ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

জীবন লম্বা না হলেও হতে পারে অনেক বড়

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৩ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জীবন লম্বা না হলেও হতে পারে অনেক বড়

হাসান মাহামুদ : জীবন মানেই হাসি-কান্না, শঙ্কা-ঊচ্ছ্বাস, মুগ্ধতা-চেতনার প্রতিচ্ছবি। এসব আলাদা আলাদা ছবি ছোট হলেও শিল্পকলা ছোট নয়। এর এক-একটি ছবি অনেক কিছুরই জানান দেয়। কিছু ছবিতে রয়েছে জীবনের গল্প, বিপদের শঙ্কা, হাসি, কান্না- সবকিছু মাখিয়ে একটি সুষম ছবি, পরিপূর্ণ চিত্রপট।

ইতিহাস যারা চর্চ্চা করেন, তারা হয়ত জানেন -মোগল অধিকারের আগে ঢাকা শহরের পরিধি সূত্রাপুর থেকে আজকের বাবুবাজার পর্যন্ত সীমিত ছিল। তখন বাবুবাজারের নাম ছিল পাকুড়তলী। ঢাকা বাংলার রাজধানী হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই শহরের সীমানা বেড়ে যেতে থাকে। একটি রাজধানী শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পায়। ফলে নানা অঞ্চল থেকে সম্প্রসারিত ঢাকায় অনেক মানুষ চলে আসতে থাকে। এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে ঢাকার জনসংখ্যা। প্রশাসনিক কাজে শহরের বিভিন্ন অংশে নানা দপ্তর খোলা হয়। কোথাও প্রতিষ্ঠিত হয় সেনানিবাস। বিভিন্ন ধরনের কর্মচারীর বসতিও গড়ে ওঠে।

কিছু মানুষের সৃষ্টিকর্মও ঠিক রাজধানী গড়ে উঠার মতো। তুলির আঁচড় দিয়ে তাদের সৃষ্টিকর্ম রাঙানো। তেমনি একজন সুকান্ত ভট্টাচার্য। মাত্র ৬/৭ বছরের সাহিত্যচর্চায় তিনি দুই বাংলায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। তিনি বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী কবি।  পাশাপাশি অভূতপূর্ব উপমা আর বিপ্লবী অভিব্যক্তি দিয়ে তিনি কবিতার বুনন গেঁথে গেছেন।

সুকান্তের কবিতা আমাদের সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী ছিল স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত। যা তাঁর বয়সের বিবেচনায় ছিল অসাধারণ ও বিস্ময়কর। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। তাঁর বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস পাওয়া যায় তাঁর কবিতা থেকে। অভিনবত্বের চেয়েও প্রকাশ ভঙ্গির বলিষ্ঠতা এবং প্রতিমা নির্মাণের অভিনবত্বের জন্য পাঠক সমাজে অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছে।

উচ্চতর মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের আজকের দিনে (১৩ মে) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। মানবতার জয়ের জন্য লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী কবির আজ ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মুত্যুদিনে তাঁর সৃষ্টির জন্য আজো তাঁকে আমরা স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়।

বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী পর্যায়ে সুকান্তের আবির্ভাব স্মরণীয়। সুকান্তের কবিতায় বিষয় ও বক্তব্যের বহুমাত্রিকতা একটি নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাব বলয় ভেঙ্গে নতুন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নিবেদিত থেকে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন, সমাজচেতনা ও মূল্যবোধের জাগরণে নিবেদিত থেকেছেন।

স্বল্প আয়ুর এই কবি পৃথিবীতে চলমান ঘটনা আর রাজনীতিতে সচেতন ছিলেন। কাব্যচর্চার সময় তাঁর খুব দীর্ঘ না থাকলেও তাঁর কবিতা পাঠকের কাছে আগ্রহ সঞ্চার করেছে। বলা যেতে পারে সুকান্ত একটি আধুনিক কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছেন। এখানেই অন্য কবিদের থেকে তার স্বাতন্ত্র্যতা। যেহেতু একজন প্রগতিশীল কবি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্যুত নন, সেহেতু চলমান ঘটনাপ্রবাহ ও ভবিষ্যৎকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন সচেতনভাবে। তিনি গণমানুষের মুক্তির প্রেরণা সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন।

মনীন্দ্রলাল বসুর ‘রমলা’ উপন্যাসের নায়ক সুকান্তের নামেই আদরের ভাইটির নাম রেখেছিলেন জ্যাঠতুতু দিদি রানি। উপন্যাসের মূল চরিত্র ছিল সুকান্ত। তিনি দুরারোগ্য যক্ষায় অকালে মৃত্যুবরণ করেন।  কে জানত উপন্যাসের নায়কের পরিণতি মেনে নিতে হবে প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্তকে?

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের মাতুতালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নিবারণ ভট্টাচার্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের ব্যবসা করতেন এবং মা সুনীতি দেবী ছিলেন গৃহবধূ। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলায় (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। কবির জন্মের পূর্বেই তার পূর্ব পূরুষেরা এ দেশ থেকে ভারতে চলে যায়।

কিন্তু কবিদের সেই বাড়ি সংরক্ষণ করছে বাংলাদেশ সরকার। সুকান্ত ভট্টাচার্যের স্মৃতি সংরক্ষণে বরাবরই বাংলাদেশ পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা থেকে বেশি আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে।

মহিম হালদার স্ট্রিটের যে বাড়িতে সুকান্তের জন্ম ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তার অস্তিত্ব ছিল। এরপর তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে কালিঘাট থানা থেকে হাজারা রোড ফায়ার বিগ্রেড ক্রশিং পর্যন্ত একটি সড়ক তৈরি হওয়ার কাজ শুরু হয়। এই সড়কটি বর্তমানে ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জি রোডকে সংযুক্ত করেছে। এমনকি কলকাতায় উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে সড়কটির মধ্যে বাড়ির একটি বড় অংশ পড়ে যাওয়ায় তা ভাঙা পড়ে। এখানে এখন আর কবির কোনই স্মৃতি চিহ্ন নেই। যদিও ১৯৭৬ সালে ওই বাড়িটির অবশিষ্ট অংশ ভেঙে কালিঘাট সুকান্ত স্মৃতি রক্ষা কমিটির উদ্যোগে কবি সুকান্ত পাঠাগার নামে একটি লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়। কিন্তু লাইব্রেরিটি তৈরি করেই যেন স্মৃতিরক্ষা কমিটি তাদের দায়িত্ব সেরেছে।

কবির জীবনের একটি বড় অংশ কাটে কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। এই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে। পাশের বাড়িটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ছোট ভাই বিভাস ভট্টাচার্য ও তার স্ত্রী বাসন্তী ভট্টাচার্য। কিন্তু এই বাড়িটি সংরক্ষণের বিষয়েও কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সুকান্তের সাহিত্য-সাধনার মূল ক্ষেত্র ছিল কবিতা। সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা ও বিক্ষোভ তাঁর কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। তাঁর রচনাকর্মে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাণীসহ শোষণহীন এক নতুন সমাজ গড়ার অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ২১ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যুবরণ করেন।

সুকান্ত ছিলেন গণমানুষের কবি। তাই জীবদ্দশায় সরকারী রোষানলে তার মূল্যয়ন হয়নি। তবে মৃত্যুতে মলিন হয়নি সুকান্তের কবিতা, মানুষের হৃদয়ে তার অবস্থান এখনো সজীব। সুকান্তের ক্ষেত্রে বলা চলে- জীবন লম্বা না হলেও হতে পারে অনেক বড়। মাত্র কয়েক বছরের কাব্যচর্চায় এই অঞ্চলে সেই প্রমাণ একমাত্র তিনিই দিয়ে গেছেন।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়