ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

মঙ্গল শোভাযাত্রা যেভাবে শুরু

মাহবুব জামাল শামিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:১০, ১৭ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মঙ্গল শোভাযাত্রা যেভাবে শুরু

|| মাহবুব জামাল শামিম ||

১৯৭৯ সাল। স্বাধীন দেশ নিজের হাতে গড়তে হবে আমরা এমন তাড়নায় কাতর ছিলাম। তাড়না থেকেই শিল্পাচার্যের আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম। অফিস-আদালত, বইপত্র, পণ্য সামগ্রীর মোড়ক, সাইনবোর্ড সবখানেই দেখি ইংরেজির ব্যবহার। আর্ট কলেজের শিল্পীরা হৃদয় নিংড়ানো আবেগে পথে পথে আলপনা আর দেয়াল রাঙিয়ে বাংলা ভাষার মহিমার গান, কবিতা লিখছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে পথে যত্র-তত্র সাংস্কৃতিক কর্মীদের জাতিসত্তার চেতনার রগরগে অনুষ্ঠানে সয়লাব। নাট্যকর্মীরা মজমা বসিয়ে লোক হাসিয়ে পথনাটক করছেন। সব শাখার সাংস্কৃতিক কর্মীদের আবেগময় অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে শিল্পীমন তেতে উঠেছিল। ভাবছিলাম, বাংলা ভাষা আর বাঙালি নামের পরিচয় প্রতিষ্ঠা না হয় হলো কিন্তু আমাদের জীবনচর্চায় বাঙালিয়ানা আর বাঙালির রঙিন সাংস্কৃতিক চর্চা, উৎসব পার্বণ, আনন্দ উচ্ছ্বাস, রঙ্গ রসিকতা, লোক ঐতিহ্যের নাট্য, নৃত্য, গীত, বাদ্য, নকশা, পুতুল, চিত্র, ভাস্কর্যের সেইসব হারানো ধন কী করে ফিরে পাব?
ভাবাবেগে মন উথলে উঠেছিল। মন খুঁজে ফিরছিল চিরপুরাতনের মাঝে নতুন কাঙ্ক্ষিত পথের ছবি। এরমধ্যেই চলে এলো একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৮০ সাল। প্রভাতফেরিতে লক্ষ মানুষের সাথে ফুল হাতে চলছিলাম। কল্পনার ভাবাবেগে একুশের শ্বেতশুভ্র গম্ভীর করুণ রসের প্রভাতফেরি কল্পনার রঙিন পোষাকে সাজিয়ে, নানা ভঙ্গিমায় বাদ্যের তালে তালে নাচিয়ে, ঐতিহ্যের নানা শিল্প আঙ্গিকে সাজাচ্ছিলাম মনে মনে। সংগত ফিরে পেলে উল্লসিত হয়ে উঠি- যেন মহা আনন্দের উৎসব পেয়ে গেছি। একুশের পথে সেদিন মননে রচনা হয়ে যায় আজকের এই মঙ্গল শোভাযাত্রার অঙ্কুর। ভাষার সাথে জীবনচর্চায় রঙিন ঐতিহ্য ও কৃষ্টি ফিরে পাওয়ার পথ। এরপর দেরি না করে নাচের ড্রইং শেখার অজুহাতে বাফা নৃত্যকলায় ভর্তি হয়ে যাই। নৃত্যের তাল বাজলেই যেন মাতাল দশা হয় আমার। এদিকে চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগে ছাত্র হওয়ায়, পুতুল, মুখোশ, পাপেট, মাপেট- লোকশিল্পের সাম্রাজ্যে সাচ্ছন্দে প্রবেশের সব দরজা খুলে যেতে থাকে। তীব্র হতে থাকে কল্পনার সেই উৎসব রচনার তাড়না। খুঁজতে থাকি আর প্রতি পদে কুড়িয়ে নিতে থাকি উৎসবের আঙ্গিক।

বাংলা একাডেমির মেলায় সহপাঠী মোকলেসুর রহমান ও হিরন্ময় চন্দের সাথে ঘুরছিলাম। এক তরুণ তার ছোট্ট দল নিয়ে অদ্ভুত দক্ষতায় ঢোল বাজিয়ে তাৎক্ষণিক রচিত গান নেচে-গেয়ে মেলাপ্রাঙ্গণ মাতিয়ে, কোথা থেকে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমরা সমস্বরে বলেছিলাম, এই তো পথ!
প্রথম এশিয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেওয়া বিদেশি শিল্পীরা চারুকলা ইনস্টিটিউট পরিদর্শনে আসছেন। দুই সারি ছাত্রছাত্রীর মাঝ দিয়ে ব্যান্ডের তালে তালে তারা অঙ্গণে ঢুকছেন। তুরস্কের এক নারীশিল্পী হঠাৎ নেচে উঠলেন। সে নাচ আনন্দ উচ্ছ্বাসে সবার মনে ছড়িয়ে গেল। মন জানলো এই তো পথ। সেদিন চারুকলার সিনিয়র ভাই আজিজ শরাফি, জুইস, জেবা, নিসার হোসেন, শিশির ভট্টাচার্য্য মুকুট তৈরি করে বিদেশি অতিথি শিল্পীদের মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালির চির প্রাচীন মুকুট নতুন আঙ্গিকে খুব মনে ধরেছিল। সঞ্চিত রেখেছিলাম মনে যতনে। মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রথম আইটেম হিসেবে পরে ব্যবহার করেছিলাম এই মুকুট। হঠাৎ ফিরে তাকাই শৈশবে, ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে দেখি সবই আছে সেখানে। সচেতনে অবচেতনে সেখান থেকে তুলে নিয়েছি যা কিছু প্রয়োজন। মঙ্গল শোভাযাত্রা তাই দিয়ে সাজিয়েছি আমরা সবাই।

চৈত্র উৎসবে বালাকি নৃত্য-গীত দলের ফেন্টাস্টিক ফেইস পেইন্টিং, সাজসজ্জা, রঙ্গ তামাসা আমার শিশু মন রাঙিয়ে দিয়েছিল। নড়াইল, ফরিদপুর, খুলনার গাজীর পটের অদ্ভুত কল্পিত ইমেজ, আমাদের সুন্দরবন অঞ্চলের বাঘ কুমিরের রাজ্যে গাজী কালু ও বন বিবির কাহিনি আজও আমার মনজুড়ে আছে। এখান থেকেই বাঘসহ নানা ধরনের মুখোশ শোভাযাত্রায় যুক্ত করেছিলাম। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ছাড়াও আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সবারই বিচিত্র শোভাযাত্রা আছে। তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে ৬০-এর দশকে আমার শৈশবে মুসলমানদের মহররম এক পূর্ণাঙ্গ সামাজিক উৎসব হিসেবে দেখেছি। শহরের প্রতিটি মহল্লায় একটি করে দল গঠিত হতো। মহররম মাস এলে মহল্লায় মহল্লায় চান তারা আঁকা ত্রিকোণ আকৃতির নানা রঙের পতাকা উড়তো।
এক সপ্তাহব্যাপী প্রতিটি মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় ধারাবাহিকভাবে শতাধিক দল পারফর্ম করে যেত। আমরা শিশুরা সারা দিন কোনো না কোনো দলের বৈচিত্র্য উপভোগ করতাম। ঢাক ঢোল, কর্নেট বাঁশি বাজিয়ে বীরবিক্রমে লাঠিখেলা, তরবারি যুদ্ধ, লাঠি ঘুর্ণন, নানা রকম কসরতের অদ্ভুত দক্ষতা প্রদর্শন সবাইকে মুগ্ধ করতো। বাঙালির লাঠি খেলার ঐতিহ্য একটু আরব্য- পার্সিয়ান অভিব্যক্তি উন্মাদনা মাখিয়ে উপস্থাপন করা হতো। শেষের দিন সন্ধ্যায় শতাধিক দল রঙিন তাজিয়া বানিয়ে নানা রঙের পতাকা ও বাদ্য নৃত্যের মুর্ছনায় আগুন ঘূর্ণি ঘুরিয়ে মুখ থেকে কেরোসিনের আগুন নিক্ষেপ করে আঁধারে আলোর বিচ্ছুরণ তৈরি করতে করতে শহর প্রদক্ষিণ করে এগিয়ে যেত। যশোরের কারবালা নামক স্থানে এসে মহররম কার্নিভালের সমাপ্তি টানা হতো। উৎসবপ্রিয় সাথিরা আপনাদের শৈশবে স্ব স্ব অঞ্চলের আরো কত না রঙ্গকাহিনি দেখেছেন তাই না? দয়া করে লিখবেন। উৎসব আর্কাইভে পাঠাবেন সেই অভিজ্ঞতা।

আমাদের হিন্দু সমাজে বারো মাসে তেরো পার্বণ। দুর্গা পূজার মেলা, ঢাক গুড়গুড় ডাইডা ডাডাং বাদ্যের মুর্ছনায় রঙিন প্রতিমারা সবার মনের আঙিনায় উদ্ভাসিত। মেলায় হরেক রকম শখের হাড়ি, মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, নানা খেলনার রঙিন সাম্রাজ্যে হরেক রকম বাঁশির শব্দ আনন্দ বিস্ময় হয়ে আজও আমার প্রাণে লেগে আছে। এখান থেকেই ঢাক ঢোল, সানাই আর খেলনার জগৎ মঙ্গল শোভাযাত্রায় যোগ করেছি।  নৌকায় সারিগানের সহজিয়া নৃত্যগীত মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য খুব উপযোগী মনে হয়েছিল। শোভাযাত্রায় সেই নৃত্য যুক্ত করতে প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম।
আগেই বলেছি, ১৯৮৩ সালে বাফায় নাচের জগতে মিশে গিয়েছিলাম। সহপাঠী সাজু আহমেদ (আজকের কথক নৃত্য গুরু) শিক্ষক ও বাফার নৃত্যশিক্ষক প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী এনায়েত কবিরকে সাথে নিয়ে ভেবেছিলাম ঢাকার সকল নৃত্য বিদ্যালয়, নাট্যদল আর চারুকলা ইনস্টিটিউটের সম্মিলনে একটা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা যায় কিনা। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সে পরিকল্পনা তখন থেমে যায়। এক অর্থে ভালোই হয়েছিল। উৎসব চিন্তাটি আরো সুগঠিত, পরিণত হয়ে বাঙালির বর্ষবরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা আজকের এই রূপ মঙ্গলকর হয়েছে সব অর্থেই।

আর্ট কলেজ শেষ করে ফিরে যাই যশোর। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিল্পের চর্চা ও গবেষণার প্রসার ঘটিয়ে উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যশোর শহরে ‘চারুপীঠ আর্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করি। ১৯৮৫ সালে যশোর শহরের মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের পুরনো ভবনে চারুপীঠের প্রথম কর্মসূচি, শিশুদের ছবি আঁকার স্কুল শুরু করা হয়। সম্পূর্ণ অবৈতনিক, রং, ব্রাশ, পেন্সিল, কাগজ, ক্রেয়ন, কাদামাটি সমস্ত শিক্ষা উপকরণ ফ্রি থাকায় চারুপীঠের এই স্কুল তিনশ শিশুতে ভরতে সময় লাগলো না। স্কুল জমে উঠতেই চলে এলো একুশে ফেব্রুয়ারি।
প্রভাতফেরিতে নিতে হবে শিশুদের। সবার মতো শুধু ফুল হাতে তো যাওয়া চলে না। বর্ণাঢ্য, দৃষ্টিকাড়া, মনমাতানো শোভাযাত্রার আদলে চারুপীঠের শিশুরা শহিদ মিনারে চললো। যেই দেখছে মুগ্ধতায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, এমনভাবেই তো যাওয়া উচিত। চারুপীঠের প্রথম অনুষ্ঠান প্রভাতফেরি থেকে ফিরে সবাই উচ্ছ্বসিত। আমার সহযোদ্ধা শিল্পী হিরন্ময় চন্দ বললেন, পহেলা বৈশাখ কীভাবে করা যায় শামিম ভাই?
উত্তর ছিল একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। ঐতিহ্যের সব শিল্পমাধ্যমে সাজানো হবে এই শোভাযাত্রা। আর কোনো আলাপের প্রয়োজন হলো না। হিরন্ময় বসে গেলেন শিল্পী ইসতিয়াক হোসেন, শিল্পী রাওফার রহিম, রুমি, শুভাশিষ, শিপু, শহীদুলসহ অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে রাজসিক সব মুকুট আঁকতে। আমাদের ছোট্ট ছাত্র শামিনুর রহমান পাখি, ফুল, প্রজাপতি, পরি বানাতে দক্ষ। সে সাহিন, লিটু, সহেলিদের বিরাট দল নিয়ে বসে পড়লো কাজে। আর আমি নতুন উৎসবের সামগ্রিক রূপগঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। লোক ঐতিহ্যের নৃত্য, বাদ্য দৃশ্যমান শিল্পের সব আঙ্গিককে মেলাতে হবে এ উৎসবে। ঋষিপাড়া থেকে ঢাকঢোল, সানাই বাদক দল আনি। বাদ্যের তালে তালে তিনশ ছাত্রছাত্রীকে এক মাস ধরে উৎসব নৃত্যের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। হিরন্ময় তাদের কস্টিউম পরিকল্পনা করছেন। আমাদের ছোট্ট প্রাজ্ঞ ছাত্র গোলাম দস্তগির সম্ভ্রান্ত শিল্পপতি পরিবারের সন্তান। সে সব কাজে সহায়তা করছে।
আমরা ভাবনায় বিভোর ঐতিহ্যের কোন কোন আঙ্গিকে মেলাবো এই উৎসব। মুকুট, মুখোশ, যশোরের শালিখার ঐতিহ্যবাহী শোলার পুতুল, পাখা, মাটির পুতুল কতো কী রয়েছে লোক ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে। শুরু হলো শেকড়ের সন্ধানে যাত্রা।

এতকাল মঞ্চে কয়েকজন নৃত্য-গীত করেছেন, বাকি সবাই দর্শক। তা তো আর নয়। আমাদের এ নতুন উৎসবে সবাই শিল্পী, নায়ক-নায়িকা, রাজা-রানী, রাজকুমার-রাজকুমারী, ফুলপরি, পাখি- যা ইচ্ছা তাই। অপরূপ সাজে কৌতুক উল্লাসে নাচবে, গাইবে, পারফর্ম করবে, ঢাক সানাইয়ের সুর তালে আপ্লুত বৃদ্ধ-জোয়ানেরাও শিশু-তরুণ হয়ে জেগে উঠবেন, নেচে উঠবেন। এ উৎসব যাপিতজীবনে সব শিল্পের চর্চা প্রতিষ্ঠা করবে- এই হলো ভাবনা।
১৩৯২ সনের পহেলা বৈশাখ। আলো না ফোটা ভোর, যশোর পুরনো কলেজ প্রাঙ্গণে চারুপীঠের পলাশ মস্কন্দের আঙিনায় তিনশ শিশু ও একশ তরুণ মিলিত হয়েছে। অপরূপ রঙিন মুকুট পরেছে রাজকুমার, রাজকুমারী, পরী, ফুল, প্রজাপতি, ময়ূর, টিয়া কত না রূপ ধরেছে! বাঘ, দৈত্য, ভূতের মুখোশেরা যেন মুচকি হেসে হাউ মাউ বলে ভয় দেখাচ্ছে। নানা ভঙ্গীমার বিচিত্র রঙের বিস্ময় জাগানো মুখোশেরা তামাশা করছে সবার সাথে। রঙিন পোশাকে রাঙিয়ে গিয়েছে সমস্ত অঙ্গন। হঠাৎ বেজে উঠলো সানাই, বাড়ি পড়লো ঢাক, ঢোল, কাশি, ঝাঝরিতে। দুই মাসের তপস্যায় রাঙানো, সুরে তালে নৃত্যের ছন্দে সাজানো মনগুলো একসঙ্গে বেজে উঠলো। সারিবদ্ধ হয়ে শিশুরা নেচে উঠল রূপে-অপরূপে নানা ভঙ্গিমায়। জ্বলে উঠলো হিরন্ময়ি পোশাকের ঝকমারি। তখন এমন অনুভূতি হয়েছিল যেন স্বর্গ থেকে অঝোরে নামলো আনন্দ বৃষ্টিধারা। ভোর ছটায় যশোরের নীরব শীতল প্রভাতে, শিশির ভেজা পথে আনন্দ কৌতুক উচ্ছ্বাসে বিস্ময়কর রং ছড়িয়ে বাদ্যের তালে তালে নৃত্যের উচ্ছ্বলতায় শোভাযাত্রা এগিয়ে চললো পথ থেকে পথে। আনন্দের এই বর্ষণধারা আর যেন শেষ হয় না। শহর প্রদক্ষিণ করে এসে চারুপীঠে থামার কথা, কিন্তু থামলো না। চলতে থাকল ক্লান্তিহীন। পূর্ব থেকে ফিরে পশ্চিমে, উত্তর দক্ষিণে দূর থেকে দূরে যেন ছড়িয়ে গেল দেশ থেকে দেশান্তরে এমনি অনুভূতি হয়েছিল সেদিন।

এমন সুন্দর আয়োজনে কেন সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয়নি এই আক্ষেপ নিয়ে আসলেন যশোর উদীচী থেকে এডভোকেট কাজী শহীদ লাল। এরপর নানা সংগঠন থেকে অংশগ্রহণ না করতে পারার আক্ষেপ আসতে থাকে। তখন সিদ্ধান্ত হলো পরবর্তী বছর থেকে যশোরের সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে সম্মিলিতভাবে বর্ষবরণকে সামাজিক উৎসবে রূপদান করা হবে। আমাদের কর্মীরা দলে বিভক্ত হয়ে লোক ঐতিহ্যের সম্ভ্রান্ত অঞ্চলগুলো ভ্রমণ করতে শুরু করল। শালিখার শোলার শিল্প, দৌলতপুরের মাটির পুতুল, নড়াইলের পুতুল ও মৃৎশিল্প। সারা বছর ধরেই পরিকল্পনা চললো, উৎসবের মেনিফেস্টো লেখা হলো। অর্থাৎ ১৩৯৪- এর বৈশাখের অনেক আগেই বর্ষবরণ শোভাযাত্রার কাজ শুরু করলাম। হাজার হাজার মুকুট আঁকা, শোলার পাখায় রঙিন নকশা আঁকা  মুখোশ তৈরি ও রাঙানোসহ নানা ছোট-বড় উপকরণ তৈরির রেওয়াজ শুরু হলো। শত শত শিশুকিশোর আঁকিয়েদের নকশায় দক্ষ করার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন একসাথে নতুন বছর যাতে বরণ করতে পারে এজন্য ‘যশোর বর্ষবরণ পর্ষদ’ গঠন করা হলো। বর্ষবরণ শোভাযাত্রাকে চারুপীঠের ব্র্যান্ডিং না করে সবার মিলিত আয়োজন বলা হলো যাতে দেশের প্রতিটা অঞ্চল ও প্রতিষ্ঠান এই উৎসবকে নিজের উৎসব বলে গ্রহণ করে নেয়। যশোরের গৌরবময় ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠান যশোর ইনস্টিটিউট। চারুপীঠের অভিনব উৎসব কর্মসূচিগুলো সামাজিক রূপদানে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে মিলিয়ে দিচ্ছিল। আর উৎসবের সমস্ত কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র ছিল এই প্রতিষ্ঠান। এমন মাতৃক্রোড় পেয়েছিল বলেই মঙ্গল শোভাযাত্রা দ্বিতীয়বারের আয়োজনেই মহামিলনের সামাজিক উৎসব হয়ে উঠতে পেরেছিল।

যশোরে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা । ছবি : সংগৃহীত


১৩৯৪-এর প্রথম সকালে যশোরের সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলনে সাড়ে তিন হাজার মানুষের শোভাযাত্রা এগিয়ে চলল শহরের পথে। সব দলের নিজস্ব সাজসজ্জা উপকরণ থাকলেও তিন হাজার মানুষের সবার মাথায় বর্ণাঢ্য মুকুট ও প্রতিটি দলে ৩০টি করে অংলকৃত শোলার পাখা শোভাযাত্রার আগাগোড়া দলগুলোকে যেন এক সুরে মিলিয়ে দিয়েছিল। সেই শোভাযাত্রায় ৪০টি মুখোশসহ প্রজাপতি, পাখি, পরী, ফুল নানা উপকরণ শোভা পাছিল। একটি বড় আকৃতির হাতি শুর দুলিয়ে কান নাড়িয়ে গলায় ঘণ্টা বাজিয়ে হেঁটে চলেছে। তার চার পায়ের ভেতর চারজন তরুণ হাতিকে বহন ও পারফর্ম করছিল। আরো একটি বিশাল কুমির মাপেট লাল মুখ হা করে সাদা দাঁত দেখিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। তেরোজন কিশোর কুমিরটাকে বহন ও পারফর্ম করেছিল।
চল্লিশজন ঐতিহ্যের ঢাক সানাইয়ের বাদ্যদল শোভাযাত্রার নানা অংশে দশজন করে বণ্টন করা হয়েছিল। যশোরের শালিখার লোকজ ঐতিহ্যের শোলার বানর পাপেট পুতুল বৃহৎ আকৃতি করে দশটি  তৈরি করা হয়েছিল। উজ্জ্বল রঙিন বানরেরা বারোফুট লাঠিতে লাফিয়ে উঠছিল নামছিল সারাক্ষণ।
নেতা তরিকুল ইসলাম ও খালেদুর রহমান টিটো মুকুট পরে সবার সাথে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলছিলেন, দুজন উচ্ছ্বাসের সাথে বলছিলেন, জাতীয়ভাবে এমন উৎসব হওয়া প্রয়োজন। একজন  ইতালীয় চিত্রকর ফাদার মাচ্ছেল্য যশোর ক্যাথলিক গির্জার পুরোহিত, তিনি বিশাল আকৃতির একটি ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে সমস্ত উৎসব ধারণ করেছিলেন। সেদিন এই শোভাযাত্রা  চারুপীঠ থেকে শুরু হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে যশোর ইনস্টিটিউটে বৈশাখি মেলার উদ্বোধনের মাধ্যমে শেষ হয়। সেখানে সাড়ে তিন হাজার মানুষকে কুলি-পাকান পিঠার প্যাকেট দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। উৎসবের উন্মাদনায় মায়েরা ভীষণ আন্তরিকতায় সমস্ত রাত জেগে পিঠাগুলো তৈরি করেছিলেন। এই উৎসব, শোভাযাত্রা সফল করতেই জীবনের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছিলাম।

এই উৎসবে মুগ্ধ হয়ে যশোরের চারপাশ তো বটেই ভারতের বনগ্রামেও উৎসবরীতি ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৮৮ সালে দীর্ঘ সেশনজট শেষে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য চারুকলায় ডাক পড়ল। চারুপীঠ পরিচালনার দায়িত্ব কর্মীদের বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকা ফিরলাম। চারুপীঠ আন্দোলনের সহযোদ্ধা হিরন্ময় চন্দ্র, মোকলেসুর রহমান, চারুপীঠের সহযোগী অশোক কর্মকার, জাহিদ মোস্তফা, রেজাউজ্জামান, হাবিবুর রহমান আমার সঙ্গে এমএফএ-তে ভর্তি হয়েছিল। সেসময় ডজনখানেক চারুপীঠের ছাত্রকর্মী ঢাকা চারুকলায় প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত পড়ছিল। এদের মধ্যে ছিল শুভাশীস মজুমদার, শামিম ইকবাল লিপন, রুমি, আদিপ সাইদসহ শহিদুল ইসলাম, শামিনুর রহমান, মনিরুজ্জামান শিপু, শাহিন, লিটু ও মিল্কি। চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষার্থী হিসেবে তারা সকলেই মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎপত্তির অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকা এসেছিল। শিক্ষক, ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান চারুপীঠের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, শিশির ভট্টাচার্য, লালারুখ সেলিম, নিসার হোসেনসহ আরো অনেকেই চারুপীঠের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিল্পী নিসার হোসেন শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পথে কয়েকবার যশোরে অবস্থান করেছেন। তিনি শোভাযাত্রার ছবি, ভিডিও দেখে অনুরোধ করেছিলেন চারুকলা ইনস্টিটিউটে শোভাযাত্রার আয়োজন করার জন্য। আমি ঢাকা আসার পরপরই লোকশিল্পবিশারদ ও দেশের শ্রেষ্ঠ নকশাবিদ শিল্পী তরুণ ঘোষ প্রস্তাব দিলেন- শামিম এসো, আমরা একটা মুখোশ থিয়েটার গড়ে তুলি।
কিন্তু একসঙ্গে চারুপীঠ সামলে ঢাকায় মাস্টার্স ডিগ্রি করতে হচ্ছে তাই থিয়েটার করা সম্ভব হলো না। যদিও তার সঙ্গে সখ্য অটুট রইল। ঢাকায় বর্ষবরণ শোভাযাত্রার উন্নয়ন চিন্তায় তাঁকেও জড়িয়ে ফেলি। বাঙালি ঐতিহ্যের ধরন, নিজস্বতা, মুখোশ, পুতুল নকশার ধরন, গঠন সম্পর্কে আমার চেতনা তিনি ঝালাই করে দিতে থাকেন। এ সময় শিল্পী ইমদাদ হোসেনের সাথে মতিঝিলে বিসিক-এর প্রধান দপ্তরে গিয়ে সাক্ষাৎ করি। যশোরের বর্ষবরণ শোভাযাত্রা, বৈশাখি মেলা, পৌষমেলা, ষড়ঋতু উৎসব প্রচলনে নানা উদ্যোগের কথা আলাপ করি। মুহূর্তে আপন করে নিয়ে তার সময়ের লোকশিল্প, লোকউৎসব, মেলা সম্পর্কে বিস্তর আলাপ করেন তিনি। বিসিক থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকশিল্পী ও শিল্প ঐতিহ্যের তালিকা উৎসসহ  তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী নানা জায়গায় গিয়ে লোকশিল্পীদের সাথে যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলাম।

দ্বিতীয়বার চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসেই বুঝতে পারি, সবচেয়ে খারাপ সময় চলছে। রাজনৈতিক অরাজকতায় শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। ছবি আঁকা হয়নি ছাত্রছাত্রীদের। নেই কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ছিল। পরিত্রাণের একমাত্র পথ ছবি আঁকার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা। ভাবলাম চারুকলা অঙ্গণে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা উৎসব হওয়া  প্রয়োজন। আমার নিজের ক্লাস যেমন ভীষণ মনোযোগের সাথে শুরু করেছিলাম, পাশাপাশি প্রি-ডিগ্রির প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের ছবি আঁকায় মনোনিবেশের জন্য ড্রইং ওয়ার্কশপ আউটডোরসহ নানা সহযোগিতাও করছিলাম। ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় নবীন শিক্ষক নিসার হোসেন এবং শিশির ভট্টাচার্য এবং আমি তিনজন যার যার মত করে এ দায়িত্ব পালন করছিলাম। একদিকে ছাত্রছাত্রীদের ছবি আঁকায় মনোযোগী করা অন্যদিকে পরিকল্পনা করছিলাম, যশোরে যেমন উৎসব করে জাহান্নামে ফুল ফোটানো গেছে তা এখানেও কীভাবে কার্যকর করা যায়।
জানতে পারলাম চারুকলার ৪০ বছর পূর্তি উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। এই তো সুযোগ। মৃত্যুপুরিতে একটা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা আয়োজন করে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবো। খুব গোপনে প্রস্তুতি নিতে হবে। সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে হবে এই ছিল মনোভাব। তরুণদা এবং কিছু কর্মীকে পরিকল্পনার কথা জানালাম। কিন্তু উৎসবটি হলো না। মাহবুব, সাখাওয়াতদের দল জয়নুল উৎসবে সারপ্রাইজ দেওয়ার পরিকল্পনায় গোপনে জিয়া হলে ৪টি ঘোড়া, মুকুট, মুখোশ, অনেকগুলো বৃহৎ আকারের পেন্সিল, তুলি এবং রং-এর প্যালিট তৈরি করলো। ওদিকে ভীষণ রেষারেষির সে পরিবেশে এই সারপ্রাইজ প্রোগ্রাম ব্যর্থ হয়ে না যায় এজন্য আমি, হিরন্ময়, মোখলেসুর রহমান চারুকলার পরিচালক বাসেত স্যার ও নবী স্যারকে ঘটনা জানালাম। তারা বললেন, ঢাক বাজিয়ে কি মনের গুমর কাটবে? ভিপি, জিএসকে বললাম, জয়নুল উৎসবে একটা সারপ্রাইজ আছে। তাই আগে থেকে জানানো হয়নি। আমি বললে জয়নুল উৎসবের অনুষ্ঠান থেকে ঘোষণা দিও। জয়নুল উৎসব চলাকালে হঠাৎ যখন ঘোষণা হলো- এখন আপনাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ঠিক তখন ঢাকের তালে তালে বেরিয়ে এসে রঙিন ঘোড়সোয়াররা নাচতে থাকলো এবং সেই নাচে নেচে উঠলো সবার প্রাণ। দলমত সব বিভক্তির গ্লানি ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গেলো। চলতে থাকলো পেন্সিল, তুলি, রঙের প্যালিটের পিছু পিছু সবাই।

এই সফলতার রেশ কাটতে না কাটতেই বৈশাখি শোভাযাত্রা আয়োজনের জন্য চারুকলা ইনস্টিটিউটের সকল বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটা  মিটিং ডাকার প্রস্তাব করলাম। প্রথম মিটিং প্রিন্ট মেকিং ডিপার্টমেন্টের সামনে লিচুতলার সবুজ লনে। মিটিং-এ সবার উৎসাহে সিদ্ধান্ত হলো ১৯৮৯ সালের পহেলা বৈশাখে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হবে। মাহাবুবুর রহমানকে আহবায়ক করে শোভাযাত্রার ওয়ার্কশপ শুরু হলো। ওদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যশোর চলে গেলাম। কারণ যশোরে তখন পঞ্চমবারের মতো শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলছে। মৌলবাদের বিরাট বাধার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সুষ্ঠুভাবে সেবার উৎসব শেষ হলো। ওদিকে ঢাকা চারুকলার প্রথম শোভাযাত্রাও মাহবুব, সাখাওয়াতদের নেতৃত্বে ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে সুন্দরভাবে সফল হলো। জুইস ভাইয়ের তৈরি পেপার ফোল্ডিং-এ করা বাঘের মুখোশটি সৌন্দর্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিল। শোভাযাত্রায় যুক্ত হলো পেপার ফোল্ডিং-এর অনিন্দ্য সুন্দর সহজিয়া ধারা।
তারপর কবিগুরুর শত বর্ষ আগের লেখা চিঠি যেন আমাদের হাতে এসে পড়ল। ‘শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ আমার কবিতাখানি?’ ধন্য হলো আমাদের তারুণ্য। এ কি সৌভাগ্য আমাদের! আজ থেকে শত বর্ষ আগে জাতির শ্রেষ্ঠতম কবির কল্পনার বছরকে বরণ করার উপলক্ষ্য পেয়েছি আমরা। এমন ভাগ্য পৃথিবীতে কজনের হয়েছে? আমরা বাংলা শতাব্দী বরণের মহাযজ্ঞের স্বপ্নকল্পনা রচনায় বিভোর হয়ে গেলাম।

বাংলা শতাব্দী বরণ উৎসবকে বাঙালি যতখানি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করবে জাতি হিসেবে বাঙালি ততখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। এসব বলে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকি। ১৪০০ সনের কথা ভেবেই ঢাকার বুড়িগঙ্গার নৌকা সাজিয়ে অপরূপ নকশায় আলোকবর্তিকা ও আতশবাজি উৎসবের প্রচলনের জন্য ডিজাইন করতে শুরু করি। ফরেন সেক্রেটারি ইমরুল কায়েস ভাই শুনে মুগ্ধ হলেন। তিনি পুলিশ প্রধানের কাছে অনুমতি প্রসঙ্গে অগ্রিম আলোচনা করলেন। কিন্ত তিনি বললেন, অনুমতি দেওয়া সম্ভব নয়। বরং পুলিশ নিজেই তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নিয়ে নেবে। সে বছরের বর্ষবরণ শোভাযাত্রা জাতীয় উৎসবে রূপ দিতে ঢাকার নৃত্য বিদ্যালয়, নাট্যদল, স্থাপত্য বিভাগ- সব জায়গায় গিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাদের বুঝিয়েছিলাম, তারা যেন প্রতি বৈশাখে চারুকলার বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে নিজ নিজ শিল্প মাধ্যমের আঙ্গিকের অপরূপতায় পারফর্ম করে। প্রখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টর সমর দাশের সাথে শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে আমি ও হিরন্ময় কথা বলেছিলাম। প্রস্তাব দিয়েছিলাম প্রতিবছর নতুন নতুন আঙ্গিকে বর্ষবরণ কনসার্ট তৈরির জন্য। শোভাযাত্রায় ফেন্টাসটিক নকশায় একটি সুবৃহৎ শকট তৈরি করা হবে। নানান সারিতে বসে শতাধিক মিউজিশিয়ান শোভাযাত্রায় সরাসরি কনসার্টে  বাজাবেন। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সব শিল্পের একসাথে প্রকাশধর্মীতায় জ্বলে ওঠার মিলনমেলার পরিকল্পনার কথা শুনে সমর দাশ ভীষন আবেগ প্রবণ হয়ে আমাদের ইচ্ছার সাথে শামিল হবেন বলে কথা দিলেন। কথক নৃত্যশিল্পী সাজু আহমেদকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম চারুকলার শতাধিক ছাত্রছাত্রীকে উৎসব নৃত্য প্রশিক্ষণ দিতে। ভাস্কর্য বিভাগ থেকে মাটি নিয়ে নানা রকমের মুখোশের ডাইস বানাতে শুরু করি আমি ও মাহাবুব। বাঙালি ঐতিহ্যের মুখোশ ও উৎসব উপকরণের নকশা ধরণ বিষয়ে কর্মীদের সাথে সারাক্ষণ আলোচনা লেকচার ওয়ার্কশপ করেছিলাম। শোভাযাত্রাকে বাঙালি ঐতিহ্যের সম্ভ্রান্ত উৎসবে রূপদানে কর্মীদের মানসিক গঠনের উন্নয়নে আমি ও তরুণ ঘোষ উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
ওদিকে ময়মনসিংহের ছেলে বিপুল শাহ এবং বরিশালের ছেলে লিটুকে বরিশালে গিয়ে শোভাযাত্রা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে ওদের নিজ নিজ অঞ্চলে পাঠিয়েছিলাম। আর আমি ও হিরন্ময় ফিরে গেলাম চারুপীঠে যশোরের ষষ্ঠতম উৎসবে নেতৃত্ব দিতে। একদিন শিল্পগুরু এস এম সুলতান অনুরোধ করলেন, ‘শামিম তুমি শোভাযাত্রা সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছ, এবার আমার নড়াইলে করো।’ নড়াইলের জন্য নতুন ধারায় শোভাযাত্রার পরিকল্পনা করলাম। রাস্তায় না হয়ে জলপথে হবে শোভাযাত্রা। চিত্রা নদীর বুকে সুলতানের বজরার সাথে শত শত নৌকার সমন্বয়ে ডিজাইন পরিকল্পনা করলাম। সুলতান মুগ্ধ হলেন। আমি মাহাবুবসহ ঢাকার অনেকেই পরবর্তী বছর নড়াইলের নৌ-শোভাযাত্রা গঠন ও পরিচালনা করব ঠিক করলাম। এভাবে যশোর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল একসঙ্গে কাজ শুরু হয়ে গেল।

১৯৯০ সালে চারুশিল্পী পর্ষদ ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটের শোভাযাত্রার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলো। নবীন, প্রবীণের মিলনে ঢাকার উৎসব বৃহৎ রূপ নিল। তরুণ ঘোষের নকশায় অপরূপ পোস্টার ছাপা হলো। শুরুতে যশোরে ‘বর্ষবরণ শোভাযাত্রা’, পরে ঢাকায় ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’, পরিশেষে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ একেবারে উপযুক্ত নামকরণটি করলেন প্রবীণেরা। ছায়ানট প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক এবং শিল্পী ইমদাদ হোসেন এই নাম প্রস্তাব করেন। এ নামেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আজকের  মঙ্গল শোভাযাত্রা।

 

লেখক : ভাস্কর, সংগঠক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়