ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি : খাল কেটে অসন্তোষ ডেকে আনা?

জাফর উল্লাহ সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি : খাল কেটে অসন্তোষ ডেকে আনা?

জাফর উল্লাহ সোহেল : সিরিজের প্রথম টেস্টে অজিদের হাতে নিজেদের মাটিতে ভারতীয়দের নাস্তানাবুদ হওয়ার ঘটনা অনেকে দেখছেন খাল কেটে কুমির আনার মতো বিষয় হিসেবে। স্পিনে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে নিজেরাই ঘায়েল হলো তারা। প্রথম ইনিংসে অজি স্পিনারদের তোপের মুখে ভারত অলআউট হয়ে যায় মাত্র ১০৫ রানে।

১৯৪৮ সালে নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অতি উৎসাহী সমর্থকদের পরামর্শ শুনে এরকমই ভুল করেছিল জিন্নাহ ও খাজা নাজিম উদ্দিন। সম্প্রীতির পাকিস্তান হয়ে যায় বিক্ষোভ আর অসন্তোষের আরেক নাম। অতিরিক্ত উর্দুপ্রীতি দেখাতে গিয়ে বাঙালি তোষামোদকারীদের কথা শুনে শেষ পর্যন্ত গোটা পূর্ব পাকিস্তানকেই হারাতে হয়েছিল পেয়ারে পাকিস্তানের ধ্বজাধারীদের।

উপরের উদাহরণ দুটি দেয়ার উদ্দেশ্য হলো- বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগেও যেন অতি উৎসাহী লোকের অভাব নেই। সরকারের জন্য ‘ভালো করছি ভালো করছি’ জপতে জপতে কখন, কীভাবে তারা ক্ষতিটা করে বসছেন সে খেয়াল নেই। ৫ জানুয়ারির প্রহেলিকা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগ সরকার যখন কিছুটা হলেও গণমুখী উন্নয়ন আর নানা ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দেশবাসীকে একরকম অভ্যস্ত করে এনেছে তাদের শাসনে তখন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে; খুবই স্পর্শকাতর ইস্যুও বলা যায়, সরকারকে একরকম জনগণের মুখোমুখিই করে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে এমন অতি উৎসাহীদের কিছু সিদ্ধান্ত। যেমন এক লাফে গ্যাসের দাম ৩০০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত (৩ মাসের ব্যবধানে দুই ধাপে)।

বাংলাদেশে কী এমন বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, সরকারের জরুরি প্রয়োজন মেটাতে জনগণের ওপর একের পর এক বোঝা চাপিয়ে দিতে হবে? মাত্রই কিছুদিন হলো ব্যক্তিগত কর এবং ভ্যাটের একটা বেড়াজাল তৈরি করা হয়েছে প্রত্যেক নাগরিককে ঘিরে। একান্ত রাস্তার ফকির ছাড়া কেউ এখন আর ট্যাক্সের আওতার বাইরে নেই। এমনকি ফকিরও সরকারকে ট্যাক্স দেয় ভ্যাটের মাধ্যমে। এক কেজি আটা বা এক পোয়া তেল কিংবা ফার্মেসি থেকে দুটো ওষুধ কিনতে গেলেও তাকে ভ্যাট দিয়েই আসতে হয়। এটা ভালো। দেশের উন্নতির স্বার্থে সবাইকে ট্যাক্স দিতে হবে। কিন্তু যাদের ওপর ট্যাক্স আরোপ হলো এবং যত আরোপ হলো, সেটা বাস্তবতার নিরীখে কতটা ঠিকভাবে হয়েছে সে প্রশ্ন কিন্তু উঠেছে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যে ঘোষণা এলো তা অনেকের কাছেই এমন বিষের মতো মনে হচ্ছে যে, একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে হা-হুতাশ শুরু হয়ে গেছে। গত কয়েকদিনের ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো দেখলেই তা পরিষ্কার হয়ে যায়। একেকজনের স্ট্যাটাস এমন, পড়লে মনে হয় যেন দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে যাবে বা মহামারি, মড়ক লেগে যেতে পারে, এরকম কিছু। এসব হয়ত হবে না। তবে জীবনযাত্রায় যে একটা বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত। আর জীবনের চাকায় যদি অচলায়তন সৃষ্টি হয় তা থেকে মনে অসন্তোষের জন্ম হবে না-তা কে বলতে পারে?

এক ফেসবুক বন্ধু বিষয়টা দেখিয়েছেন তার নিজের ঘরের পরিস্থিতি দিয়ে। তার বাসায় চারটা চুলা আছে। মানে ডাবল দুটি। এতদিন তাকে এর পেছনে ব্যয় করতে হত ১৩০০ টাকা। এখন জুন থেকে এক লাফে তা করতে হবে ১৯০০ টাকা। ৬০০ টাকা বাড়তি গুনতে হবে। এরপর এই দামবৃদ্ধির সঙ্গে জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য অনেক কিছুরই দাম বাড়বে। যেমন, গাড়ি ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, খাদ্যদ্রব্য প্রভৃতি। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। তিনি হিসাব করে দেখলেন, মাসে প্রায় ৩-৪ হাজার টাকার বাড়তি ধাক্কা লাগবে তার ওপর। কিন্তু বেতন তো তার এখন বাড়বে না। তাহলে কী করে তিনি সংসার টানবেন?

আরেকজন লিখেছেন, তার বাড়িতে আট-দশটা পরিবার ভাড়া থাকে। গ্যাস ও বিদ্যুত বিল তারই দেওয়ার নিয়ম। এখন এক যোগে যেভাবে দাম বাড়ানো হলো, চাইলেই তো সে হুট করে বাড়িভাড়া বাড়াতে পারবে না। এক চা দোকানি খুব আক্ষেপ করে বলল, ‘ভাই, দেখেন তো সকারের কাণ্ড, এক লগে কি আমগো ইনকাম এত বাড়ে? আমরা তো এমনিতেই টানাটানিতে আছি।’

নানা জনের নানাবিধ রকমের সমস্যা। এক সরকারি সিদ্ধান্তে, একটিমাত্র কলমের খোঁচায় কত মানুষের কত হিসাব গরমিল হয়ে যায় তা কি জানেন সংশ্লিষ্টরা? সুতরাং প্রথমে ১৫০, তারপর ৩০০-এভাবে এটি কিন্তু কয়েকশ টাকার বিষয় নয়; অনেক অনেক জীবনের অনেক অনেক হিসাব এখানে জড়িত। ‘এতদিন ভর্তুকি দিয়েছি, আমাদের সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক যুক্তি আছে’-এসব বললেই যে মানুষ সব মেনে নেবে তা কেবল দূরাশা।

সুতরাং মাননীয় সরকার, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির এই অবাস্তব সিদ্ধান্তটি নেয়ার আগে আপনি কি দেশের জনগণের মনের ভেতরে কী কাজ করছে বা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে চিন্তা করেছেন? মনে হয় না। আপনারা বেশ কয়েকবার গণশুনানি করেছেন। কিন্তু যারা সেখানে গেছেন তারা বলছেন তাদের কথা রাখা হয়নি। তাহলে এই শুনানি করে লাভ কী? শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো ‘শুনানি হয়েছে’ বললেই কিন্তু জনগণ মেনে নেবে না। জনগণ দেখবে- যা কিছুই তার প্রতি সরকারের তরফ থেকে আসুক, তা কতটা সহনশীল, কতটা সে বইতে পারবে সে বোঝা। যদি সে বোঝাটা বইতে না পারে, তবে এর নিচে চাপা পড়ে মরার চেয়ে সে কিন্তু তার সর্বস্ব দিয়ে একটা শেষ ধাক্কা দিতে চাইবে। যা কিন্তু শেষ বিচারে কারো জন্যেই মঙ্গলের হবে না।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নিজেই বলেছেন মাত্র ৩৫-৪০ লাখ মানুষ বাসাবাড়িতে গ্যাস ব্যবহার করেন। তাহলে এই মূল্যবৃদ্ধিতে সরকারের কত টাকা মুনাফা হবে? এর চেয়ে ঢের বেশি টাকা কি চলে যাচ্ছে না দুর্নীতি আর অনিয়মের ছিদ্র দিয়ে? সেইসব ছিদ্র যদি সরকার মেরামত করতে পারে তবে জনগণের ওপর নতুন কোনো চাপ সৃষ্টির চিন্তা করতে হবে না। এক হিসাবে দেখা গেছে, গতবছর গ্যাস বিক্রি করে সরকার ১৬ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে। এই বাড়তি দামে সরকার আরো না হয় ৩-৪ হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করবে, এর বেশি তো নয়? এর চেয়ে বেশি টাকা কি এ দেশের ব্যাংকগুলো থেকে লুট হয়ে যায়নি?

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ এবং এ দেশের মানুষ এমন মন ও মননে দিনে দিনে অগ্রসর হচ্ছে, তাদের কেউ আটকে রাখতে পারবে না। বৈশ্বিক অর্থনীতির বিশ্লেষকরা যেভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন বাংলাদেশকে নিয়ে, আমার ধারণা, তার চেয়েও ভালো করবে বাংলাদেশ। এবং তা করবে, যদি দেশে সুশাসন থাকে এবং একটা স্থিতিশীল পরিবেশ থাকে। সেই পরিবেশটা নিশ্চিত করা এখনকার সরকারের জন্য মোটেও কঠিন কাজ নয়। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে কীভাবে বরং পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়, মনে হচ্ছে সেই দিকেই যত নজর সরকারের ভেতরের কারো কারো। না হলে এমন গণবিরোধী সিদ্ধান্ত একেবারে হেসে হেসে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর মুখ থেকে বের হওয়ার কথা নয়। সরকার এবং সরকারি লোক যত যুক্তিই দিক না কেন, খোদ আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক এই সিদ্ধান্তের পক্ষে নেই, এটা জোর গলায় বলা যায়। এ ব্যাপারে দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে জরিপ করা যেতে পারে।

একজন ফেসবুকবন্ধু এবং গণমাধ্যমকর্মী সম্প্রতি হিসেব করে দেখিয়েছেন, গ্যাসের দাম বরং কমানো উচিত ছিল সরকারের। এখানে নিশ্চিতভাবেই কোন একটা পক্ষকে, একটা গোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দিতেই এমন কঠিন সিদ্ধান্তের ঝুঁকি নিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। আমি বলব না, এটা সরকার করেছে বরং বলব সংশ্লিষ্ট বিভাগই এটি করেছে। এর পেছনে কারা আছে, কাদের স্বার্থটা বেশি কাজ করেছে তা খুঁজে বের করা দরকার। এর একটা বিচার বিভাগীয় তদন্তও করা যেতে পারে। শোনা যাচ্ছে, কনজিউমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ‘ক্যাব’ সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবে। সাধারণের জন্য সেখান থেকে নিশ্চয়ই ভালো কোনো সিদ্ধান্ত আসবে।

মুরুব্বিরা প্রায়ই বলেন, ‘দেখিস, পচা শামুকে যেন পা না কাটে’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেও বিনয়ের সুরে বলতে চাই, এমন কোনো সিদ্ধান্তে সায় দেয়া উচিত হবে না, যা আদতে সরকারের বিপক্ষে গণ-অসন্তোষ ডেকে আনতে পারে। এবং যে সিদ্ধান্ত থেকে সরকার সেই অর্থে খুব একটা লাভবানও হবে না। শেষ বিচারে আপনি যা কিছু করছেন তা তো জনগণের উন্নয়নের স্বার্থেই; সেই উন্নয়ন করতে গিয়ে যদি জনগণের ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে শেষ বিচারে তা সরকারেরই ক্ষতি। বিবেচনার সময় কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়