ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘ব্যাংকে লাখ টাকায় কর’ বিষয়টিতে বিভ্রান্ত হবেন না

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ৪ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘ব্যাংকে লাখ টাকায় কর’ বিষয়টিতে বিভ্রান্ত হবেন না

হাসান মাহামুদ: প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার পর কোনো একটি-দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, এটা নিয়ম। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে- এবার যে বিষয়টি নিয়ে তুলকালাম হচ্ছে, জনগণ বিভ্রান্ত হচ্ছে, তা পুরোটাই ভুল বুঝে হচ্ছে। সাদা চোখে আমরা দেখছি, এক লাখ টাকার বেশি ব্যাংকে জমা থাকলে ৫০০ থেকে আবগারি শুল্ক ৮০০ টাকা করা হয়েছে। কিন্তু এটি করতে গিয়ে সরকার যে আমাদের জন্য তার আগের টাকা জমা সুদমুক্ত করে দিয়েছেন, তা আমরা ভেবে দেখছি না।

‘ব্যাংকে লাখ টাকার বেশি থাকলে বাড়তি কর’ বিষয়টি নিয়ে যে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, তা পরিষ্কার করাই এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। তার আগে আপনাকে একটি বিষয় জানতে হবে। তা হলো- ব্যাংকে টাকা জমা রাখার উপর করের বিষয়টি কিন্তু নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই যে কোনো গ্রাহকের জমাকৃত টাকার উপর কর নেওয়া হয়। কিন্তু এবার কিছু মহল আওয়াজ তুলছেন ‘ব্যাংকে টাকার উপরও কর নিচ্ছে সরকার’, ‘ব্যাংক আমানতে শুল্ক আরোপ হচ্ছে’, ‘মাটির ব্যাংকে টাকা রাখার যুগে ফিরে যাবে মানুষ’ প্রভৃতি। এসব নিছকই সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা। এখনো ঘোষিত এই বাজেট প্রস্তাবিত। এই বাজেট অনুমোদনের বিষয়টি কিন্তু এখনো বাকী। তার আগেই বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি তুলকালাম চলছে। আসছে জুলাই থেকে আবগারি শুল্কের নতুন এই নিয়ম কার্যকর হওয়ার কথা। তবে এতে পরিবর্তনও তো আসতে পারে। যেহেতু বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত নয়।

ব্যাংকে জমা টাকার উপর করারোপের বিষয়টিকে বলে এক্সাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক। এই এক্সাইজ ডিউটি সবসময়ই বাংলাদেশে চলমান। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে আগে কখনো এভাবে বৃহৎ পরিসরে আলোচনা উঠেনি, তাই এই টার্মটি সর্ম্পকে অনেকে জানতেন না। আর তাই টার্মটি নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন কেউ কেউ। এতেই মূলত বিভ্রান্তিটা ছড়াচ্ছে। মূল বিষয় হচ্ছে- এবছর এ নিয়মে কিছু বিষয় সমন্বয় করা হয়েছে। সুবিধা দেওয়া হয়েছে কম আয়ের মানুষদের।

এতোদিন দেশে এক্সাইজ ডিউটির যে হারটি ছিল, তা হচ্ছে- যে কোনো ব্যাংক হিসাবে ২০ হাজার টাকার কম থাকলে তা শুল্ক মুক্ত, হিসাবে ২০ হাজার এক টাকা থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে থাকলে একশত পঞ্চাশ টাকা শুল্ক এবং এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা মধ্যে জমা থাকলে শুল্ক বাবদ ৫০০ টাকা কাটা হয়।

বিষয়টি আবার একটু মিলিয়ে নিন- বর্তমান নিয়মে আপনার ব্যাংকে ২০ হাজার টাকার কম থাকলে কোনো শুল্ক নেওয়া হয় না। ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকার মধ্যে থাকলে ১৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এক লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে থাকলে ৫০০ টাকা শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। মোট তিনটি স্ল্যাব রয়েছে এখানে। আর ১০ লাখ টাকার বেশি থাকলে তার জন্য আলাদা শুল্ক। এটি ভিন্ন স্ল্যাব। আমরা প্রথম তিনটি স্ল্যাব সর্ম্পকে জেনে নিলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

এবার আসুন, বাজেটে কি ঘোষণা দেওয়া হলো দেখি। বাজেট বক্তব্যে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এক লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কেউ ব্যাংকে টাকা রাখলে, তাকে আবগারি শুল্ক দিতে হবে ৮০০ টাকা।’ অর্থ্যাৎ বছরের যেকোনও সময় ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকা ডেবিট কিংবা ক্রেডিট হলে এতদিন ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হতো। অর্থমন্ত্রী তা ৮০০ টাকা শুল্ক প্রস্তাব করেছেন।

এবার একটু ভাবুন- বাজেটে মূলত কি বলা হয়েছে। বাজেটে বলা হয়েছে এক লাখ টাকার বেশি থাকলে শুল্কের কথা। এই ঘোষণার মাধ্যমে সরকার কিন্তু প্রথম স্ল্যাবের শুল্ক মওকুফ করে দিল। অর্থ্যাৎ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমার ক্ষেত্রে এখন থেকে আর কোনো শুল্ক দেওয়া লাগবে না গ্রাহককে। এই সুসংবাদটি কিন্তু কেউ ভেবে দেখছেন না। তবে বাজেটে শুধু ২০ হাজার টাকার কথা বলা হয়নি, এই ২০ হাজার টাকার জমা শুল্ক মুক্তের বিষয়টি এক লাখ টাকা পর্যন্ত করে দিয়েছে সরকার।

বাজেটের ঘোষণাটা মনে করে দেখুন। বাজেট প্রস্তাবে প্রথম ও দ্বিতীয় স্ল্যাবটি এক করে বলা হয়েছে হিসাবে এক লাখ টাকার নিচে যে কোনো অংক পর্যন্ত শুল্কমুক্ত হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় স্ল্যাবে এতদিন যে ১৫০ টাকা শুল্ক দেওয়া লাগতো, এ বছর তা শুল্ক মুক্ত করা হয়েছে। যাদের এক লাখ এক টাকা থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংকে জমা থাকবে তাদের হিসাব থেকে বছরে আটশত টাকা শুল্ক বাবদ কাটা হবে।

 

বিষয়টি এ রকম:

ব্যাংক স্থিতি

শুল্কের হার- আগের নিয়ম

শুল্কের হার- প্রস্তাবিত নিয়ম

ব্যাংকে ২০ হাজার টাকার কম থাকলে

শুল্ক মুক্ত

শুল্ক মুক্ত

২০০০১ (বিশ হাজার এক টাকা) থেকে ১০০০০০ (এক লাখ) টাকার মধ্যে হলে

শুল্ক ১৫০ টাকা

শুল্ক মুক্ত

১০০০০১ (এক লাখ এক টাকা) থেকে ১০,০০০০০ (দশ লাখ) টাকা মধ্যে জমা থাকলে

শুল্ক ৫০০ টাকা

শুল্ক ৮০০ টাকার প্রস্তাব

১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা

১ হাজার ৫০০ টাকা

২ হাজার ৫০০ টাকার প্রস্তাব

১ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা

৭ হাজার ৫০০ টাকা

১২ হাজার টাকার প্রস্তাব

৫ কোটি টাকার বেশির ক্ষেত্রে

১৫ হাজার টাকা

২৫ হাজার টাকার প্রস্তাব

 

সূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ও প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা করে লেখকের তৈরি করা

এ বিষয়ে অনেকেই বলছেন, স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর আবগারি শুল্কের বোঝা চাপানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাজেটে প্রস্তাবিত আবগারি শুল্কের বিষয়টি বেশি আরোপ করা হয়েছে সম্পদশালীদের উপরই। উপরের চার্টটি লক্ষ্য করলেই দেখবেন, ১০ লাখের উপর থেকেই মূলত শুল্ক বাড়ানো হয়েছে বেশি।

তবে এই বিষয়টিও এক দৃষ্টিতে মেনে নেওয়া যায়। তা হলো- বর্তমানে মানুষের আয় আগের তুলনায় বেড়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের হাতে কিছু টাকা থাকলেও এখন থেকে তা ব্যাংকে রাখা যাবে, তার জন্য কোনো শুল্ক দিতে হবেনা। যেটা আগে দেওয়া লাগতো। কারণ প্রস্তাবিত বাজেটে শুল্কমুক্ত সুবিধার সিলিংটি ১ লাখ পর্যন্ত করে দেওয়া হয়েছে। যা আগে ছিলো মাত্র ২০০০০ টাকা। অর্থ্যাৎ এক লাখ টাকা পর্যন্ত জমা ও তোলার ক্ষেত্রে শুল্ক দিতে হবে না।

অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আমরা শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টির উত্তরও পেয়েছি। দ্বিতীয় দফায় তিনি বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। এই প্রস্তাবের প্রধান কারণ বিনিয়োগে উৎসাহী করা। একই সঙ্গে আশা করা হচ্ছে- এর ফলে পুঁজিবাজারেও বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থ্যাৎ, যাতে ব্যাংকে বেশি টাকা অলস জমা পড়ে না থাকে। সরকারের এই উদ্যোগের কারণে গত কয়েক বছরে ব্যাংকগুলোতে সুদের হারও কমিয়েছে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমেছে। এসবের লক্ষ্য ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগ বাড়ানো। যা এই মুহূর্তে আমাদের মতো দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক দেশের জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয়।

বর্তমান সরকার গত কয়েক বছর ধরেই চাইছে, জনগণ অলস আয়ের মনোবৃত্তি থেকে বেরিয়ে আসুক। অলস টাকা ব্যাংকে ফেলে রেখে নিশ্চিন্তে যারা বসে থাকতে চান, সরকার তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে চায় বিনিয়োগে। এটি নিশ্চয়ই কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নয়। বরং এতে অর্থনীতি সচল হয়, আর দেশের উন্নতিও ত্বরান্বিত হয়।

সবশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী, তা হলো- আমরা অনেকেই এখনো সোর্স ট্যাক্স বা আয়কর, ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর এবং আবগারি শুল্ক বা এক্সাইজ ডিউটি, এই তিনটি বিষয় সর্ম্পকে জানিনা। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা উন্নত হচ্ছি। অর্থনীতির এই তিনটি টার্ম এখন আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ হয়ে গেছে। টার্মগুলো সর্ম্পকে সবারই স্বচ্ছ ধারণা থাকা জরুরী।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

লেখক: সাংবাদিক।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ জুন ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়