ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

জাতীয় জীবনে তামাকের অর্জন বনাম বিসর্জন

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৭, ২২ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাতীয় জীবনে তামাকের অর্জন বনাম বিসর্জন

এম এ রহমান : তামাক গাছ বামন জাতের স্বল্পজীবী উদ্ভিদ। পরিপূর্ণ তামাক গাছের পাতাকে বিশেষভাবে শুকিয়ে সেই পাতাকে উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তামাক পাতা দিয়ে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, জর্দা, গুল, নস্যি ও অন্যান্য উদ্দীপক দ্রব্য তৈরি করা হয়।

তামাক পাতা চুষে নির্যাস গ্রহণ করা হয় অথবা পুড়িয়ে ধোঁয়া নেয়া হয়। কিন্তু তামাক মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এটি ক্যান্সার ও হৃদরোগসহ নানা ধরনের কঠিন রোগ সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তামাকের এত ক্ষতি থাকা সত্বেও বিশ্বে তামাকসেবীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে তামাকজনিত কারণে মৃত্যু।

বাংলাদেশ এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা দেশের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু কথা হচ্ছে, এমন ক্ষতিকর পণ্য আমরা কতটুকু ত্যাগ বা বর্জন করতে পারছি। সরকারই বা কতটুকু করতে পারছে তামাক থেকে জনগণকে বিরত রাখতে। শুধু সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ‘ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা ধুমপানে বিষপান কিংবা তামাক ক্যান্সারের কারণ’ ইত্যাদি শ্লোগান দেয়া ছাড়া।

জনস্বাস্থ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বর্তমান সরকার টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) লক্ষমাত্রা পূরনে কাজ করছে।  আর লক্ষ্যমাত্রা  অর্জনে তামাককে বড় বাধা হিসেবে দেখছে সরকার। এজন্য ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। কিন্তু তা বাস্তবে কতটুকু সম্ভব।

দেশের উন্নয়নে আত্মনির্ভশীল হওয়ার জন্য দরকার রাজস্ব। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভ্যাট বাবদ রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে সর্বোচ্চ ভ্যাট পরিশোধকারী শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম দুটিই তামাক খাতের। কোম্পানি দুটি হলো ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড ও ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ।

এনবিআরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী সিগারেট উৎপাদনের পর স্ল্যাবভেদে টার্নওভারের সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ হারে মূসকসহ প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয় তামাক উৎদনকারী প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে গত অর্থবছরে রাজস্ব বাবদ ১১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা দিয়েছে বিএটিবিসিএল। যা এনবিআরের ভ্যাট বাবদ মোট রাজস্বের ১৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।  এমনকি চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেও ৭ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে কোম্পানিটি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভ্যাট বাবদ রাজস্ব প্রদানে দ্বিতীয় অবস্থান রয়েছে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ঢাকা টোব্যাকো। সর্বশেষ অর্থবছরে ঢাকা টোব্যাকো ৩ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা ভ্যাট প্রদান করেছে, যা ওই অর্থবছরে এ খাতের মোট রাজস্বের ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এ বছরে প্রথম সাত মাসে ১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা ভ্যাট পরিশোধ করে তৃতীয় স্থানে রয়েছে কোম্পানিটি।  এছাড়া অন্যান্য ছোট ছোট কোম্পানির ভ্যাট কিংবা সকল কোম্পানির আয়কর বিবেচনা করলে সরকারের ঘরে রাজস্বের পাল্লা আরো একটু ভারি হবে বটে।

মনে হতে পারে, তামাক নিষিদ্ধ করা হলে সরকারের এই বিশাল রাজস্ব আদায়ের বিকল্প কি? তবে ক্ষতির দিক বিবেচনা করলে হিসাব কিন্তু উল্টে যাবে। পরিসংখ্যানে যা দেখলেন তা সাময়িক লাভের। কারণ, তামাকজাত পণ্যে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমান বেশি, আরো ব্যাপক এবং ভয়াবহ।

অপর এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।  এর মধ্যে ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় ধূমপানজনিত রোগের চিকিৎসায়। আর ধূমপানজনিত অসুস্থতার কারণে জাতীয় উৎপাদনশীলতার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুসারে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে ৪ কোটি ৬০ লাখ মানুষ সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন, যা দেশের ৪৩ শতাংশ। বছরে প্রায় ১ লাখ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে ধূমপানজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এছাড়া ক্যান্সারজনিত মৃত্যু ৩৮ শতাংশ,  যক্ষ্মায় ৩৫ শতাংশ ও শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে ২৪ শতাংশ মারা যায়। যা অত্যন্ত উদ্বেগের। ‍উদ্বেগ আরো বৃদ্ধি করে যখন বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের ভয়াবহতার চিত্র পাওয়া যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তামাক গ্রহণের কারণে মারা যেতে পারে। সংস্থার মতে ৭০ ভাগ তামাকের উৎপাদন ও বিক্রি হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এই উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের কিশোর-কিশোরী তামাকপণ্যে বেশি আসক্ত হচ্ছে। যা ভবিষ্যত কর্মক্ষম জনশক্তির জন্য আশনি সংকেত।

এর প্রধান কারণ হিসেবে বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন: দুধ, ডিম এবং চালের তুলনায় তামাকপণ্যের দাম আমাদের মতো দেশে অনেক কম। এর সঙ্গে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন ও নির্মল বিনোদনের অভাব এবং সামাজিক অবক্ষয়।

এতসব পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ শেষে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, তামাক জাতীয় পণ্যের বিস্তার রাজস্বের বিবেচনায় সরকারের জন্য যতটা না অর্জন, তার চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবের দিক থেকে বিসর্জনের পাল্লা ঢের বেশি। বিশেষ করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিবেচনায় তামাকের প্রভাব ভয়াবহ। তাই এখনই তামাকের লাগাম টেনে ধরা দরকার। নইলে যা হারাবে তা অর্থ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।

লেখক: সংবাদকর্মী।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মে ২০১৭/রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়