ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

গণহত্যা দিবস, ইতিহাস যেন অমোঘ হয়ে থাকে

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২৫ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গণহত্যা দিবস, ইতিহাস যেন অমোঘ হয়ে থাকে

|| অজয় দাশগুপ্ত ||

সংসদে সর্বসস্মতভাবে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অনেক বছর পর আওয়ামী লীগের শাসনামলে এ কাজটি হয়েছে বলে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। বড় দুর্ভাগা দেশ আমাদের। এত রক্ত, এত বেদনা, এত কষ্টের ইতিহাস খুব কম জাতি বা দেশের বেলায় দেখা গেলেও আমরা সবকিছু ভুলে যাই। এখন তো মাঝে মাঝে ভাবতেও ভয় হয়, এই সেই সমাজ যেখানে নারীরা থাকতো সামনে। তাদের শক্তি, সাহস আর ত্যাগের কথা জানার জন্য কি খুব বেশী দূরে যাবার দরকার পড়ে? মানলাম বেগম রোকেয়া বা প্রীতিলতা অনেক আগের মানবী। কিন্তু জাহানারা ইমাম তো সেদিনের কাহিনি। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী-পুত্র হারানো এই মহিয়সী মহিলার সারা জীবনের সাধনা ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনরুদ্ধার।

এই দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উদ্ধারেরও প্রয়োজন পড়েছিল! মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলদের মর্মান্তিক বিদায়ের পর এদেশকে জিয়াউর রহমানের দল মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানের ভাব ধারায় চালাতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বনাশ করে ফেলেছিল প্রায়। এক সময় এমন হয়ে গিয়েছিল মনে করা হচ্ছিল এদেশ চলবে ককটেল বা বাংলাস্তানের পথে। এক চিমটি পাকিস্তান, এক খাবলা ভুল ইতিহাস আর রাজাকার পুনর্বাসনের সমাজে ২৫ মার্চ হয়ে উঠেছিল সাধারণ এক ঘটনা। গুটিকয়েক ট্রাক আর দৌড়ে যাওয়া খাকি পোশাকের কিছু সেনা দেখিয়ে তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করার কাজটি চলেছে অনেক দিন। তাদের এও জানানো হয়নি এই সৈন্যরা কি পাকিস্তানি, না অন্য কোনো দেশের? কী সব গোলমেলে কাহিনি! বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ইতিহাসের আগাগোড়া ছেঁটে হঠাৎ ঘোষণার এক অপঘাতে দীর্ন জাতিকে হঠাৎ বেগ দিয়েছে সময়।

সে সময়ের সাহসী সৈনিক শেখ হাসিনা। তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। তাঁর রক্তে আছে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছে এদেশের আসল ইতিহাস। সেখানে পঁচিশে মার্চের গুরুত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে, আজ এই জাতির জীবনপ্রবাহে চেতনা বলে আসলে কিছু নাই। তার একদিকে অন্ধত্ব, আরেকদিকে প্রযুক্তি। সেই প্রযুক্তির হাত ধরে ঢুকেছে বিপজ্জনক সব ঘটনা। এখন ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান সব হাতের মুঠোয়। ভালো যেমন ঢুকছে খারাপও ঢুকছে বন্যার মতো। সে হাওয়ায় আমাদের স্বাধীনতার বিষয়ও পড়েছে তোপের মুখে। মানুষের জীবনে যত দ্বন্দ্ব যত অনিয়ম তার সুরাহা না হলে কি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মনোযোগী হবে? সুশাসনের অভাব দেশের মানুষের সবচেয়ে একটি সমস্যা। ইদানিং মারামারি খুন গুম ইত্যাদি কিছুটা কমে আসলেও শেষ হয়ে যায়নি। সরকারের কিছু মন্ত্রী আমলা আর নেতাদের দাপটে লীগের গায়েও পড়ছে বদ আছর। এমন কোনো নাম নেই যে-নামে লীগের শাখা হয়নি। এই যে বহুপ্রজ লীগ এটা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা ভাবধারার সাথে যায় না।

দেশের মানুষকে একাত্তরের ভাবনায় জাগাতে হলে শান্তিতে রাখতে হবে। চলমান সমস্যা জিইয়ে রেখে তাদের কাঁধে নতুন দিবস চাপালেই কি মুক্তিযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে উঠবে? তারা অপপ্রচার আর অশান্তির ঠ্যালায় দেশের ইতিহাস ভুলে মজে আছে অন্ধ এক মনোজগতে। যার বাহ্যিক উত্তপ্ত উদাহরণ জঙ্গীবাদ। এই জঙ্গীবাদ একদিনে পয়দা হয়নি। কেবল দুনিয়াকে দায়ী করে এর সমাধান পাওয়া যাবে না। এর সাথে দেশের আসল ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি যারা করছে, এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে, তারা আমাদের সমাজ ও উদারতার শত্রু। তারা চায় মাটিকে পরদেশের ধারণায় কাঁপিয়ে পতাকা, সঙ্গীত চিবিয়ে খেতে। সে চক্রান্ত আজকের না। মাঝে মাঝে তার দমকা বাতাসে নিভে যাওয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শিখাটি জ্বালিয়ে রেখেছে এদেশের সাধারণ জনগণ। তাদের বাদ দিয়ে সংসদে আইন পাশ হলেই কোনো দিবস জনমনে ছড়িয়ে পড়বে এমনটা অন্তত আমি ভাবি না।

এত বছর পর গণহত্যা দিবস পালনের সংবাদটি তাই আমাকে খুব একটা প্রলুব্ধ বা আলোড়িত করেনি। এখন মুক্তিযুদ্ধ এমন এক স্পর্শকাতর বিষয় যা নিয়ে কিছু বলাও বিপজ্জনক। খুব সহজে যেমন কাউকে আমরা চেতনার তকমা পরিয়ে দেই, তেমনি সহজেই বানিয়ে ফেলি রাজাকার। আমাদের এক বয়োবৃদ্ধ কবি, যিনি এদেশের বড় ছোট সব পুরস্কার পেয়েছেন, না পেলে কেড়ে নিয়েছেন, নালিশ করে কেঁদেকেটে হলেও বাগিয়েছেন, তিনি তাঁর ধর্মগত পরিচয়ের কারণে নিজেকে স্বাধীনতাবিরোধী আওতার বাইরে মনে করলেও আমাকে ‘রাজাকার’ বলতে কসুর করেননি। সারাজীবন লেখালেখি আর চিন্তা ও যুক্তির কারণে ‘মালাউন’ বা ‘ভারতের দালাল’ গালি শুনতে অভ্যস্ত আমাকেও ছাড় দেননি তিনি। এমন সহ্য ও সবুরহীন সময়ে গণহত্যা দিবস নিয়ে কিছু বলাটা তাই নিরবচ্ছিন্ন সুখের হবে না।

তবু বলি, একাত্তরে ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিস্তৃত নয় মাসে বিরামহীন হত্যা চলেছিল এই দেশে। আসলে কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল সে হিসাব এখনো অজানা। বিএনপি বা জামায়াত এ নিয়ে যত তামাশা করুক বা কূটতর্ক করুক না কেন সে বিভীষিকা ইতিহাসের দগদগে ঘা। তা মানুষের লাশ বা মৃতের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ তা  মনে রাখলেও মানুষ রাখেনি। আজ চারদিকে যেসব ঘটনা যত বিপদ আর ত্রাস তাতে এটা মনে হয় না চেতনা বলে আসলে কিছু আছে।

যেদেশে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একভাবে বাঁচতে পারে না, নানা কারণে মানুষ মরে, লাশ গুম হয়, সাম্প্রদায়িকতাও সন্ত্রাসের শিকার হয়, সেখানে গণহত্যা দিবস কি আসলেই  কোনো প্রভাব ফেলবে?

তবু আশা রাখি। মনে করি, এই সরকার দিবসকে দিবসের বাইরে এনে সঠিক মূল্যায়ন করবে। তা না হলে এটিও একটি দিবসের বাইরে আর কিছুই হবে না। লাখো শহিদের আত্মদানের দেশে মাটি ও মানুষই তার প্রহরী। এটা যেন ভুলে না যাই আমরা। সরকারের সামনে কঠিন সময়। এদেশে যদি সঠিক ও যথাযথ নির্বাচন হয় জিতে বেরিয়ে আসাটা সহজ হবে না। অথচ আওয়ামী লীগের অর্জন বা উজ্জ্বলতা কম কিছু না। তাদের এই আমলে প্রচুর ভালো কাজ হয়েছে। উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট সড়ক খাদ্য বস্ত্র নানা বিষয়ে অভূতপূর্ব উন্নতি দেখছে জনগণ। তারপরও কিন্তু আওয়ামী লীগের ভাগ্য নিরঙ্কুশ কিছু না। অন্যদিকে বিএনপি এখনো ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চালাচ্ছে সমানভাবে। তাদের নেতারা প্রায়ই ২৫ মার্চের শহিদের সংখ্যা নিয়ে শোরগোল করেন। তাদের কেউ কেউ এমনসব কথা বলেন যাতে মনে হতে পারে পাকিস্তানিরা আসলে বেছে বেছে কিছু বাঙালিকে মেরেছিল। বাকীদের তারা জামাই আদরে ছেড়ে দিয়েছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম এই দিনটিকে তাই আইনের আওতায় এনে দিবস হিসেবে ঘোষণা করাটা তাই  শুভ সংবাদ। এখন দেখতে চাই এর প্রভাব আর আন্তরিক জয়যাত্রা। এই দিনটি কালো দিবস বলে চিহ্নিত ছিল এতদিন। এখন তা গণহত্যা দিবস। আসুন সে-দিন সে-রাতে আমরা হাতে হাত ধরে গাই- ‘সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়