ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

বুকিং এজেন্ট: আমাদের চলচ্চিত্রের ক্যানসার

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৩২, ২৩ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বুকিং এজেন্ট: আমাদের চলচ্চিত্রের ক্যানসার

রাহাত সাইফুল : চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে অর্থের বিষয়টি সর্ব প্রথম ভাবতে হয় নির্মাতাদের। আর এই অর্থের যোগান দেন প্রযোজক। প্রযোজক শুধু মানুষকে সচেতন ও বিনোদিত করার জন্যই অর্থ লগ্নী করেন না। চলচ্চিত্রে অর্থলগ্নীর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যবসা করা। অনেক প্রত্যাশা নিয়ে চলচ্চিত্রে অর্থ লগ্নী করতে আসেন প্রযোজক। কোটি টাকা খরচ করে কত টাকা ঘরে তুলতে পারেন প্রযোজক? এমন প্রশ্নের উত্তরে এখন শুধুই হতাশা আর চলচ্চিত্রের মন্দা অবস্থার কথা শোনা যায়।

এদিকে সিনেমা হলগুলোর বেহাল দশা! হল মালিকদের কাছে সিনেমার অবস্থা জানতে চাইলে তারাও বলছেন প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। হলের সংস্কার করব কীভাবে? হল বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সিনেমাপ্রেমী মানুষগুলো নিয়মিত প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে চড়া প্রবেশ মূল্য দিয়েই সিনেমা দেখছেন। তাদের দেয়া প্রবেশ মূল্যের পুরোটাই কি সিনেমার প্রযোজক ও হল মালিক পাচ্ছেন? হিসাব অনুযায়ী আধুনিক যুগে সবটাই এই দুই পক্ষের পাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের মাঝে নীরব ঘাতকের মত এদেশের সিনেমায় বাসা বেঁধেছে ‘বুকিং এজেন্ট’ নামক ব্যাধি।

অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক পরে হলেও ২০১২ সালে এদেশে প্রথম ডিজিটাল সিনেমা নির্মাণ ও প্রেক্ষাগৃহে ডিজিটাল প্রজেকশন বসানো হয়। এতেও এদেশের চলচ্চিত্রে ভাগ্যের পরিবর্তন আসেনি। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের এ যুগেও আলু-পটলের মতো চলচ্চিত্রেও প্রযোজক ও হল মালিকদের মাঝখানে মধ্যস্থতাকারী দালাল রয়েছে। এ দালালদের অপর নাম বুকিং এজেন্ট। এদের মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রযোজককে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তি দিতে হয়। 

একজন আলু বা পটল উৎপাদনকারী সরাসরি ক্রেতার কাছে বিক্রি করতে পারেন না। এর মাঝখানে ফরিয়া, দালাল, আড়ৎদারসহ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে ক্রেতার হাতে পৌঁছায়। চলচ্চিত্রও ঠিক আলু-পটলের মতো হয়ে উঠেছে। প্রযোজক ও হল মালিক বা প্রদর্শকদের মাঝখানে বুকিং এজেন্ট নামক এক ধরনের মুষ্টিমেয় মধ্যস্থতাকারীর অস্তিত্ব রয়েছে। সারা বাংলাদেশে এ ধরনের ২২-২৩ জন বুকিং এজেন্ট আছেন।

সারা দেশে মোট ৩২৫টি সিনেমা হল রয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হলগুলোর ১৫-৩০টি পর্যন্ত সিনেমা হলের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন একজন বুকিং এজেন্ট। কোনো প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য প্রযোজক বা পরিবেশককে প্রথমে এই বুকিং এজেন্টের দারস্থ হতে হয়। বুকিং এজেন্টদের সিনেমা পছন্দ হলেই প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা চলবে।

চলচ্চিত্র সর্ম্পকে তাদের সীমিত জ্ঞান ও সাধারণ পর্যবেক্ষণ কাজে লাগিয়েই চলচ্চিত্রের জন্য হল বুকিংয়ের বিষয়ে সিন্ধান্ত গ্রহণ করেন। বুকিং এজেন্টদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে যৌনাবেদনময় তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী সমৃদ্ধ নাচে-গানে ভরপুর অ্যাকশন নির্ভর ফর্মূলা চলচ্চিত্র। যে সমস্ত চলচ্চিত্রে এসব উপাদান কম থাকে সে সব চলচ্চিত্রের ভাগ্যে হল পাওয়া কঠিন। তবে তাদের এসব ধারণা একদমই সঠিক নয়। কারণ বিগত কয়েক বছরের মুক্তি পাওয়া সিনেমার দিকে লক্ষ করলেই তা প্রমাণিত। সম্প্রতি হিট তালিকায় স্থান পাওয়া সিনেমা ‘আয়নাবাজি’। এ সিনেমার কোথাও যৌনতার ছোয়া নেই। তাছাড়া এতে অ্যাকশন বলতে কিছুই নেই। এ সিনেমার তারকারাও যৌনাবেদনময় তারকা নন। বিগত কয়েক বছরে যেসব সিনেমায় যৌনাবেদনময় তারকা অভিনয় করেছেন সে সব সিনেমার মূলধন তো দূরের কথা উল্টো ভর্তুকি দিয়ে সিনেমা মুক্তি দিতে হয়েছে।

প্রতি হল বুকিংয়ের জন্য মধ্যস্থতাকারী এই এজেন্টকে হল থেকে প্রাপ্ত নির্ধারিত পরিমাণ রেন্টাল বা বুকিং ফি বা সাইনিং মানির ১০% কমিশন দিতে হয়। প্রযোজক বা পরিবেশকের কাছ থেকে কমিশন নেয়ার পাশাপাশি বুকিং এজেন্ট একই সাথে হলে এনে দেয়ার জন্য প্রদর্শক তথা হল মালিকদের কাছ থেকেও ৫% কমিশিন নিয়ে থাকেন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবেশক ও প্রদর্শক বা হল মালিক এই দুই পক্ষের সঙ্গেই প্রতারণা করেন বুকিং এজেন্ট। সাধারণত বুকিং এজেন্টের মাধ্যমে শেয়ার মানি, মিনিমাম গ্যারান্টি (এমজি) এবং ফিক্সেট রেন্টাল-এই তিন পদ্ধতিতে প্রদর্শক, পরিবেশক বা প্রযোজকের কাছ থেকে সিনেমা নিয়ে থাকেন। পদ্ধতি যাই হোক বুকিং এজেন্টদের নানান হয়রানি বা প্রতারণার শিকার হতে হয় প্রযোজক ও নির্মাতাদের। অনেক ক্ষেত্রে বুকিং এজেন্টদের সেন্টিগেট নির্ধারণ করেন কোন সিনেমা কোন হলে চলবে। বা আদৌ হল পাবে কি না? তারা প্রদর্শকদের কাছ থেকে টাকা এনে প্রযোজকদের কাছে সঠিক সময়ে দিতে গড়িমশি করেন। হলে কম মূল্যে সিনেমা চালাতে প্রযোজক বা পরিবেশকদের বাধ্য করা হয়। 

বুকিং এজেন্টদের অনেকে পেশি শক্তি ব্যবহার করে ঢাকার চলচ্চিত্রে এক ধরনের সন্ত্রাসনির্ভর দালালতন্ত্র গড়ে তুলেছেন, যা এখন ক্যানসার হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের কারণে অনেক প্রযোজক চলচ্চিত্রের পুঁজি বিনিয়োগ করতে চান না। অনেক হল মালিক আর চলচ্চিত্র ব্যবসায়ে থাকতে চাচ্ছেন না। হল বিক্রি করে দেন অথবা সেখানে মার্কেট বা অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

হলের দর্শক পরিস্থিতি দেখতে পরিবেশক বা নির্মাতা সিনেমা চলাকালীন পরির্দশক পাঠান। এখানেও এই পরিদর্শকের সাথে হল মালিকদের যোগসাজশের ফলে নির্মাতা ও প্রযোজক তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন।

বিশ্বে কোথাও এখন চলচ্চিত্রের বুকিং এজেন্ট সিস্টেম নেই। চলচ্চিত্র এখন শিল্প। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পীকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের সিনেমা হলগুলোতে ই-টিকেটিং সিস্টেম চালু করলে অবস্থার অবসান হবে বলে আশা করা যায়। ই-টিকেটিং চালু হলে একজন প্রযোজক পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে খুব সহজেই তার সিনেমার সেল দেখতে পারবেন। এতে কোন বুকিং এজেন্ট প্রয়োজন হবে না। দালাল চক্র থেকে মুক্ত পাবেন সিনেমার অর্থ লগ্নীকারী প্রযোজক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ এপ্রিল ২০১৭/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়