ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘বুদ্ধির মুক্তি’ ও ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:২২, ১ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বুদ্ধির মুক্তি’ ও ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির

হাসান মাহামুদ : ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বাঙ্গালী জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সংগ্রাম, সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, এসবের আগেই এই অঞ্চলে সূত্রপাত হয়েছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের। এই আন্দোলন হয়েছিল সাহিত্যাঙ্গণকে আবর্ত করে।

বাঙালি মুসলমান সমাজের যুগ যুগান্তরের আড়ষ্ট বুদ্ধিকে মুক্ত করে জ্ঞান-পিপাসা জাগিয়ে তোলাই ছিল, ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের লক্ষ্য। আরো লক্ষ্যের মধ্যে ছিল, ‘শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো’ বিতরণের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে সচেতনতা আনা, কৃষি নির্ভর দেশ মাতৃকার কৃষকদের স্বাবলম্বী করে তুলতে সাহায্য করা এবং কৃষক সমাজের দুঃখ দুর্দশার মুক্তির পথ নির্দেশ।

অন্ধভাবে ধর্ম ও সমাজবিধি পালন নয়, মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তি দ্বারা ধর্ম ও প্রথাকে যাচাই করার মর্মার্থ সবার মঝে ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল এই আন্দোলনের তাৎপর্য। এই আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে মূল প্রেরণা হয়ে কাজ করেছে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ নামের অরাজনৈতিক ও প্রগতিশীল একটি সংগঠন।

১৯২৬ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ-এর নেতৃত্বে এই ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠিত হয়। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের সমাজ সচেতন করে তোলা এবং নানারূপ অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা। সংগঠনটির নাম ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ হলেও, এর কর্মকান্ড আবর্তিত হতো হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালির জন্য। এই সংগঠনের মুখপত্র ছিল ‘শিখা’। সে সূত্রে এর সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা ‘শিখা গোষ্ঠী’র লেখকরূপে পরিচিত হন।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের মূলমন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। আর এই শিখার সম্পাদক-প্রকাশক হিসাবে আবুল হুসেন ছিলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিদের অন্যতম। শিখা গোষ্ঠীর অন্যান্য লেখকদের মধ্যে কাজী আবদুল অদুদ, (১৮৮৭-১৯৪৮) কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১), কাজী আনোয়ারুল কাদির (১৮৮৭-১৯৪৮) মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-৫৬) আবুল ফজল এবং আবদুল কাদির (১৮৮৭-১৯৪৮) এর নাম উল্লেখযোগ্য।

বিংশ শতাব্দিতে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন মূলত গড়ে উঠেছিল ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’, এই আপ্তবাক্য সামনে রেখে। বিখ্যাত উক্তিটি ‘শিখা’-এর প্রতিটি সংখ্যায় প্রচ্ছদে লেখা থাকতো। এটি সাহিত্যিক আবদুল কাদির-এর লেখা। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, গবেষক, সম্পাদক ও নজরুলবিশেষজ্ঞ। ১১১ বছর আগে আজকের দিনে (১৯০৬ সালের ১ জুন) বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আড়াইসিধা গ্রামে আবদুল কাদির জন্মগ্রহণ করেন। মনীষীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক নয়াদিগন্তের দিগন্ত সাহিত্যতে কে জি মোস্তফা লিখেছিলেন, ‘সেকালে বিখ্যাত কিন্তু একালে বিস্মৃত লেখকদের খোঁজ আজ কতজনেই বা রাখে! কিন্তু এককালে পাঠকদের মনে তাঁরা যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তাঁদের ছিল দুর্বার মেধা। নিজেকে ছড়িয়েছেন দিগ্বিদিক। ছড়িয়েছেন কত অসংখ্য আপাত অসম্বন্ধ চিন্তায়, তথ্যে ও অভিজ্ঞতায়। পরিতাপের বিষয় বহু গুণান্বিত এসব মনীষীর জীবন সম্পর্কে আজ অনেকেই তেমন কিছু জানে না। মানুষের মন থেকে মনীষীদের মুছে ফেলা হলে বড় মাপের মগজধোলাই, এ আশঙ্কা তো থেকেই যায়।

এঁরা সর্বকালের আধুনিক মানুষ। এঁরা আমাদের সহযাত্রী ও অভিযাত্রী। বয়স নয়, তাঁদের লেখার ভেতর দিয়ে আজো আমরা সমমনস্ক হয়ে উঠি। এমনি একজন ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির।

সেকালেই তিনি ছান্দসিক কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ‘ছন্দ সমীক্ষণ’ নামে তার একটি বিখ্যাত বই রয়েছে। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এই বিখ্যাত গ্রন্থে তিনি বাংলা ছন্দ সম্পর্কে মৌলিক বক্তব্য রেখেছেন। তার ছন্দ বিচারের ক্ষমতা ছিল অতুলনীয়। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি পরিশ্রমী এবং একনিষ্ঠতার ছাপ রেখেছেন।

আবদুল কাদির ছন্দ বিষয়ে দুটি সিরিজ বক্তৃতা রাখেন—‘ড. মুহম্মদ এনামুল হক বক্তৃতামালা’ (১৩৯০) ও ‘মতীয়র রহমান বক্তৃতামালা : ১৯৭৫’। এ বক্তৃতামালা তার মৃত্যুর পর ‘বাঙলা ছন্দের ইতিবৃত্ত’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত প্রথম খণ্ডে স্থান পায় চর্যাপদ থেকে মধুসূদন দত্ত পর্যন্ত। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় খণ্ডে স্থান পায় পঞ্চাশের দশকের ওমর আলী পর্যন্ত। বই দুটি’র মাধ্যমে তিনি বাংলা কবিতার ছন্দের সামগ্রিক মূল্যায়ন করেছেন।

সমগ্র বাংলা কবিতার নির্যাস তুলে এনে তার ছন্দ মূল্যায়ন করেছেন আবদুল কাদির। গবেষণা ক্ষেত্রে আবদুল কাদির নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন যুক্তি দিয়ে, প্রমাণ দিয়ে। কোনো মনগড়া কথা তিনি বলেননি। অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দরদ দিয়ে যত্ন নিয়ে করতেন সাহিত্য বিচার। যার কারণে নিজের বক্তব্য নিজে এমনতর সম্পাদনা করতেন যে তার পান্ডুলিপির অবয়ব হয়ে যেত মানচিত্রের মতো। তিনি প্রশংসা যেমন করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে আবার সমালোচনাও করেছেন তীর্যকভাবে।

রবীন্দ্র ও নজরুল উত্তর যুগে তথা তিরিশের দশকের শক্তিমান কবি আবদুল কাদির। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল। তিরিশের দশক থেকেই কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এবং তার মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরেও অদ্যাবধি কবি হিসেবে খ্যাতিমান। কবি শব্দটি তার নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ছান্দসিক কবি হিসেবেও তার বিশেষ পরিচিতি ও খ্যাতি রয়েছে।

আবদুল কাদির বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী। প্রধানত সনেট ফর্মকেই তিনি কবিতার বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সমালোচকদের মতে, তার সনেট বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল। ছন্দ নিয়ে গবেষণা করে যারা খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন আবদুল কাদির তাদের একজন।

মাহবুবুল হক ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে আবদুল কাদির সম্পর্কে বলেন, ‘তার কাব্যপ্রয়াসে মোহিতলাল মজুমদারের ধ্রুপদী সংগঠন নজরুলের উদাত্ত আবেগের চমৎকার সমন্বয় সহজেই লক্ষণীয়।’ (পৃ-৭২৬)

কবি গবেষক খালেদ হোসাইন তার ‘বাংলা কবিতার ছন্দ’ প্রবন্ধে আবদুল কাদির সম্পর্কে বলেন, ‘আবদুল কাদির তিরিশি কবিদের সমকালে কবিতা লিখেছেন। কবি হিসেবে রোমান্টিক। তার প্রেমিকা দিলরুবা যেন নভোলোকের বাসিন্দা। এক ধরনের শুদ্ধবাদিতা আছে কবিতায়। মাত্রাতিরিক্ত ছন্দপ্রবণ। ছন্দ বিষয়ে রক্ষণশীল।’ (বাংলা ছন্দের মানচিত্র -সম্পাদনা: ড. খালেদ হোসাইন ও মুজিবুল হক কবীর, অনিন্দ্য প্রকাশন, পৃ-৩৯২)

আবদুল কাদির মৌলিক লেখালেখির ক্ষেত্রে অনেকটা উদাসীনই ছিলেন। তার মৌলিক কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা খুবই কম। তবে অন্যদের কবিতা প্রকাশে, সম্পাদনায় ও বিশ্লেষণে তিনি খুবই আগ্রহী ও উৎসাহী ছিলেন।তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দিলরুবা’ বের হয় পরিণত বয়সে ১৯৩৩ সালে। ‘দিলরুবা’ তাকে বিপুল কবি পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। দিলরুবার প্রায় ৩৪ বছর পর বের হয় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তর বসন্ত’। ‘উত্তর বসন্ত’ পুরস্কারপ্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ।

তার প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত কাব্যসংকলন ‘কাব্যমালঞ্চ’, ছন্দবিষয়ক গ্রন্থ ‘ছন্দ সমীক্ষণ’, গবেষণাগ্রন্থ ‘বাংলাকাব্যের ইতিহাস: মুসলিম সাধনার ধারা’ (১৯৪৪), নজরুলের জীবনীগ্রন্থ ‘কবি নজরুল’ (১৯৭০), জীবনীগ্রন্থ ‘মওলানা মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন’ (১৯৭৯), ‘কাজী আবদুল ওদুদ’ (১৯৭৬), ‘লোকায়ত সাহিত্য’ (১৯৮৫), মুসলিম সাহিত্যের সেরা গল্প, নজরুল রচনাবলী (প্রথম খন্ড-পঞ্চম খন্ড), রোকেয়া রচনাবলী, শিরাজী রচনাবলী, লুৎফর রহমান রচনাবলী, ইয়াকুব আলী রচনাবলী, আবুল হুসেন রচনাবলী কাব্যবীথি প্রভৃতি।

সাংবাদিক জীবন শুরু করেন সওগাত পত্রিকার মাধ্যমে। ১৯২৬ সালে সম্পাদনা বিভাগে চাকরি নেন আবদুল কাদির। ১৯৩০ সালে যোগ দেন কলকাতা করপোরেশনের একটি প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৩৫ সালে রাজনীতিবিদ কমরেড মুজাফফর আহমদের কন্যা আফিয়া খাতুনকে বিয়ে করেন। সেই সময় সম্পাদক হিসেবে বের করেন মাসিক ‘জয়তী’ ও ‘নবশক্তি’। কলকাতার বিখ্যাত ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় যোগ দেন ১৯৩৮ সালে। ১৯৪২ সালে কাজী নজরুল ইসলামের ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে সরকারের প্রচার সংস্থায় বাংলা অনুবাদকের পদে যোগদান করেন। সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’ ও অর্ধ সাপ্তাহিক ‘পয়গাম’ পত্রিকায় যোগ দেন ১৯৪৬ সালে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপত্র মাসিক ‘মাহেনও’ পত্রিকায় কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৫২ সালে। মানে নও থেকে ১৯৬৪ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডে প্রকাশনা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৭০ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

কাজী নজরুল ইসলামকে আবদুল কাদির পেয়েছিলেন সহযোদ্ধা, সহকর্মী, অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে। নজরুলের সান্নিধ্য ও স্নেহে সিক্ত ছিলেন কবি। নজরুলের প্রতি তারও ভালোবাসার কমতি ছিল না। কাদির তার ‘নজরুলের জীবন ও সাহিত্য’ দীর্ঘ প্রবন্ধে তার ছন্দ মূল্যায়ন করেন।

ছান্দসিক এ কবির কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও তা সমকালে মূল্যায়িত হয়েছে যথাযথ। তিনি বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, মুক্তধারা পুরস্কার লাভ করেছেন। তার নানামুখী কর্মকান্ড গ্রন্থভুক্ত করা গেলে আমরা আরো বেশি নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারব।

১৯৮৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর কবি আবদুল কাদির মৃত্যুবরণ করেন। তার রচনাসমগ্র প্রকাশ করার জন্য বাংলা একাডেমি উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তাতে শুধু কবি-সাহিত্যিকরা নয়, গোটা জাতিই সমৃদ্ধ হবে।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ জুন ২০১৭/হাসান/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়