ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ওডারল্যান্ড : স্বাধীনতার যুদ্ধে বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১৮ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওডারল্যান্ড : স্বাধীনতার যুদ্ধে বিশ্বে এক অনন্য উদাহরণ

জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী ও ওডারল্যান্ড

হাসান মাহামুদ : দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন- এমন নজির পৃথিবীতে আরো রয়েছে। ‍কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস সারাবিশ্বে অন্যতম বিষয় হিসেবে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বেশকিছু কারণে জাতিগতভাবে বাংলাদেশের যেসব অবদান রয়েছে বিশ্বে অন্য কোনো জাতির তা নেই।

আমরাই একমাত্র জাতি যারা মুখের ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছি, স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছি, গণতন্ত্রের জন্য রাজপথ রাঙিয়েছি বুকের রক্তে। এরই মধ্যে আমাদের ভাষা আন্দোলনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এতোদিন যা শুধুমাত্র জাতীয়ভাবে পালিত হতো, এখন তা সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগমূহুর্তে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর বর্বর হামলা চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। দিনটিকে এখন ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে, দিবসটি ঘোষণার প্রথম বছরেই তা আন্তর্জাতিকভাবে পালনের দাবি উঠেছে বিভিন্ন স্থান থেকে। কম গুরুত্বপূর্ণ হলেও জেনে রাখার মতো একটি তথ্য হচ্ছে, অন্তত ৫টি দেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।

এতো এতো বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামের সাফল্যগাঁথা, গৌরবগাঁথা কম নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে একজন ভিনদেশী নাগরিক ‘বীর প্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত হন। একটি ভিন্ন দেশের নাগরিক স্বজ্ঞানে অন্য দেশের হয়ে যুদ্ধ করেছেন এবং বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে ‘বীর প্রতীক’ উপাধি দেওয়া হয়।  এটিও বিশ্বে এক অনন্য ঘটনা। সাহসিকতার এবং ভ্রাতৃপ্রেমের এক অনন্য উদাহরণ।

একটি দেশ, একটি স্বাধীন ভূখণ্ড সবারই কাম্য। কোনো কোনো জাতিকে সেই স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন করতে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে যায় দেশ মাতৃকার টানে, শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্যে, দেশের মানুষের মুক্তির জন্যে। একজন সৈনিক যুদ্ধ করে নিজের দেশের প্রতি কর্তব্যের কারণে কিন্তু একজন ভিনদেশী! সে কেন অন্য দেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে? সে কোনো অচেনা অজানা মানুষের হাহাকার শুনে নিজের জীবন বিপন্ন করবে? এখানে তো তার কোনো দায়বদ্ধতা নেই!

কিছু মানুষ থাকেন যাদের কোনো ভৌগলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করে রাখা যায় না। কেউ কেউ দেশ কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে যান অবলীলায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদেরকে শামিল করেন জনমানুষের কাতারে। রুখে দাঁড়ান সব অনিয়মের বিরুদ্ধে। কখনো গর্জে ওঠে তাদের হাতিয়ার, কখনো কলম, কণ্ঠ, আবার কখনো বা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েন জীবন বিপন্ন করে।

এ ধরনের মানুষের সংখ্যা যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়, বরং সংখ্যায় এরা খুবই কম কিন্তু যারা সবকিছুর উর্ধে উঠে মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসেন তারাই হয়ে ওঠেন স্মরণীয়, কর্ম দিয়ে নিজেদেরকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম এ রকম কিছু স্মরণীয় সুহৃদকে যারা দেশকালের সীমা অতিক্রম করে আমাদের সেই মহাক্রান্তিকালে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত।

’৭১ এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের সাথে মিশে আছে ভিনদেশী কিছু বন্ধুর নাম। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি আমাদের বিদেশী বন্ধুরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাদের কেউ কেউ কূটনীতিক হিসেবে, কেউ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, কেউ সাংবাদিক হিসেবে আবার কেউ কেউ লড়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখ সমরে। এদেশের ভাগ্যবঞ্চিত মানুষের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে রেখেছিলেন।

আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই সব স্মরণীয় বরণীয় মানুষদের, যারা আমাদের আকাশে আজও উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করছেন। এ রকমই একজন বরণীয় মানুষ ডব্লিউ এ এস ওডারল্যান্ড। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রাখা বিদেশীদের মধ্যে বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত একমাত্র ব্যক্তি তিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সমরে অংশগ্রহণ করার জন্য এই খেতাবে ভূষিত হন তিনি।

টঙ্গীর বাটা সু কোম্পানিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চাকরির সুবাদে এবং একজন বিদেশী হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল বেশ, ফলে সব মহলেই বিশেষ করে সেনাসদরে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। অনেক সময় সেনানিবাসে সামরিক অফিসারদের আলোচনা সভায় অংশগ্রহণের সুযোগও পান।

মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যদ্রব্য ও আর্থিক সহায়তা ছাড়াও পাক সেনাদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশার সুযোগে তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনা, তৎপরতা ও সব ধরনের গোপন তথ্য পাঠিয়ে দিতেন ২ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। সেইসাথে বাটা সু কোম্পানির কারখানা প্রাঙ্গনসহ টঙ্গীর বেশ কয়েকটি গোপন ক্যাম্পে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গেরিলা কমান্ডো হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন রণকৌশলের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ অস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা সামগ্রী ও আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধারা তার কারখানায় আশ্রয় নিয়ে আশেপাশে গেরিলা অপারেশন চালাতেন। শুধু প্রশিক্ষণ দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ডেপুটি হাইকমিশনের সহায়তায় পাক বাহিনী কর্তৃক বাঙ্গালীদের উপর নৃশংস নির্যাতন ও গণহত্যার চিত্র গোপনে বহিঃবিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ায় অসামান্য অবদান রাখেন।

ওডারল্যান্ডের এমন সাহসীচেতা এবং বাংলাদেশের জনগণের সাথে একাত্মতার এরূপ বিরল ঘটনার জন্য তিনিই মহান মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত বিদেশি। বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত হওয়ার সংবাদ শুনে আনন্দিত হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষের সাথে যেন আরো মিশে গেলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের মত এমন লড়াকু মনোভাব সম্পন্ন জাতি তিনি পৃথিবীর কোথাও দেখেননি- যে জাতি ভাষার জন্য লড়াই করে, স্বাধীনতার জন্য বারবার লড়াই করে, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে। মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত গর্বভরে ও শ্রদ্ধার্ঘ্য চিত্তে নামের সঙ্গে বীর প্রতীক খেতাবটি লিখেছিলেন তিনি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের এ বীর সৈনিক ২০০১ সালের আজকের দিনে (১৮ মে) স্বদেশে প্রাণত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন প্রকৃত বন্ধুকে হারিয়েছে। আমরা তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

লেখক: সাংবাদিক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মে ২০১৭/হাসান/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়