ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হাওরের দুর্গতি: কখন ‘দুর্গত’ বলব আমরা?

জাফর উল্লাহ সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৯, ২৫ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাওরের দুর্গতি: কখন ‘দুর্গত’ বলব আমরা?

জাফর উল্লাহ সোহেল: ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ হাওরের মানুষকেও কি তাই করতে হবে শেষ পর্যন্ত? প্রতিটি হাওরবাসী হাতে থালা নিয়ে রাজধানীমুখী হলে তবেই কি তাদের দুর্গত বলব আমরা?

হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যায় কি না- কয়েকদিন আগে সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট সচিব বেশ রেগে গিয়ে বলেছেন- ‘একটা ছাগলও মারা যায়নি, কিসের দুর্গত এলাকা?’

তাই তো! ছাগল মারা না গেলে দুর্গত বলব কেন?

প্রায় তিন লাখ কৃষক এবার তাদের ঘরে তুলতে পারবে না সোনালী ধান; পঁচে গেছে লাখ লাখ মেট্রিক টন ধান; সারা বছরের খোরাকি এক নিমিষেই শেষ; মরে গেছে হাওরের হাজার হাজার টন মাছ; মরছে হাঁস আর জলজ সব প্রাণী; মড়ক লাগতে পারে নির্ভরশীল আরো কিছু প্রাণেও, এমনকি মানবপ্রাণও শংকার বাইরে নয়- তবু হাওর দুর্গত নয়, তবু সেখানে কোন সমস্যা নেই! বাহ্, দারুণ।

এজন্যেই কি শনির হাওরে, যেখানে ২২ দিন ধরে না খেয়ে না দেয়ে প্রাণের সবটুকু জোর খাটিয়ে কৃষক রক্ষা করছিল তাদের সারা বছরের দুমুঠো অন্নের আধার, সেখানে দেখা যায়নি কোন সরকারি রক্ষণ চেষ্টা বা ব্যবস্থা ? এমনকি কৃষকের হাজার হাতের সঙ্গে একটি হাতও লাগেনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের! বড়ই বিচিত্র এই দেশ আর এর সরকারি কর্তাদের আচার। একটা দেশের একজন সচিব যখন দুর্গত মানুষ বলতে কেবল ছাগল-টাগল মরে যাওয়া বোঝেন তখন এর মাঠ পর্যায়ের কর্তাদের আর কী দোষ দেব। সবই এদেশের মানুষের কপালের দোষ। হাওরের মানুষের দোষ আরো বেশি। এদের দোষ- এরা অযথা হাউকাউ  করে, এদের দোষ- এরা গরীব, এদের দোষ- এরা বাকী দেশটার মানুষের জন্য চালের ব্যবস্থা করে, এদের দোষ- এরা বেশি বোঝে, এদের দোষ- এরা হাওরে ফসল ফলায়, এদের দোষ- এরা সরকারি কর্তাদের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় সরাসরি কথা বলে, এদের দোষ- এরা দুর্নীতিবাজদের নাম বলে দেয়! আরো নানান রঙের দোষ আছে হাওরের লোকদের। সুতরাং এদের কথায় কান দেয়া যাবে না; অতএব এদের মিছে কান্নাকাটি দেখে হাওরকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যাবে না। চলিতেছে সার্কাস!

এই লেখা যখন টাইপ করছি তখন সুনামগঞ্জের স্থানীয় এক সাংবাদিক ফোন করেন। সবশেষ ভেঙে যাওয়া শনির হাওরের মানুষের কান্নার রোল আর বারবার মুর্ছা যাওয়ার খবর জানান তিনি। জানান, ২২ দিন ধরে কতটা কষ্ট স্বীকার করে হাজার হাজার মানুষ রাতদিন পরিশ্রম করেছেন এই হাওরটির ফসল টেকানোর জন্য। কিন্তু পারেননি। এখন হাওর পারের নারী-পুরুষের কান্না সেখানকার ঝড়ো বাতাসে মিশে যে করুণ সুর রচনা করেছে তা ভারী করে তুলছে গোটা হাওরাঞ্চলের পরিবেশ। একটা মানুষও মারা যায়নি, তবু হাওরের বাতাসে যে শোক, তার ব্যথা কি কোন অংশে কম? মাননীয় সচিব মহোদয়ের কাছে অবশ্য এসব কিছুই না!

সুনামগঞ্জের স্থানীয় সেই সাংবাদিক জানাচ্ছিলেন আর আমার মনে হচ্ছিল তাঁর কণ্ঠ কাঁপছিল। হঠাৎ কী মনে হতে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এখানে কি আপনারও জমি ছিল?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ ভাই আমারও ছিল। তবে নিজে করিনি, বর্গা দিয়েছিলাম। নিজের জন্য খারাপ লাগছে না ভাই, খারাপ লাগছে কৃষকদের জন্য। তাদের যে কী কষ্ট, এখানে না আসলে তা বাংলাদেশের কোন মানুষই বুঝবে না, উপলব্ধি করতে পারবে না।’

আমি তাতে সায় দিই। তিনি বলে চলেন শনির হাওর রক্ষার ব্যর্থ যুদ্ধের কাহিনী। হাওরে বিপর্যয় নামার পর এটিকে রক্ষা করা যাবে মনে করে কী কী প্রচেষ্টা হাওরবাসী নিয়েছেন, কী কী করেছেন, কীভাবে মানুষকে মাইকিং করে স্বেচ্ছাশ্রমে উদ্বুদ্ধ করেছেন, কীভাবে জনপ্রতিনিধিদের হাতেও বালির বস্তা তুলে দিয়েছেন। কীভাবে দিনের পর দিন বাঁধে কাটিয়েছেন হাওরপারের নারী-পুরুষ। কীভাবে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও ছুটে গিয়েছিল বাঁধ রক্ষায়, আর কী পরিমাণ আশা বুকে নিয়ে ঘরে ঘরে অপেক্ষায় ছিলেন কৃষানিরা- এক সপ্তাহ পরেই ঘরে তুলবেন সোনালী ধান!

খোঁজ নেয়ার পর মফস্বলের সেই সাংবাদিক ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘ভাই এই যে বলছেন, ২২ দিন ধরে হ্ওারের বিভিন্ন এলাকার মানুষ নিজেরা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে এই শনির হাওরটি রক্ষার চেষ্টা করেছে, যার ফলে আশাও দেখছিল কয়েকটি উপজেলার মানুষ, মাত্র তো আর একটি সপ্তাহ, এরপরেই কৃষকের ঘরে যেত ধান, এমনকি ধানের খোলাও তৈরি করেছিলেন অনেক কৃষানি! তো এতদিন ধরে সেখানকার প্রশাসন, বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কী ভূমিকা ছিল? তারা এই বাঁধ রক্ষায় কী ব্যবস্থা নিয়েছে ?’

তিনি জানালেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা জেলা প্রশাসন কিংবা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কাউকে দেখা যায়নি এই ২২দিন। তবে, স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন এবং নিজেরা খেটেছেন।

৪-৫ টি জেলার গোটা হাওরাঞ্চল যেখানে ডুবে গেল, লাখ লাখ হেক্টর জমি তলিয়ে গেল, পচে গেল ধান, মরে গেল মাছ-  সেখানে এক-দুটি হাওর যখন বাঁচানোর সুযোগ এল এবং যেখানে হাজার হাজার মানুষ নিজেরা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষায় চেষ্টা করছিলেন, সেখানে বাঁধ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কেউ গেলেন না এবং কোন ব্যবস্থাও নিলেন না- এ কী খবর আমাদের শুনতে হল? এদেশে কি প্রশাসন বা সরকার বলতে কিছু আছে ? কোন কর্তৃপক্ষ বলতে কি কিছু আছে ? নাকি সেইসব কর্তৃপক্ষ তাঁদের সর্বোচ্চ কর্তা সচিবের চিন্তা চেতনা লালন করে চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন? তাঁদের কাজ কি চোখ বন্ধ করে বসে থাকা? অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ হয়?

শনির হাওরের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আগের দিন একটি দৈনিকে স্থানীয় এক উপজেলা চেয়ারম্যানের বক্তব্য ছিল এরকম- ‘আমরা হাজারো মানুষ নিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করছি, নাওয়া-খাওয়া নাই, অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কারো দেখা নাই, এদের গাফিলতিতেই তো আমাদের এই করুণ দশা।’

একজন উপজেলা চেয়ারম্যানের যখন এমন অসহায়ত্ব দেখি, তখন আমাদের আসলে বেশি কিছু বলতে হয় না; বেশি কিছু বলার নেইও। পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাঁধের ঠিকাদার, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী- কারো বিরুদ্ধেই আমাদের কোন কিছু বলার নেই। আসুন আমরা ঘটনা দেখে যাই, দেখে যাই আর দেখেই যাই। তারপর কিছু ছাগলের মরার অপেক্ষায় থাকি। এবং তারপর সচিব মহোদয়ের কাছে যাই। বলি- মাননীয়, এখন তো কিছু ছাগল মারা গেল, এবার কি তবে হাওরকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যায় ?

লেখক: সাংবাদিক

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ এপ্রিল ২০১৭/শাহনেওয়াজ

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়