ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এরদোয়ানের তুরস্ক : টার্নিং পয়েন্ট ।। মার্ক লোয়েন

মার্ক লোয়েন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৮, ১৬ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এরদোয়ানের তুরস্ক : টার্নিং পয়েন্ট ।। মার্ক লোয়েন

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

(কী হচ্ছে তুরস্কে? কী আছে তার ভাগ্যে? তুরস্ককে কোথায় নিতে চাইছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান? এসব জানতে পড়ুন বিবিসির তুরস্ক প্রতিনিধি ও এমি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত সাংবাদিক মার্ক লোয়েনের বিশ্লেষণাত্মক লেখা। আজ থাকছে প্রথম কিস্তি। ভাষান্তর করেছেন রাসেল পারভেজ)

তুর্কিরা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তারা কী ধরনের দেশ চায়। এ লক্ষ্যে গণভোট হচ্ছে। এতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। গণভোটের ফল যাই হোক, বলতে বাধা নেই তুরস্ক বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে আরো। সাংবিধানিকভাবে এরদোয়ান আরো বেশি ক্ষমতার মালিক হতে যাচ্ছেন।

প্রায় শত বছর আগে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক তুর্কি জাতির ভাগ্য লিখেছিলেন নতুন করে। সেই ধারায় সামরিক শক্তি কয়েকবার বাধা হলেও গণতন্ত্রের নামে তুরস্ক চলছে। কামাল আতাতুর্ক যদি আধুনিক তুরস্কের জনক হন, তবে এরদোয়ান হতে যাচ্ছেন উত্তরাধুনিক তুরস্কের জনক।

সাংবিধানিকভাবে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন এরদোয়ান। এ যাত্রায় তিনি বিজয়ীর হাসি হাসবেন- এর পূর্বাভাস পাওয়া গেছে গত বছর জুলাই মাসে, যখন সামিরক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মূলত নতুন করে জন্ম হয়েছে এরদোয়ানের অর্থাৎ এরদোয়ানের তুরস্কের।

এরদোয়ান বলতে গেলে এখন তুরস্কের একনায়ক। যা বলছেন, তাই হচ্ছে। যেমন চাইছেন, তেমন করতে পারছেন। কোথা থেকে পেলেন এই অসীম ক্ষমতা? হ্যাঁ, এরদোয়ান একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ থেকে বদলে গেছেন, বদলে ফেলছেন সব কিছু, নিজের মতো। মার্ক লোয়েনের ভাষায় সেই টার্নিং পয়েন্টের দিকে নজর দেওয়া যাক।

সেই ভয়ংকর রাত। গুলির শব্দে হোটেলের কিছু অতিথি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। কেউ কেউ ভীতসন্ত্রস্ত হলেন। দেখলেন, তিনটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার গর্জন করছে।

২০১৬ সালের ১৬ জুলাইয়ের কথা। রাতের প্রথম প্রহর তখন। মারমারিসের সৈকতে বিশালবহুল অবকাশকেন্দ্র ‘ক্লাব টার্বান’ হোটেল। সেদিন এখানে ছিলেন এরদোয়ান। অবকাশকেন্দ্রের আঙিনায় হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলেন দুই ডজনের মতো তুর্কি কমান্ডো। অটোমেটিক রাইফেল ও গ্রেনেডে সজ্জিত তারা।

তারা এক ব্যক্তিকে খুঁজছেন, হন্যে হয়ে তন্নতন্ন করে অগ্নিমূর্ত হয়ে খুঁজছেন। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন রিসেফ তাইয়েপ এরদোয়ান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। ক্লাব টার্বান হোটেলের সঙ্গে সংযুক্ত একটি ব্যক্তিগত বাড়িতে অবসার যাপনে ছিলেন তিনি।

ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারার রাস্তাগুলো যখন বিদ্রোহী সেনারা বন্ধ করে দিল, সরকারি ভবনগুলোতে বোমা হামলা চালালো, তখন একদল কমান্ডোকে পাঠানো হলো প্রেসিডেন্টকে গ্রেপ্তারের জন্য। এ ঘটনাই ছিল সেদিনের সামরিক অভ্যুত্থানের ক্লাইমেক্স। সেনারা হোটেলে এলোপাতাড়ি গুলি চালাল, গ্রেনেড ছুঁড়ল। বিভৎস চেহারা হলো হোটেলের। নিহত হলেন দুই নিরাপত্তারক্ষী।

কিন্তু তত সময়ে অনেক দেরি হয়ে গেছে। গুপ্তচরের কাছ থেকে আসন্ন বিপদের খবর পেয়েই হেলিকপ্টারে চেপে সরে পড়লেন এরদোয়ান। গেলেন দালামান বিমানবন্দরে। সেখান থেকে জেট বিমানে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে রওনা হলেন। বিমানের পাইলট এমনভাবে মুখোশ পরলেন, যাতে রাডারে দেখা যায় সাধারণ যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন তিনি।

রাত তখন ৩টা। ইস্তাম্বুলে আতাতুর্ক বিমানবন্দরে উত্তাল  সমর্থকদের সামনে এলেন এরদোয়ান। কণ্ঠ মেলালেন সমর্থকদের সঙ্গে।

সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হলো। সরকার, জনতার জয় হলো। ক্ষমতার সীমাহীন চূড়ায় আহরণ করলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

অনেকে, এ রাতকে ‘আধুনিক তুরস্কের পুনর্জন্ম’ হিসেবে চিহ্নিত করলেন। প্রকৃত পক্ষে বলতে গেলে, এ রাতে এরদোয়ানেরই পুনর্জন্ম হলো।

ইস্তাম্বুলে যাওয়ার পথে বিমানে বসে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর উদ্দেশে একটি ভিডিও বার্তা পাঠান এরদোয়ান। এ বার্তায় সামিরক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান তিনি।

দলে দলে লোকজন পথে নেমে এল। সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনতার উত্থানের এ ঘটনায় সামরিক-বেসামরিকসহ প্রাণ গেল ২৬৫ জনের।

 


জনতার মধ্যে কেউ কেউ বিদ্রোহী সেনাদের ট্যাংকের সামনে জীবন বাজি রেখে শুয়ে পড়ে বাধার সৃষ্টি করার প্রয়াস চালাল। অনেকে বসফরাস সেতুতে ছুটল, অভ্যুত্থান চেষ্টাকারীদের রুখে দিতে সমস্বরে ঐক্যের স্লোগান তুলল। এ সবই হলো এরদোয়ানের আহ্বানের পর।

সকাল হতে না হতেই সামরিক অভ্যুত্থান পুরোপুরি ব্যর্থ হলো। ১৬ জুলাই তুরস্কে নতুন সূর্যোদয় হলো। এই হলো এরদোয়ানের সীমাহীন ক্ষমতা লাভের টার্নিং পয়েন্ট।

১৯২৩ সালে প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কের জন্মের পর এই প্রথম কোনো নির্বাচিত শাসকের ডাকে মিলিটারি ট্যাংকের সামনে বুক চিতিয়ে প্রতিরোধ করল তুর্কি জনতা। তবে গত কয়েক দশকে চারবার সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয়েছে, কিন্তু পঞ্চমবার আর হতে দিলেন না এরদোয়ান।

সেদিন এরদোয়ানের ডাকে অন্ধকার ভেদ করে গর্জে ওঠা মানুষ রাজপথ দখল করে। তার নামে স্লোগান দিতে থাকে, তার নামে জয়ধ্বনি তোলে। সেনাদের ট্যাংক, কামান, গুলির সামনে নির্ভয় এক তুর্কি জাতির উত্থান ঘটাতে সক্ষম হন এরদোয়ান। জবাবদিহির ঊর্ধ্বে উঠে যান এ তুর্কি শাসক।

তুর্কি জাতির জনক কামাল আতাতুর্কের পর তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশীল শাসক এরদোয়ান। তার জন্য সামরিক অভ্যুত্থানকারীদের রুখে দেওয়াই যথেষ্ট অর্জন ছিল না।

তাহলে কী চাইছিলেন এরদোয়ান? তিনি টানা ১১ বছর তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, ২০১৪ সালে হলেন প্রেসিডেন্ট। এই পদে তিনি খুশি নন। শুনতে বড় হলেও তুরস্কে প্রেসিডেন্ট পদটি বলতে গেলে নির্বাহী ক্ষমতার বাইরে। নামকাওয়াস্তে আনুষ্ঠানিক ও উদযাপনমূলক পদ এটি।

তুরস্কের এই প্রতাপশালী রাজনীতিকের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন সাংবিধানিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার পালা বাড়ানো। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই তার শেষ লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে প্রধানমন্ত্রী পদ বিলুপ্ত হবে। তুর্কি সরকার ও রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা হবেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো কিছুটা। তবে সরকারের বিভিন্ন পদে নিয়োগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের যে জবাবদিহি রয়েছে, এরদোয়ানের বেলায় তেমন থাকবে কি না সন্দেহ আছে। যাকে যেখানে খুশি, রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে বসিয়ে দেওয়ার মতো হলে, একনায়ক বলে যা হয়, তার ষোলকলাই পূর্ণ করবেন এরদোয়ান। ১৬ এপ্রিল গণভোটে এর এসপার-ওসপার হবে।

এরদোয়ানের একক ভাবমূর্তির ওপর ভরসা করেই গণভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তার সঙ্গে রয়েছে জাতীয়তাবাদী রক্ষণশালী জনতা। সাম্প্রদায়িক সমস্যা থাকলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলিমরা তার পাশে রয়েছে। 

নানামুখী সমস্যায় রয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য সন্ত্রাসী হামলা ও অর্থনীতির চাকা মন্থর হয়ে পড়া। মত প্রকাশের ওপর চরম দমন-পীড়নের অভিযোগ রয়েছে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে। কয়েক ডজন সাংবাদিক কারাগারে রয়েছে। এ ছাড়া ৩০ লাখের মতো শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে তুরস্কে।

ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার লোককে। দেশটির ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হওয়ার স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছে ইইউ। এবং বিশ্ব প্রেক্ষাপটে যেকোনো সময়ের চেয়ে তুরস্ক বর্তমানে আরো বিচ্ছিন্ন।

তবে এসবের মধ্যে নতুন শতাব্দীতে এরদোয়ানের শাসনামলে তুরস্ক বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে। ব্যাপকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হয়েছে। এরদোয়ানের নেতৃত্বে লাখ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পেয়েছে।

স্কুল, হাসাপতাল, রাস্তা, বড় বড় স্থাপনা তুর্কিদের জীবন যাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। একটি শ্রেণিকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হয়েছেন এরদোয়ান। ছ্দ্মবেশী এলিটতন্ত্র ভেঙে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে অন্তজ শ্রেণি। এক সময়ের মহাপরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে তুর্কিরা।

এসব সাফল্য সামনে রেখে গণভোট দিয়েছে এরদোয়ানের সরকার। বিরোধীদলগুলোর দাবি, কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন এরদোয়ান। শেষ পর্যন্ত কী হবে এরদোয়ানের আর কিইবা হবে তার স্বপ্নের তুরস্কের?

এখন জনতার রায়ের অপেক্ষা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ এপ্রিল ২০১৭/রাসেল পারভেজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়