ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মাশরাফির জন্য আজীবন থাকুক এমন ভালবাসা

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ৬ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাশরাফির জন্য আজীবন থাকুক এমন ভালবাসা

রুহুল আমিন : অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে বিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে জননন্দিত খেলোয়াড়, দেশের ক্রিকেটের বাঁক বদলের মহানায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। গত ৪ এপ্রিল প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের নিজের ভ্যারিফায়েড ফ্যান পেজে বিদায়ের বার্তাটি দেন। পরে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে প্রথম টি-টোয়েন্টির টসকালে মাশরাফি জানান চলমান সিরিজই তার শেষ টি-টোয়েন্টি খেলা।

মাশরাফির এই বিদায়ে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল বাংলাদেশি ক্রিকেট দর্শকদের মাথায়। স্বাভাবিকভাবে এটা এক বড় ধাক্কা তাদের জন্য। কারণ মাশরাফির মতো খেলোয়াড়ের যেকোনো ফরম্যাট থেকেই বিদায় দর্শকদের মাঝে প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। ক্রিকেটারদের নিয়ে দেশের দর্শকদের এক ধরনের উম্মাদনা আছে। আছে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা। আছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কও। কিন্তু মাশরাফিই বোধহয় একমাত্র খেলোয়াড় যাকে দলমত নির্বিশেষে সবাই ভালবাসেন। এমনকি ক্রিকেট বোঝেন না তারাও অনেকে মাশরাফিকে পছন্দ করেন।

খেলোয়াড় মাশরাফির চেয়ে অনেকগুণ বেশি জনপ্রিয় ব্যক্তি মাশরাফিও। যার কারণে মাশরাফির বিদায়ে বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়াটা স্বাভাবিক। এর মধ্যে অনেকে মাশরাফির বিদায়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রধানের নেপথ্য ভূমিকা আছে বলেও অভিযোগ করছেন। অভিযোগের তীর আছে হাথুরুর দিকেও।

কোচ-বোর্ডর চাপে ক্রিকেটারদের অবসর এই প্রথম না। পুরো ক্রিকেট বিশ্বেই এই নজির আছে। এমনকি বাংলাদেশেও এর নজির আছে। তারপরও মাশরাফি বলে দর্শকরা এতো বেশি রিঅ্যাক্ট করছেন। কিন্তু স্বয়ং মাশরাফির এই ব্যাপারে বক্তব্য কি? আমার মনে হয়ে বাস্তবতার নিরিখে মাশরাফির বক্তব্যটা সাধারণ দর্শকদের সবচেয়ে বেশি করে অনুসরণ করা দরকার। ভাবা দরকার।

শ্রীলংকার বিরুদ্ধে ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলন, কিংবা ফেসবুক ফ্যান পেজে দেওয়া বক্তব্যের কোথাও বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি, বোর্ড কর্মকর্তার প্রতি কোনো প্রকার রাগ অভিমান দেখা যায়নি। বরং তিনি বাংলাদেশের তরুণ ক্রিকেটারদের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছেন। বলেছেন দলের সার্বিক উন্নতির কথা। আর মাশরাফি ব্যক্তিগতভাবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট তেমন পছন্দ করতেনও না। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ দুই ওভারের হলেও জীবন দিয়ে খেলেন ‍তিনি। আর তা যদি হয় দেশের জন্য তা হলো তো কোনো কথাই নেই।

যারা মাশরাফির বিদায়ে আপ্লুত। ব্যথিত, তাদের বলব বাস্তবতা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করতে। একদিন না একদিন তাকে বিদায় নিতেই হত। সারাজীবনতো আর খেলতে পারতেন না তিনি। আর যদি এমন হয় মাশরাফি খেলতে থাকল আর বাংলাদেশ একটার পর একটা ম্যাচ হারতে থাকল। মাশরাফি নিজে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারছেন না। তখন কি হত? যদি ধরে নেই এখন চাপ প্রয়োগ করে অবসরে বাধ্য করা হয়েছে মাশরাফিকে। তবে তখন তাকে অপমান করে অবসরে বাধ্য করা হত।

মাশরাফির অবদান বাংলাদেশ ক্রিকেটে অসীম, অতল। হারর বৃত্ত থেকে দলকে টেনে নিয়ে গেছেন জয়ের সরণিতে। দলের প্রয়োজনে কখনো আবির্ভূত হয়েছেন প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় হয়ে, জুনিয়র-সিনিয়র সব খেলোয়াড়ের জন্য প্রয়োজনে হয়েছেন পরামর্শদাতা। দুঃসময়ে দিয়েছেন অভয়। প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কিভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় তার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দলের অধিনায়ক হয়ে গেছেন কখনো কখনো ব্যক্তি খেলোয়াড়ের দুঃসময়ের অভিভাবক। আর এ সব কারণে মাশরাফি রীতিমতো বাংলাদেশের ক্রিকেটে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। দর্শকরা নিশ্চয় কিংবদন্তিতুল্য মানুষটি সম্মান নিয়ে ক্রিকেট থেকে অবসর নিক এটাই চাইবেন।

মাশরাফির ক্রিকেট দর্শন, ব্যক্তি মানুষের দর্শন আর দলপতি মাশরাফির দর্শনকে কাজে লাগতে পারে যেকোনো ক্রিকেটারের যেকোনো সময়। এমনকি ক্রিকেট বোর্ড চাইলেও কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু মাশরাফিকে তো যেতেই হতো অবসরে একদিন না একদিন। এখন যারা দলে আছে তাদের ওপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে। তাদের সমর্থন দরকার। আর এখন যেমন ভালবাসা পেয়েছেন মাশরাফি, সারা জীবন দর্শকদের এমন ভালবাসাই থাকুক মাশরাফি জন্য বরাদ্দ।

এবার একটু মাশরাফির সাম্প্রতিক খেলা কয়েকটি টি-টোয়েন্টির পারফরম্যান্স দেখা যেতে পারে। সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ও শ্রীলংকার বিপক্ষে খেলেছেন একটি টি-টোয়েন্টি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটির মধ্যে প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিংয়ে ৩ বল খেলে করেছেন ১ রান, আর বোলিংয়ে ৩ ওভার বল করে ৭ দশমিক ৩৩ গড়ে ২২ রান দিয়েছেন। কোনো উইকেট পাননি। দ্বিতীয়টিতে ২ বল খেলে ১ রান করেছেন। আর বোলিংয়ে ৪ ওভার বল করে ৯ দশমিক ৫০ গড়ে ৩৮ রান দিয়ে পেয়েছেনে একটি উইকেট। তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি। বোলিংয়ে ৩ দশমিক ২ ওভার বল করে ১২ দশমিক ৬০ গড়ে ৪২ রান দিয়ে কোনো উইকেট পাননি।

সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি যে ম্যাচে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন তাতে তিনি ৫ বল খেলে ৯ রান করে অপরাজিত ছিলেন। আর বোলিংয়ে ৪ ওভার বল করে ৮ গড়ে ৩২ রান দিয়ে পেয়েছেন ২ উইকেট। মাশরাফি নিজেই সারা জীবন পারফর্ম করে দলে থাকতে চেয়েছেন। আমাদেরও উচিত তার মতো পরিপক্ক ভাবনা ভাবা। এটাতো আর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স দল না যে শুধু অধিনায়ক মাশরাফির মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে। অন্তত দর্শক সারি থেকে এই দাবিকে তখন সমর্থন করা যায়। পারফরম্যান্সের দরকার নেই। সবাই জানে মাশরাফি নিজেই তেমনটা চান না। আমাদেরও উচিত ক্রিকেটীয় বাস্তবতায় ভাবনা চিন্তা করা। আবেগ থাকা জরুরি কিন্তু কখনো কখনো আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হয়। নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

এই মুহূর্তে একটি বিষয় মনে পড়ছে। আজ ৬ এপ্রিল। পাশের বাড়ির মেয়েখ্যাত দুই বাংলার তুমুল জনপ্রিয় মহানায়িকা সূচিত্রা সেনের জন্মদিন। অপ্রাসঙ্গিক তারপরও এখানে সূচিত্রা সেনকে আনলাম এই কারণে যে, সূচিত্রা সেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থাকতেই হঠাৎ অন্তরালে চলে গেলেন। এই কথা সেই কথা অনেক কথা হল। কত গল্প কাহিনী হল। কিন্তু সূচিত্রা জীবিত অবস্থায় আর জনসম্মুখ্যে আসলেন না। সারা জীবনের জন্য দর্শকদের কাছে একটা আক্ষেপ রেখে গেলেন। এমনও তো হতে পারত সুচিত্রার অভিনয় করা পরের সিনেমাগুলো দিয়ে আর দর্শকদের মন জয় করতে পারতেন না। ফ্লপ কিংবা সুপার ফ্লপ হতেন। হওয়াটা তো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। সম্ভাবনার কথা বললাম। কিন্তু সুচিত্রা একটা জায়গায় গিয়ে থেমে গেলেন। তাই মৃত্যুর পরও একই রকম জনপ্রিয় রয়ে গেলেন তিনি।

ঠিক সময়ে থামতে পারাটাও জীবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কখনো কখনো। তাই আমি মনে করি টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফির এই বিদায় খেলোয়াড় মাশরাফিকে নিয়ে আমাদের মানে দর্শকদের মাঝে একটা আক্ষেপ তৈরি কিংবা আপ্লুত করলেও ক্রিকেটের জন্য মাশরাফির জন্য ঠিক হয়েছে। আরেক দিক দিয়ে ভাবলে মাশরাফিও থেকে গেলেন মানুষের ভালবাসায়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ এপ্রিল ২০১৭/রুহুল/আমিনুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়