহার করা গেলে জমিতে পানি ধারণ ক্ষমতা (water retention) ও উর্বরতা অতিমাত্রায় বাড়বে যা কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ব্যবহারের মাধ্যমে কখনই সম্ভব নয়। বায়ো-গ্যাস সিলিন্ডারের মাধ্যমে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বাজারজাত করা যাবে। বায়ো-ডিজেল ফুয়েল হিসেবে গাড়িতে ব্যবহার করা যাবে যা সম্পূর্ণ পরিবেশ সহায়ক।

পাইরালাইজিং পদ্ধতিতে ৬০০-৮০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উৎপন্ন হবে। Turbine ঘূর্ণায়মান অবস্থায় ঐ তাপ থেকে পানি বাষ্প হয়ে ওপরের দিকে উঠবে। ঐ বাষ্প হতে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে পানি ধারণ করা যাবে, তা খাবার পানি হিসেবে ব্যবহারযোগ্য।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের মূল কারণ জ্বালানীর অপ্রতুলতা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ জ্বালানী তেল আমদানি করতে হয়। আর এ জন্য সরকারকে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আধুনিক পাইরালাইজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী হলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা আর ভর্তুকি দিতে হবে না, যা দেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হবে।

বাংলাদেশে যে কয়টি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে এগুলো পাইরালাইজিং পদ্ধতির মাধ্যমে কনভারশন করে চালালে ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েল ভতূর্কি দিতে হবে না। সরকারের ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েল আমদানি করতে যে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়, তা বেঁচে যাবে।

বর্তমানে সরকারি সেক্টরে দেশে যে কয়টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে এর ৭০ শতাংশ গ্যাস চালিত। বাকী ৩০শতাংশ ডিজেল ও ফার্নেস ওয়েল দ্বারা চালিত। প্রাইভেট সেক্টরেও পাইরালাইজিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রকল্পগুলো কনভারশন করা সম্ভব। ফলে গ্যাস ও ডিজেল চালিত স্থাপনাগুলোতে জ্বালানির ভর্তুকির চাপ একেবারই কমে আসবে। বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত গ্যাস অন্যান্য শিল্প কারখানায় ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বর্তমানে ঢাকা শহরে ৩০শতাংশ বর্জ্যর জন্য ওয়াসার সুয়ারেজ কভারেজ আছে। দেখা যায় সুয়ারেজ লাইন কভারেজের ৫-১০শতাংশ  লাইন বিকল অবস্থায় থাকে। ফলে এলাকাবাসীর ভোগান্তি সীমাহীন হয়ে পড়ে। কোনো একটি এলাকার লাইন ব্লক হয়ে গেলে ঐ এলাকার বর্জ্য ওভার ফ্লো করে সরাসরি রাস্তায় চলে আসে। সে সময় রাস্তাগুলো চলাচলের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। বাকী ৭০ শতাংশ বর্জ্যের ঢাকায় সুয়ারেজ কভারেজ না থাকায় ঐ সব এলাকায় বসবাসরত বাড়ি-ঘরের লোকজন সেইফটি ট্যাংক ব্যবহার করে। সেইফটি ট্যাংক যখন ফুল লোড হয়, তখন ক্লিনার দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করে বর্জ্যগুলো সিটি কর্পোরেশনের সারফেস ড্রেনে ফেলে দেওয়া হয়।

ঐ বর্জ্য ধীরে ধীরে সারফেস ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার আশপাশে অন্যান্য নদীতে এসে পড়ে। এর ফলে নদীগুলো আজ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়েছে। এই নদীর পানি ব্যবহারের অযোগ্য ও জলজ প্রাণী নাই বললেই চলে। নদী দূষণের ৭০ শতাংশ দায়ভার সারফেস ড্রেন প্রবাহিত, বাকি ৩০ শতাংশ দূষণের কারণ টেনারি ও পশু জবাইখানা ও অন্যান্য।

বিআইডব্লিউটিএ-এর সাম্প্রতিকতম জরিপে বলা হয়েছে, নদীতে ১১৫টি পথে প্রতিনিয়ত বর্জ্য যাচ্ছে। ওয়াসার গত বছরের এক হিসাব মতে রাজধানীতে পয়ঃবর্জ্যের পরিমাণ ১৩ লক্ষ টন ঘন মিটার। এসব বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টন ঘন মিটার পরিশোধন ক্ষমতা সম্পন্ন ওয়াসার পরিশোধনাগার রয়েছে পাগলায়। অথচ সেখানে বর্জ্য পরিশোধন করা হচ্ছে ৫০ হাজার টন ঘন মিটার। বাকী ১২ লক্ষ ৫০হাজার টন ঘন মিটার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। অথচ এই সব বর্জ্য রিসাইক্লিং করে বিদ্যুৎ ও অন্যান্য বাই প্রোডাক্ট তৈরি করা যেতে পারে। ফলে এই বর্জ্য দেশের সম্পদে পরিণত হবে।

ঢাকার কসাইখানাগুলোতে কত পশু জবাই করা হয় তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রায় দুই কোটি মানুষের মাংসের যোগান দিতে গিয়ে গরু, মহিষ, ছাগল, মুরগি ও অন্যান্য প্রাণীর রক্ত ও পরিত্যক্ত বর্জ্য বিভীষিকাময় অবস্থায় গিয়ে পরিশেষে বিভিন্ন অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় বুড়িগঙ্গা ও আশপাশের নদীগুলোতে গিয়ে পানি বিষাক্ত ও ঢাকার পরিবেশ আবাস অযোগ্য করে তুলছে। কিন্তু পাইরালাইজিং পদ্ধতিতে এই বর্জ্য সম্পদে পরিণত করে সেখান থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস ও জৈব সার উৎপাদন করা যায়।

ট্যানারী কারখানার বর্জ্য দ্বারা ঢাকা শহর এতটাই দূষিত হয়েছে যে, সরকার বাধ্য হয়েছে এই শিল্পকে শহর থেকে দূরে সরিয়ে নিতে। ট্যানারীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রকারের রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রন তরল দ্রবণ নদীকে দূষিত করে, তা দ্রুত মানুষের মরণ ব্যাধি ক্যানসারের দিকে ধাবিত করে। এই বিষাক্ত দ্রবণকেও পারাইলাইজিং প্রযুক্তির মাধ্যমে ট্যানারীতে পূনঃব্যবহার করা যাবে ও অবশিষ্ট বর্জ্যদ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে।

পাগলাতে ওয়াসার সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে বর্তমানে দৈনিক এক হাজার মেগওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার কথা বাদ দিয়ে যদি ঢাকা সিটির কথাই বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে এখানে প্রায় ২ কোটি লোকের বাস রয়েছে। এক কোটি লোকের মানব বর্জ্য ব্যবহারের মাধ্যমে কেবল ঢাকাতেই ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রীডে সংযুক্ত করা সম্ভব।

তাছাড়া প্রত্যেক বড় ও মাঝারী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে তাদের নিজস্ব জেনারেটর রয়েছে। ন্যাশনাল গ্রীড হতে বিদ্যুৎ পেতে ব্যর্থ হলে ফ্যাক্টরি মালিকগনণ নিজস্ব উপায়ে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ফ্যাক্টরি চলমান রাখে। এতে প্রোডাক্টশন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যেহেতু গার্মেন্টর ফ্যাক্টরিগুলো লেবার ইনটেনসিভ অর্থাৎ অনেক শ্রমিক কাজ করে, তাদের নিজস্ব বর্জ্য হতে পাইরালাইজিং পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে পারে। জাতীয় গ্রীড হতে তাদের চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ না কিনলেও চলবে।

বর্তমানে দেশে গ্যাস সংকটের কারণে সার কারখানাগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকে। ফলে সরকারকে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে সার আমদানী করতে হয়। অথচ বিদ্যুৎ সেক্টরে যে গ্যাস ব্যবহারিত হচ্ছে তা সার ফ্যাক্টরিতে বহার করে দেশের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে উদ্ধৃত্ত সার রপ্তানী করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সেমিনারে প্রায় বলে থাকেন, ঢাকার আশেপাশের নদীগুলো দূষিত হয়ে গেছে। আপনার এই নদী দূষণ থেকে রক্ষার উপায় পাইরালাইজিং প্রযুক্তি সমৃদ্ধ প্রকল্প বাস্তবায়ন। যা পরিবেশ ও নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ



রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ২২ জানুয়ারি ২০১৭/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়