ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিটিং চিটিং বনাম ভোগান্তির রকমফের

জাফর উল্লাহ সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১৯ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিটিং চিটিং বনাম ভোগান্তির রকমফের

জাফর উল্লাহ সোহেল : মুখে মুখে গণতন্ত্র আর নাগরিক অধিকারের কথা বলতে আমরা ওস্তাদ। কিন্তু গণ বিষয়ে গণমানুষের মতামত নেয়ার বিষয়ে আমাদের কোনো গা নেই। সরকার তো নয়ই, এমনকি নাগরিক সমাজ বলে নিজেদের দাবি করা কিছু সুশীল ব্যক্তিও টেলিভিশনের টক-শোতে এমন সব বিষয়ে মতামত চাপিয়ে দেয়া বা তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে মতামত তৈরি করার চেষ্টা করেন, যা আসলে সাধারণ মানুষের ভেতরের কথা না। কিন্তু তারা গণমানুষের মত বলেই নিজের মত চাপিয়ে দেন আর কর্তৃপক্ষও তাতে গা ভাসিয়ে দেন। জনগণ আসলে কী চান বা কীভাবে কোন সমস্যার সমাধান চান- সেই কথাটি জানতে চাওয়ারও কেউ নেই।

লোকাল বাসের সংকট কাটাতে এবং সিটিং নামে চিটিংবাজি বন্ধ করতে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করে দেয়া হলো। বলা হলো, এতে সাধারণ যাত্রীদের উপকার হবে। অনেক যাত্রী নাকি এটা চেয়েছেন। টক-শোতে কিছু বিশেষজ্ঞ গলা ফাটিয়েছেন এর পক্ষে। বলেছেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই সিটিং সার্ভিস নেই। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রা করেন। তা পৃথিবীর সব দেশের শহর আর ঢাকা শহর কি এক? পৃথিবীর কয়টা দেশে ঢাকা শহরের মতো এত লোকের চাপ, এত কম গণপরিবহন, এত এত জ্যাম, এত খারাপ রাস্তা, এত আনফিট চালক আছে? টক-শোতে যারা কথা বলেন, তারা ক’জন রাজধানীর গণপরিবহনে চড়েন?

কথায় কথায় আমরা বাকি বিশ্বের উদাহরণ টানি। কিন্তু সেইসব দেশে গণমানুষের কথা কর্তৃপক্ষ শোনে। পরিবর্তন বা সংস্কার কিছু প্রয়োজন হলে তাদের মতামত নিয়েই করে, জনগণ কী চায় তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। এসব বিষয়ে এদেশে অনুকরণের কোনো ইচ্ছা কারো নেই। এই যে ইউরোপ থেকে ব্রিটেন বের হয়ে গেল, সেখানে কি সরকার নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? নেয়নি। তারা একটা গণভোট দিয়েছে, গণমানুষের মত নিয়েছে, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কয়েকদিন আগে তুরস্কও একইভাবে গণভোট থেকে জনগণের রায় নিয়ে সংস্কারে গেছে। আমাদের দেশে এসব চিন্তার কোনো সময় কারো নেই। হুটহাট কিছু বিশেষজ্ঞ আর সরকার মনে করেছে ‘এমন করলে ভালো’। ব্যস করে ফেলেছে। আপনি বলছেন জনগণের স্বার্থে আপনি এটা করছেন- তাহলে আপনি জনগণের মতামত নেন, তারা কী চায়, কীভাবে চায় শুনুন।

যারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আপনারা কি যাত্রীদের মতামত নিয়েছেন? কতজন যাত্রীর মত আপনারা নিয়েছেন? কতজন বলেছেন এতে তাদের উপকার? মাননীয় কর্তৃপক্ষ, গণমানুষের এখন মুখ খোলার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম ফেসবুক। একটু ঢুঁ মেরে দেখুন। ক’জন আপনাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে, আর কজন ধুয়ে দিচ্ছে! আর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের একদিন পরে গণমাধ্যমের খবরগুলোও একটু চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। অনেক যাত্রীর ইন্টারভিউ সেখানে এসেছে। আমার মনে হয় না ১-২ শতাংশের বেশি যাত্রী আপনাদের সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছে। বেশিরভাগই নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছে ফেসবুকে এবং গণমাধ্যমে। একটা অনলাইন গণমাধ্যমে আসা এক নারী যাত্রীর বক্তব্য ছিল এরকম- ‘আগে তো বাসে উঠে অন্তত একটু শান্তি পেতাম, জ্যামে বসে থাকলেও কষ্ট কম হতো। এখন গাদাগাদি করে জ্যামের মধ্যে কীভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাব? আর পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে গাড়িতে উঠবই বা কীভাবে? না উঠতে পারলে ঠিক সময়ে অফিসে যাব কী করে?”

সিদ্ধান্ত প্রণেতারা কি এই নারী যাত্রীদের ভোগান্তির কথাটি ভেবেছেন? ভাবেননি। কেবল তো নারীই নয়। ঢাকা শহরের গণপরিবহনের যাত্রী আছে বয়স্ক নারী-পুরুষ, শিশু; আছে প্রতিবন্ধী, অসুস্থ আর স্কুলগামী শিক্ষার্থী। তাদের কী হবে? প্রথমদিনই দেখা গেছে শত শত নারী-শিশু বৃদ্ধ ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। গরমে তাদের কারো কারো নাভিশ্বাস উঠেছে। অনেকেই ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে পারেননি। অনেকে যেতে পারেননি হাসপাতালে। ঢাকা শহরে চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা কত? আমি জানি না। জানি না কারণ, সম্ভবত এ নিয়ে কোনো জরিপ নেই। না সরকারি মহলে না বেসরকারি মহলে। কিন্তু অনুমান তো কিছুটা করতে পারি। সেটা বাসে চড়ার সময় নারী সহযাত্রীর সংখ্যা দেখে, কর্মস্থলে নারীর উপস্থিতি দেখে, ফুটপাতে হাঁটার সময় পথচারীদের কাতারে নারীর উপস্থিতি দেখে। দিনে দিনে আমরা আধুনিক হচ্ছি, নারীকে কর্মে উৎসাহিত করছি। কিন্তু আবার তাকে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ফেলছি। এই দ্বিচারিতা আমাদের কবে যাবে?

গত মঙ্গলবার সেতুমন্ত্রী বলছেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধের বিষয়টি পুর্নবিবেচনা করা হবে। নিঃসন্দেহে খুবই ইতবাচক চিন্তা। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী, দ্বিতীয়বারের এই ভাবনাটা কি প্রথমেই ভাবা যায় না? সাধারণ মানুষের স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত অনেক দিন ভেবে চিন্তে নেয়া হলো, তা সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করে কেন নেয়া হলো না? ঢাকা শহরে চলাচলে কী কী অসুবিধা, তা যারা চলাচল করেন তাদের চেয়ে কি বিশেষজ্ঞরা বেশি জানেন ?

আসলে এদেশে কোনো কিছুতেই জনমতের বালাই নেই। বাস মালিকদের বিরুদ্ধে যাত্রীদের অভিযোগ ছিল প্রধানত দুটি। এক বেশিরভাগ বাস ‘সিটিং’ বানিয়ে ইচ্ছেমতো বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। দুই স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত বাস রাখেনি কেউ। আর সিটিং সার্ভিস নামের বাসগুলো এসব যাত্রী তুলতে চায় না, আবার অনেক সময় শুরুর স্টপেজেই ভর্তি হয়ে আসে বাসগুলো। ফলে পথের যাত্রীরা আর উঠতে পারেন না। তো এ দুটি প্রধান সমস্যা সমাধানে কী কী করণীয়?

যাত্রীদের একটা বড় অংশের দরকার লোকাল বাস সার্ভিস। লোকাল সার্ভিস মানেই কিন্তু গাদাগাদি আর হুড়োহুড়ির সার্ভিস নয়। বেশি পরিমাণ বাস রাস্তায় নামানো হলে সিটে বসেই লোকাল বাসের যাত্রীরাও চলাচল করতে পারবেন। সে চাহিদা তো সরকারই মেটাতে পারে। বিআরটিসি জনগণকে কী সেবা দিচ্ছে? রাজধানীর গণপরিবহনের নিশ্চয়তাটুকুও কি তারা দিতে পারে না?  মাঝে বেশকিছু বিআরটিসি একতলা দোতলা বাস বেশ নিয়মিত নামানো হতো। সেই ফ্লো বন্ধ হয়ে গেল কেন? এ ব্যাপারে মানুষের সাধারণ অভিযোগ হলো, বাস মালিকদের স্বার্থ দেখতে গিয়েই সরকারি গণপরিবহন সবসময় পিছিয়ে রাখা হয়। এটা অনেকাংশেই সত্যি। তা না হলে রাস্তায় অন্তত ৫০ শতাংশ বাস সরকার দিতেই পারে। ঢাকা শহরের মানুষ কি ট্যাক্স কোনো অংশে কম দেয়? স্বস্তিকর একটি পরিবহন সেবা তো তাঁরা পেতেই পারেন। এই খাতেও জনগণকে সেবা দেয়ার যে একটা বিষয় আছে তাও হয়তো আমাদের নীতি নির্ধারকদের মাথায় নেই।

বিলম্বে আসুক উপলব্ধি, তবু ভালো উপলব্ধি বলব মাননীয় সেতু মন্ত্রীর। গণপরিবহনে নৈরাজ্য কমাতে এবং যাত্রীদের সমস্যা সমাধানে পুনরায় চিন্তাভাবনা করতে বলেছেন তিনি। সেই চিন্তা ভাবনায় এরকম কিছু আসুক যা সবার জন্য ভালো হবে। বাসমালিকরাও তো ব্যবসা করতে নেমেছেন। তাদের একেবারে পথে না বসিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হোক। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাস কোম্পানির অর্ধেক বাস সিটিং সার্ভিস রেখে বাকী অর্ধেক লোকাল সার্ভিস হিসেবে রাস্তায় নামানোর সুপারিশ করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই গণপরিবহন আরো বাড়াতে হবে। সেটা সরকারিভাবে হলে সবচেয়ে ভালো। সরকার না পারলে বেসরকারিভাবে হলেও যাতে বেশি বাস নামে সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য রাস্তার ব্যক্তিগত গাড়ি সীমিতকরণের যে উদ্যোগ একবার নেয়া হয়েছিল তা আবার আলোচনায় আসতে পারে। বিশেষ করে ঢাকা শহরের সব ব্যক্তিগত গাড়ি ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে একদিন ‘এ’ আরেকদিন ‘বি’ ক্যাটাগরির গাড়ি চালানোর অনুমোদন দেয়া যেতে পারে। এতে রাস্তায় বাস বেশি চললেও অসুবিধা থাকবে না।

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়