ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গৃহকর্মীকে নির্যাতন বিকৃত মানসিকতা

মো. আকতারুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪০, ৯ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গৃহকর্মীকে নির্যাতন বিকৃত মানসিকতা

মো. আকতারুল ইসলাম : ৯ বছর বয়সী জান্নাতুল। সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। জান্নাতুল শিশু গৃহকর্মী। সে কাজ করতো গাজীপুরে একটি বাসায়।

গৃহকর্ত্রী মনি বেগম এই নির্যাতনের হোতা। মুমূর্ষু অবস্থায় বাড়িতে পাঠানো হয় জান্নাতুলকে। খবর পেয়ে চাঁদপুরের পুলিশ সুপার জান্নাতুলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। জান্নাতুল, হ্যাপি, লুৎফা, সুমাইয়া নামগুলো নির্যাতিত শিশু গৃহকর্মীদের। সারাদেশে নামগুলো পরিচিতি পেয়েছে গণমাধ্যমের বদৌলতে। এরা সবাই মানুষের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কর্মরত ছিল। তাদের সবার ক্ষেত্রেই নির্যাতনের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। এদের সবারই নির্যাতনের ধরনও একই। গরম খুন্তির ছেকা, চুল ধরে টানা, গরম ইস্ত্রির ছেকা, লাঠি দিয়ে আঘাত করা। এদের মধ্যে আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্ষণেরও শিকার হয়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করলেও নিয়মিত মজুরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সময় অনিশ্চয়তা দেখা যায়।

গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় নীতিমালাও আছে, সরকারও আন্তরিক। কিন্তু নির্যাতন খুব একটা কমছে না। এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। নিয়োগকারীদের শিক্ষা, আর মানবিকবোধ জাগ্রত হওয়া, মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তনেই কমবে গৃহকর্মীদের  নির্যাতন। গৃহশ্রমিকরা সবাই অতি দরিদ্র শ্রেণির। মামলা চালানোর পয়সা কম, অধিকার নিয়ে তাদের সচেতনতাও কম। নানা ধরনের হুমকি, আবার এমনও হয় নির্যাতনের মামলায় শিশু গৃহকর্মীর বাবা-মা বড় অংকের টাকা পয়সা পেলে নির্যাতনকারীদের সাথে আপোস করে ফেলেন।

সরকার গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় আগের যে কোন সময়ের চেয়ে আন্তরিক। গৃহকর্মীদের অধিকার সুরক্ষায় সরকার ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নীতিমালায় গৃহকর্মীরা শ্রম আইন অনুযায়ী সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা পাবেন। নারী গৃহকর্মীরা চারমাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন। সর্বনি¤œ ১২ বছরের শিশুকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিতে হলে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারী শিশুর বাবা-মার সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শর্ত মোতাবেক নিয়োগ দেয়া যাবে।

গৃহকর্মীদের কর্মঘণ্টা বিন্যাসে পর্যাপ্ত ঘুম, বিশ্রাম, চিত্তবিনোদন এবং প্রয়োজনীয় ছুটির ব্যবস্থা রাখতে হবে। অসুস্থ গৃহকর্মীকে নিয়োগকর্তা নিজের দায়িত্বে চিকিৎসা করাবেন। গৃহকর্মী ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবেন এবং কর্মক্ষেত্রে গৃহকর্মীর কোন ক্ষতি হলে মালিক ক্ষতিপূরণ দেবেন। নীতিমালা অনুযায়ী গৃহকর্মীর সাথে মানবিক আচরণ করবেন। অশালীন আচরণ, দৈহিক আঘাত বা মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। গৃহকর্মীর ওপর যে কোন ধরনের হয়রানি বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুবিচার নিশ্চিত করতে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে। গৃহকর্মীর অধিকার বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্র, শ্রম ও কর্মসংস্থান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগ নেবে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, সিটি কর্পোরেশনের প্রধান এবং আঞ্চলিক নির্বাহী, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিতে কাজ করবে। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গৃহকর্মীদের সুযোগ সুবিধাগুলো তত্ত্বাবধান করবে।

নীতিমালা প্রণয়নের পরে সরকার তা বাস্তবায়নে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন, কোন গৃহকর্মীর নির্যাতনের সংবাদ পেলে সাথে সাথে অভিযান পরিচালনা করা হবে এবং নির্যাতনকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। প্রয়োজনে নির্যাতিতাকে  চিকিৎসাসহ সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হবে।

সে অনুযায়ী শিশু গৃহকর্মী জান্নাতুলের চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। সুমাইয়াকেও ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। গৃহকর্মী সুরক্ষায় সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ১০৯২১ নম্বরে গৃহকর্মী নির্যাতন রোধে জরুরি সেবার ব্যবস্থা করেছে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালাটি ইতোমধ্যে বিজ্ঞাপন আকারে প্রচারবহুল সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে। মহিলা আইনজীবী সমিতি গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলাগুলো বিনা খরচে পরিচালনা করছে।  সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করছে। গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেটওয়ার্ক গঠন করা হয়েছে। নেটওয়ার্কের সাথে এবং আলাদাভাবে বিলস, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, প্রথম আলো ট্রাস্ট, অক্সফামসহ অনেকগুলো সংস্থা নিয়মিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে যারা কাজ করেন তাদের সবাই মনে করেন অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, পাশাপাশি এ বিষয়ে আরো সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকার এবং এনজিও, সকলে মিলে নিয়োগকারীকে  জানাতে হবে যে, আপনার বাসায় যে গৃহকর্মী রয়েছে তার সুরক্ষায় সরকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সজাগ। গৃহকর্মীকে নির্যাতন করলে নিশ্চিত শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। গৃহকর্মী নির্যাতন বিকৃত মানসিকতার পরিচায়ক। নিয়োগকারীকে বুঝতে হবে গৃহকর্মীদেরও মানবিক এবং আইনগত অধিকার আছে। সরকার তার অধিকার সুরক্ষায় বদ্ধপরিকর। গৃহকর্ত্রীদেরকে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা অনুযায়ী তার সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেক গৃহকর্তা যদি তার গৃহকর্মীকে নিজের সন্তানের মত দেখেন তাহলে এমনিতে গৃহকর্মী নির্যাতন কমে যাবে।

লেখক: তথ্য অফিসার, পিআইডি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ জুন ২০১৭/আকরাম/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়