ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বাংলা সাহিত্যের অনন্য রত্ন আকবর হোসেন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ২ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলা সাহিত্যের অনন্য রত্ন আকবর হোসেন

হাসান মাহামুদ : কালের বিবর্তনে হারিয়ে যায় স্থান এবং ব্যক্তি, এটাই স্বাভাবিক। তারপরও নিজ সংস্কৃতির নিদর্শন সংরক্ষণ করার তীব্র প্রচেষ্টা থাকে মানব সমাজে। নয়তো সময়ের নিষ্ঠুরতম চরিত্র- ভবিষ্যত থেকে মানুষকেই হারিয়ে ফেলার আশংকা থাকে। নশ্বর এই জগতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সে নিয়ম মেনে আমরা হারিয়ে ফেলেছি বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা, আমাদের মনের পাতা থেকে মুছে গিয়েছে বহু গুণী ব্যক্তির নাম।

তেমনি একজন কথাশিল্পী আকবর হোসেন। সাহিত্যে শব্দ বা কথার ব্যবহার যে একটি শৈল্পিক বিষয় হতে পারে, তা দেখিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে এই গুণী থেকে গেছেন অবহেলিত। এমনকি বাংলা একাডেমিও এই কথাশিল্পীর শিল্পকর্ম সংরক্ষণে কখনো উদ্যোগ নেয়নি। ফলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রায় অপরিচিত এই সাহিত্যিক। ১৯৮১ সালের আজকের দিনে (২ জুন) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এই শব্দযাদুকরকে।

মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনাকালীন সময় থেকেই সাহিত্য চর্চা করতেন আকবর হোসেন। শিক্ষা জীবনের অবসান ঘটিয়ে পুরোদমে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন তিনি। তার প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্চিত’ বিপুল পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন প্রকৃতি ও অন্তরের টানে। তার লেখায় সমাজ ও সংসার জীবন, পারিপার্শ্বিকতা আর তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধরা দিয়েছে সাবলীলভাবে। গ্রামীণ সমাজ সংস্কার, সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খা, নাগরিক জীবনের দুঃখ-বেদনা, সমসাময়িক জীবনচিত্র, সমকালীন চিমত্মা-চেতনা, চারপাশের চেনাজগত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আমাদের অহংকার ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রেম ও রোমান্টিকতা প্রভৃতি দারুন মুন্সিয়ানার সাথে উপস্থাপিত হয়েছে আকবর হোসেনের উপন্যাস ও লেখনিতে।

তার ভাষার সাবলীলতা কাব্যময়তা, গতিময়তা এবং শৈল্পিক সন্নিবেশ উপন্যাসগুলোকে জনপ্রিয় করেছে। সময়কে সংরক্ষণ করার শৈল্পিক প্রয়াসে তিনি সফল, শিল্পী হিসেবে নিজ কর্তব্য পালনে তিনি একনিষ্ঠ। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে নীরবে নিরলসভাবে সাধনা করে গেছেন এই নিভৃতচারী। আজ এদেশে উপন্যাস, সাহিত্যে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার শীর্ষে যারা অবস্থান করছেন আকবর হোসেন এদের চেয়ে বেশি নিরেট ও শক্তিশালী ঔপন্যাসিক ছিলেন। অথচ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পাঠকমনে কাঁপন ধরিয়ে দেয়া কীর্তিমান এই ঔপন্যাসিক আজও এদেশ অবমূল্যায়িত রয়ে গেছেন।

সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর মাটি ও মানুষ শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে সব সময় গৌরবময় ভূমিকা রেখে আসছেন। কুমারখালীর শিলাইদহে এসে সাহিত্য চর্চা করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এছাড়া বাউল সম্রাট লালন ফকির, বিষাদসিন্ধু রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, কাঙ্গাল হরিণাথ মজুমদার, কবি ডক্টর হরগোপাল বিশ্বাস, বাউল সাধক গগন হরকরা, কবি আজিজুল হক, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, শিশু সাহিত্যিক জোবেদা খানম, কবি জলধর সেন, বিপ্লবী নেতা কাজী মিয়াজান, বাঘা যতীন (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), কলকাতার বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ছড়াকার নাসের মাহমুদ, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক রকিবুল হাসান কুমারখালীর অহংকার। এদের মধ্যে বাঘা যতিন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রকিবুল হাসানের জন্ম গ্রামে।

এই কুমারখালীরই আরেক রত্ন আকবর হোসেন। দেশের শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির ইতিহাসে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে বিচরণ করেছেন তিনি। কুমারখালীর আরো এক অলংকার নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের পরে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আকবর হোসেনই সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ছিলেন।

ছাত্রাবস্থায়ই আকবর হোসেন লেখালেখি শুরু করেন। তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল কবিতার মাধ্যমে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কথাশিল্পী হিসেবেই তিনি পরিচিত হন। সন্ধানী, শিক্ষা, দৈনিক আজাদ ও নবযুগসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশের ভেতর দিয়ে তার সাহিত্য প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তার প্রথম উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিত’ প্রকাশ হয় ১৯৫০ সালে, যা অল্প সময়ে পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে।

আকবর হোসেনের বাড়ি ছিল গড়াই তীরবর্তী কয়া গ্রামের কয়ারঘাটের কাছাকাছি। নদীর সৌন্দর্য, খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ, গ্রামীণ জীবনযাপন তার বালক-মনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছিল, যা তার লেখক সত্তার উন্মেষে সাহায্য করে। তার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ধরা হয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ। বলা হয়ে থাকে, কবিগুরুর সাক্ষাৎ-স্মৃতি তার লেখক সত্তাকে পরিপক্ব করে তুলতে সাহায্য করেছিল।

আকবর হোসেনের লেখা জনপ্রিয় কয়েকটি বই হল— অবাঞ্ছিত (১৯৫০), কী পাইনি (১৯৫২), মোহমুক্তি (১৯৫৩), ঢেউ জাগে (১৯৬১), আলোছায়া (১৯৬৪), দু’দিনের খেলাঘরে (১৯৬৫), মেঘ বিজলী বাদল (১৯৬৮), নতুন পৃথিবী (১৯৭৪), দুষ্টক্ষত এবং আভা ও তার প্রথম পুরুষ।

তার রচিত ‘মেঘ বিজলী বাদল’ উপন্যাস নিয়ে ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন কাজী নূরুল হক।

এই ঔপন্যাসিকের যাবতীয় সৃষ্টিকর্ম জাতীয় ভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুন ২০১৭/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়