ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

লায়ন : উপমহাদেশকে দেখার পশ্চিমাদের পুরোনো চোখ

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৬, ৪ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লায়ন : উপমহাদেশকে দেখার পশ্চিমাদের পুরোনো চোখ

লায়ন সিনেমার পোস্টার

রুহুল আমিন : পর্দা নামল অস্কারের ৮৯ তম ঝলমলে আসরের। এবারের অস্কার বহুদিন মনে রাখবে বিশ্বের কোটি কোটি সিনেমা পাগল মানুষ। কারণ এবারই প্রথম এক সিনেমার পুরস্কার আরেক সিনেমার নামে ঘোষণা করা হয়েছিল। অস্কারের এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে অন্য দিন বলা যাবে। আজ গার্থ ডেবিস পরিচালিত লায়ন সিনেমাটি নিয়ে কিছু কথা বলব।

‘লায়ন’ সিনেমাটি এবারের অস্কারের ছয়টি বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিল। তবে কোনো বিভাগেই অস্কার পায়নি। অবশ্য তাতে খুব একটা খারাপ লাগেনি। কারণও আছে। ২০০৯ সালে ড্যানি বয়েল পরিচালিত স্লামডগ মিলিয়নিয়ার সিনেমার কথা মনে থাকলে কারণটা আরো সহজ হবে। স্লামডগ মিলিয়নিয়ারে মুম্বাইয়ের জুহু বস্তির একটি ছেলের কাহিনি নিয়ে নির্মিত। কাহিনি যেহেতু মুম্বাইয়ের বস্তির ছেলে তাই শুটিংও করা হয় বস্তিতেই। ওই কাহিনি বানাতে গিয়ে মোটামুটি বস্তির জীবনের চারদিকই দেখিয়েছিলেন ড্যানি বয়েল। দেখিয়েছিলেন ছোট ছোট বাচ্চাদের ধরে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানোর জন্য কত নৃশংসতা অবলম্বন করা হয়। স্লামডগ মিলিয়নিয়ার ১০ বিভাগে মনোনয়ন পেয়ে ৮টিতে অস্কার জিতেছিল। স্লামডগ অস্কার জেতার পর উপমহাদেশের সিনেমা পাগল মানুষ বেশ গর্বিতই বোধ করেছে বলে মনে হয়। যদিও সিনেমাটি ভারতীয় না। কিন্তু ওই কাহিনি গড়ে ওঠেছে ভারতে। এতেই আমাদের প্রশান্তি ছিল।

‘লায়ন’ সিনেমাও এর ব্যতিক্রম না। তবে লায়ন সিনেমায় তথাকথিত বস্তি না দেখালেও নিম্নবিত্ত জীবনের ছবি দেখানো হয়েছে। যা দেখলে বোঝা যায়, আশ্রয়হীন জীবনই গল্পের উপজীব্য। একটি হারিয়ে যাওয়া ছেলের কাহিনি নিয়ে নির্মিত হয়েছে লায়ন সিনেমা। লায়ন আত্মজৈবনিক সিনেমা। অস্ট্রেলীয় ব্যবসায়ী সারু ব্রিয়ারলির আত্মকথা ‘আ লং ওয়ে হোম’ অবলম্বনে তৈরি হয়েছে লায়ন সিনেমাটি। বিংশ শতাব্দির শেষের দিকে ভারতের মধ্য প্রদেশের খান্দোওয়া শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারের পারিবারিক গাঢ় আবেগ অনুভুতিতে শুরু হয় কাহিনি। তিন ভাইবোন ও মাকে নিয়ে পারিবারিক আবহ থেকে কাহিনি বিস্তার লাভ করে।

বড় ভাই গুড্ডুকে নিয়ে চলন্ত মালবাহী ট্রেন থেকে কয়লা চুরি করে দুধ নিয়ে বাসায় ফেরে সারু। তারপর একদিন গুড্ডুর সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে হারিয়ে যায় সারু। ভুল করে ট্রেনে ওঠে খান্দোওয়া থেকে চলে আসে কলকাতায়। কলকাতায় এসে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে এতিমখানা তার ঠিকানা হয়। স্লামডগ মিলিয়নিয়ারের মতো খারাপ লোকদের খপ্পরেও পড়ে সারু। এতিমখানা থেকে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সারুর উচ্চারণে সমস্যা থাকে। তা ছাড়া বয়স কম থাকায় শুধু এলাকার নাম বলতে পারে, তাও অশুদ্ধ। কোন প্রদেশ, কোন জেলা কিছুই বলতে পারে না সে। অবশেষে তাকে দত্তক নেয় অস্ট্রেলিয়ান এক দম্পতি। ওই দম্পতি সারু ছাড়া আরো এক ভারতীয় ছেলেকে দত্তক নেয়।  সেখানেই সারু বেড়ে ওঠে। তারপর একদিন তার শেকড়ের কথা মনে পড়ে। ছেলেবেলায় বড় ভাই গুড্ডুর সঙ্গে কাটানো বিভিন্ন মুহূর্তের কথা মনে পড়ে। তারপর গুগল আর্থের মাধ্যমে অনেক খোঁজাখুঁজি করে তার গ্রামের খোঁজ পায় সারু। এরপর সে ভারতে এসে খোঁজে বের করে তার মাকে। এসে জানতে পারে তার ভাই গুড্ডু ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। তার মার বিশ্বাস ছিল সে ফিরে আসবে তাই কোনোদিন এলাকা ছেড়ে যায়নি। এক আবেগঘন দৃশ্যের ভেতর দিয়ে ছবি শেষ হয়।

ছোট সারুর চরিত্রে অভিনয় করেছে মুম্বাইয়ের শহরতলির এক বস্তির ছেলে সানি পাওয়ার। আর বড় সারুর চরিত্রে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ অভিনেতা দেব প্যাটেল। সিনেমাটিতে আরো অভিনয় করেছেন নিকোল কিডম্যান, ডেভিড ওয়েনহামসহ অনেকে। ছোট একটি চরিত্রে নওয়াজ উদ্দিনসহ মোট চারজন বাঙালি সিনেমাটিতে অভিনয় করেছেন।

পশ্চিমারা তাদের চোখ দিয়েই উপমহাদেশকে বারবার দেখেছে। তার প্রমাণ যেমন স্লামডম মিলিয়নিয়ারে ছিল, লায়নেও সে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এই অবস্থা তৈরির কারণ কখনো অনুসন্ধানে আসেনি তারা। কারণ অনুসন্ধানে নামলে তাদের ভূমিকাও যে চলে আসবে। তাই তো উপমহাদেশের ফুটপাতের জীবন, অসহায় মানুষের জীবন, সমাজের পিছিয়ে পড়ারা বারবার তাদের সিনেমার উপজীব্য হয়েছে। বৃটিশ শাসনের এতো বছর পরও তাদের ভিন্ন আঙ্গিকে উপমহাদেশকে দেখার সুযোগ হয়নি। গল্প বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে খুব সচেতনভাবেই এটা করা হয়। পুরো বিশ্বের কাছে উপমহাদেশের সবচেয়ে নির্মম দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়। সেখানে এখানকার মানুষের কোনো অর্জনের কথা থাকে না। অন্ততপক্ষে বড় আসরে যে সিনেমাগুলো প্রতিযোগিতা করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে তা কখনো হয়নি। দুই শত বছর আগে এখানকার মানুষকে তারা যেমন ওপর থেকে দেখেছে, আজ দুই শত বছর পরও তারা যেন ওপর দিক থেকে আলো ফেলে দেখতে অভ্যস্ত। আর বরাবরের মতো আমরাও যেন তা নিয়েই তৃপ্ত থাকি। আমাদের জীবন শুধু বস্তির ফুটপাত, অনাহার অর্ধহারের অমর্যাদার বৃত্তে যেন বন্দি। এই বৃত্তের বাইরে কখনো আমাদের জীবন বের হয়নি। ঘুরে ফিরে আমাদের পিছিয়ে পড়া, বাদ পড়া মানুষের জীবনই তাদের কাছে বেশি প্রিয়। কারণ আমাদেরকে তারা কখনো এর চেয়ে ভালো অবস্থানে দেখতে অভ্যস্ত নয়। আমরা তো শোষিত, বঞ্চিত, আমরা দাস শ্রেণির। আমাদের এই কারণে শাসন করা সহজ। আমরা আগের মতো এখনো তাই রয়ে গেছি। তাই অবস্থার পরিবর্তন হলেও, যুগ এমনকি শতাব্দি পার হলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এতটুকু পাল্টায়নি। যেন বিপদে পড়া সারুকে পশ্চিম থেকে ফিনিক্স পাখির মতো এক দম্পতি এসে উদ্ধার করে নতুন জীবন দিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের আশ্রয়হীন মানুষের প্রতি উন্নত বিশ্বের মানুষের আচরণের পরিচিত ব্যবহার এমনই। তাই সারুকে দত্তক নেওয়া আমার কাছে পশ্চিমাদের পূর্বের মতো সমকালীন শাসক মনোবৃত্তির হাইলি অ্যাম্বিসিয়াস সিনেম্যাটিক মন্তাজ মনে হয়েছে। পরিচালকরা ওই মনোবাসনা থেকে বের হতে পারেনি। স্লামডগ মিলিয়নিয়ারের জামাল মালিক আর লায়নের সারু একই ‍বৃন্তের দুটি ফুল।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ মার্চ ২০১৭/রুহুল/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়