ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অভিজিৎরা জন্মায় সিকি শতাব্দীর আগে নয় : অজয় রায়

অজয় রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভিজিৎরা জন্মায় সিকি শতাব্দীর আগে নয় : অজয় রায়

১৯৮৮ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয় অভিজিৎ। সায়েন্সের তিন সেকশন, এক এক সেকশনে ১৫০ করে ছেলে। উদয়ন স্কুল থেকে আসা ছেলেদের ছোটখাট একটি গ্রুপ ছিল। তাতে ছিল অভিজিৎ। বন্ধু-বান্ধবরা সবাই তাকে ডাকত ‘গুল্লু’ বলে। সে ছিল নজরে পড়ার মতোই। ফর্সা, সুদর্শন, একটু বড়সড় শরীর, দীর্ঘাকায়, কোঁকড়া ঘন চুল, ঘন গোঁফ, বয়সের তুলনায় বেশ এক ভারী ভারী ভাব তার। পায়ে সবসময় স্যান্ডেল সু পরতো সে। অভিজিৎ তার গোলগাল চেহারার কারণে পরিচিতদের কাছে ছিল প্রিয় ‘গুল্ল’।

ঢাকা কলেজের পর বুয়েটে পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছে। উদয়ন স্কুলের ছেলেটা বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ত। ব্রেইনের মডেল নিয়ে কাজ করত সে। বুয়েট থেকে পাস করার পর ৫-৬ মাস বুয়েটে চাকরি করেছিল অভিজিৎ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী চন্দনার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। কিন্তু এ বিয়ে স্থায়ী হয় না। রটন্তী এক দুর্ঘটনায় দু’বছর পরে মারা যায়।

পরে এনইউএস (National University of Singapore: NUS ) বৃত্তি পেয়ে সে সিঙ্গাপুর চলে যায়। সেখানে এমফিল ও পরে পিএইচ.ডি করে। ওখানে চাকরিও হয়েছিল। সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে আসে। দেশে ফিরে কিছু দিন থেকে ২০০৫ সালে চলে যায় আমেরিকা। ২০০৬ সালে সে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে সেখানে। ওই বছর দেশে এসেছিল। ২০০৭ সালে রাফিদা আক্তার বন্যাকে বিয়ে করে। তারপর আমেরিকা থেকে অভিজিৎ দেশে আসে ২০০৯ ও ২০১২ সালে। নিয়মিত টেলিফোন করত। পারিবারিক বিষয়েই বেশি কথাবার্তা বলত।

২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সে দেশে আসে। বন্যাকে নিয়ে ওইদিন বিমান থেকে নেমে সকালে উত্তরায় মামাশ্বশুরের বাড়িতে উঠেছিল। বিকেলে আমাদের বাসায় ওঠে। ফার্মগেটে বন্যার আরেক মামার বাসা। যতদিন ছিল আমাদের ওখানে ও মামা শ্বশুরদের বাসায় থাকত।

বন্যার মামা প্রতিদিন মেলায় যেত। আমরা অভিজিৎকে বলতাম, যেন সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় ফিরে অসে, রাত না করে মেলায়। বইমেলায় গেলেও যেন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে থাকে। বইমেলা থেকে দ্রুত নিজের বা মামা শ্বশুড়ের বাসায় যেন চলে আসে- এই পরামর্শ তাকে দেওয়া হয়েছিল। তাকে সতর্ক করতাম।

যেদিন সে দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হয় সেদিন ফার্মগেটে তার মামা শ্বশুড়ের বাসা থেকে বইমেলায় গিয়েছিল। আমেরিকা থেকে আসার পর বন্যার ডিসেন্ট্রি হয়েছিল। আমাদের বাসায় দুই দিন ছিল। পরে তাকে কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 

সে পেশাগতভাবে এগিয়ে ছিল। ২০০৬ সালে ‘মুক্তমনা’ নামে একটি ওয়েবসাইট খুলেছিল এবং এক বছরের অত্যন্ত জনপ্রিয় সাইট হয়ে ওঠে সেটি। আমিও তার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেখানে নানা ধরনের লেখা যুক্ত হতে থাকে। সেকুলার ডেমোক্রেটিক লেখা। মুক্তমনা একটি সমৃদ্ধ সাইট ছিল। অভিজিৎকে ‘টার্গেট’ করার বড় একটি কারণ এই সাইট। এটা পপুলার হয়েছিল। বলা হতো- এটি নাকি নাস্তিকদের আখড়া। কিন্তু আমি তা মনে করি না। অনেক ধর্মবিশ্বাসী কিন্তু উদার মনের মানুষ এখানে চমৎকার প্রবন্ধ লিখতেন।  প্রতিক্রিয়াশীলরাও সাইট খুলেছিল। কিন্তু অভিজিৎ-এরটা ছিল এক্সিলেন্ট।

একজন ভালো লেখক হিসেবে তার বিকাশ ঘটছিল। তার ১০-১২টা বই বের হয়েছে। ২০১৫ সালে বের হয়েছে দুটো বই। রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর মধ্যে চিঠি চালাচালি হতো। সে ১৯১৪ সালের শেষের দিকে ২-৩ মাসের জন্য আর্জেন্টিনা গিয়েছিল। সেখানে সে আর্জেন্টিনার বিদূষী মহিলা (রবীন্দ্রভক্ত) ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কাজের সাথে পরিচিত হয়েছিল এবং ওর সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করে যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর মধ্যে লেখা ৬০টি চিঠিও ছিল। এসব তথ্য নিয়ে সংগ্রহ করে একটি বই প্রকাশ করেছে ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনী’ । এজন্য অভিজিৎকে আর্জেন্টিনা যেতে হয়েছে। থাকতে হয়েছে ২-৩ মাস। চিঠির কপি সংগ্রহ করতে হয়েছে। ওকাম্পোকে সে তুলে ধরেছে তার বইয়ে। বাঙালি পাঠকদের জন্য এটি একটি চমৎকার বই (অবসর প্রকাশিত, ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। সে বছরই তার আর একটি বিজ্ঞানের বই প্রকাশিত হয়েছে তার শিক্ষক মিজান রহমানের সাথে। শিরোনাম ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’। অধ্যাপক মিজান বছরখানেক আগে কানাডায় মৃত্যুমুখে পতিত হন, আর জেহাদী মৌলবাদীরা অভিজিৎকে হত্যা করল ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ প্রকাশ্যে টিএসসি চত্বরে। মুর্খ হত্যাকারীরা জানে না তারা কাকে হত্যা করেছে। একজন অভিজিৎ জন্মায় সিকি শতাব্দীর আগে নয়।

এখনো অভিজিতের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি পাওয়া যাবে অসংখ্য। আমি তার ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বইটি পড়েছি। ও আমাকে এটি এডিট করতে দিয়েছিল। কারণ এটি ছিল সেন্সেটিভ বই। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসের জন্য জিন আর বায়োলজিক্যাল কি ভিত্তি আছে সে তা তুলে ধরেছে বইটিতে। নানা ধরনের বিশ্বাস। মনের ভিত্তিটা কি তা সে ব্যাখ্যা করেছে সেখানে। বায়োলজিক্যাল ভিউ থেকে সে লিখেছিল। এটি কোনো ধর্মীয় বই ছিল না।

সমকামিতার ওপর তার বই বের হয়েছে। সে সমকামিতার বিশ্লেষণ করেছে। কেন দুজন সমলিঙ্গ পুরুষ বা নারী পরস্পরের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তার জীববৈদ্যিক বিশ্লেষণ সে যত্নের সাথে তুলে ধরেছে রেফারেন্সসহ। সমকামিতার মূল ভিত্তি কি তা সে ব্যাখ্যা করেছে।

তার প্রথম বইটি তো অসাধারণ ছিল। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। বড় বড় মনীষী গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিং এসব মানুষের বিষয়ে লিখেছে। বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস তুলে ধরেছে। সে ছিল প্রতিভাবান লেখক। আর এই প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটাল একদল ইসলামী ফ্যানাটিক উন্মাদ। ইসলামের পবিত্র মূল্যবোধকে এই মুর্খরা ধুলায় লুটিয়ে দিল।

তার আরো বিকাশ হতো। কিন্তু তার আগেই তাকে শেষ করে দেওয়া হলো। তবে তার আদর্শ, মুক্তবুদ্ধির চেতনা, সিভিল লিবার্টির চেতনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। এক ধরনের মিথ্যা ইন্টারপ্রিটেশনের ওপর তাকে শেষ হতে হলো।

ওরা সাধারণ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী কোনো গ্রুপ নয়। তারা ফান্ডামেন্টালিস্ট। দুর্বৃত্ত ও অস্ত্রে প্রশিক্ষিত। ‘আমি কাফের-মুরতাদ হত্যা করতে পারলে বেহেশত পাবো’- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ফারাবি প্রকাশ্যে অভিজিৎকে হুমকি দিয়েছে। সে বলেছিল, আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসলেই তাকে হত্যা করা হবে। ফারাবী এই প্রকাশ্য হুমকির সাহস পায় কোথায়? ফারাবির বিরুদ্ধে তখন অ্যাকশন নেওয়া হয়নি। সে অশিক্ষিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যা নিয়ে পড়ত কিন্তু বারবারই ফেল করত। এক সময় তার নাম-যশ কামানোর ইচ্ছে থেকে সে জঘন্য অপরাধে নামে।

অভিজিৎ-এর পড়ার নেশা ছিল সাংঘাতিক। ক্লাসেও জ্ঞানগর্ভ বই খুলে বসত। খেলার মাঠে দেখা যেত সমঝদারের মতো উপভোগ করতে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সামনের সারিতে হাজির থাকত। ধর্ম নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা ছিল না, আর তাতে কোনো গোপনীয়তা ছিল না। সেই স্কুলের নিচের ক্লাস থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে বিতর্ক করত।

ধর্ম, রাজনীতি, বিজ্ঞানের ক্লাসিকাল মৌলিক বিষয়গুলো থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক নানা বিষয়ে তার উৎসাহ ছিল। সাহিত্য, দর্শন, আর্ট, কালচার, ইতিহাস, সংগীত, খেলাধুলা, সমাজবিজ্ঞান যে কোনো বিষয়ের বিশেষজ্ঞের সাথে অন্তত দীর্ঘক্ষণ আলাপ করার মতো জ্ঞান তার ছিল।

লেখক : শিক্ষাবিদ, অভিজিৎ রায়ের বাবা



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়