ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একব্যাগ রক্ত রোগী নয়, একটি পরিবারকেও বাঁচায়

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ১৪ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একব্যাগ রক্ত রোগী নয়, একটি পরিবারকেও বাঁচায়

হাসান মাহামুদ : একটি বিস্ময়কর তথ্য দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। বর্তমানে বিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত চরিত্রগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্যাম্প। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিবাসীদের বের করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়ও চলছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দেহেই বইছে অবৈধ অভিবাসীর রক্ত।

ট্রাম্পের মা ম্যারি অ্যানি ম্যাকলিওড যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হিসেবে আশ্রয় নেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। ম্যাকলিওডের জন্মস্থান স্কটল্যান্ডের লুইস। ভাগ্যের সন্ধানেই তিনি অভিবাসী হিসেবে নিউ ইয়র্কে পাড়ি দিয়েছিলেন ১৯৩০ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন হার্বার্ট হুভার। তিনি দেশটির ৩১তম প্রেসিডেন্ট। আরো অবাক করা বিষয় হচ্ছে, হার্বার্ট হুভারও ছিলেন রিপাবলিকান রাজনৈতিক দলের প্রার্থী। এক শতাব্দির কাছাকাছি সময় পরে এসে সেই রিপাবলিকান দলেরই বিজয়ী প্রার্থী দেশ থেকে অভিবাসীদের বের করে দিতে চাইছেন। তাও আবার অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনো প্রভাব বর্ণনা ছাড়াই।

একবার ভাবুন, যদি সেদিন হার্বার্ট হুভারও অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দিতেন, তাহলে ট্রাম্প কি দেশটির প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন? অবশ্যই, না। যদি আরেকটু আগে তাকাই, ট্রাম্পের দাদাও ছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত অবৈধ অভিবাসী।  যাই হোক, ট্রাম্পের বিতর্কিত অভিবাসী নীতি বা অভিবাসীর রক্ত, এই রচনার মুখ্য বিষয় নয়।

সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে ১৮ হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ করেছেন মানুষকে। মানুষ ‍সৃষ্টির সেরা জীব। আবার, মানুষই পৃথিবীর সব প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসহায়। কারণ মানুষ বিপদমূহুর্তে অন্য কোনো প্রাণীর সরাসরি উপকার পায়না। মানুষই নিজের মহত্ত্ব দিয়ে নিজের স্বজাতিকে মহিমান্বিত করে তোলে। যদিও এতে তার নিজের মহত্ত্ব একটুও কমে না। আর এই মহত্ত্ব কাজের অন্যতম উপায় রক্তদান করা। রক্তদান এমনই মহৎ কাজ, যার মাধ্যমে নিজের মধ্যে আনন্দ ও শান্তি আসে। রক্ত দিয়ে স্বর্গীয় অনুভূতি লাভ করা যায়। পাশাপাশি অন্য একটি জীবনও বাঁচে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে- রক্তদাতারা অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি নিজের শরীরকেও সুস্থ রাখতে পারেন। হৃদরোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় নিয়মিত রক্তদানের মাধ্যমে।

ধরুন, একটি গাভী প্রতিদিন আধা লিটার করে দুধ দেয়। গোয়ালা সাত দিন দুধ দোয়ালো না। সে গরু কি আটদিনের দিন সাড়ে তিন লিটার দুধ দেবে? কখনোই না। আমাদের শরীরে রক্তের উৎপন্ন হওয়া এবং রক্তের কোষ নষ্ট হওয়ার বিষয়টিও একই রকম। রক্ত দান করলে তা আবার নিজের থেকে পূরণ হয়ে যায়। দান করা রক্ত পূরণ হওয়ার জন্য ভাল ভাল খাবারেরও প্রয়োজন নেই। সাধারণ ডাল-ভাত-রুটি সবজিই যথেষ্ট।

চিকিৎসকরা বলেন, আমাদের শরীরে রক্তের মূল উপাদান লোহিত কোষ সাধারণত ৩-৪ মাস অন্তর অন্তর মারা যায়। আবার নতুন কোষ সৃষ্টি হয়ে সেই ঘাটতি পূরণ হতে বেশি সময় লাগে না। আপনি যে প্লাজমা দান করবেন তা পূরণ হতে সময় লাগে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আর লোহিত কোষ পূরণ হতে সময় লাগে ৪-৬ সপ্তাহ। তাই একজন সুস্থ মানুষ প্রতি ৮ সপ্তাহ বা ৫৬ দিন পর পর রক্তদান করতে পারেন।

কিছু পরিসংখ্যান ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ছয় লাখ ব্যাগ নিরাপদ ও সুস্থ রক্তের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বছরে স্বেচ্ছায় রক্ত দেন তিন লাখ মানুষ। তার মানে, প্রতিবছরই তিন লাখ রক্তের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বাংলাদেশে। ঘাটতি কথাটা বলা হয়তো সহজ, অথচ এর প্রভাব বা পরিনামটি কি একবার ভাবুন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি জীবনের মরণ। হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়েও শুধুমাত্র রক্তের অভাবে তারা মারা যাচ্ছে। এর থেকে দুঃখজনক আর কি হতে পারে!

রক্ত কতটা প্রয়োজন তা চাহিদার সময়ই কেবল বোঝা যায়। এক ব্যাগ রক্তের জন্য ছোটাছুটি করতে হয় রোগীর আত্মীয়স্বজনকে। ক্লান্ত হয়ে ফিরতে হয় অনেক সময়। কিন্তু রোগীর শরীর তো মানে না, তার রক্ত চাই। রক্তের অভাবে একসময় সবার মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।  আমাদের দেশে সব সময়ই রক্তের স্বল্পতা বিরাজ করে, রক্তদাতাদের অপ্রতুলতাই এর ‍প্রধানতম কারণ।

প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকেই মারা যান, বেশির ভাগই রক্তক্ষরণজনিত কারণে। রক্ত সঠিক সময়ে সংগ্রহ করে পরিসঞ্চালন করা গেলে অনেক জীবনই বাঁচানো সম্ভব। এ প্রাণগুলো অকালে ঝরে যাওয়া রোধ করতে প্রয়োজন আমাদের একটু সহানুভূতি ও সচেতনতা। আমাদের এক ব্যাগ রক্তই পারে এদের জীবন বাঁচাতে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে রক্তদানের হার খুবই কম। তবে এসব দেশে আবার রক্তের চাহিদা বেশি। তাই এসব দেশে চাহিদার তুলনার সরবরাহ সব সময় কম থাকে। রক্ত যেহেতু পরীক্ষাগারে তৈরি করা যায় না, তাই এর চাহিদা পূরণ হতে পারে কেবল রক্তদানের মাধ্যমে।

এখন আমাদের দেশেও রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ছে। তবে এখনো তা পর্যাপ্ত নয়। এখনো রক্তের জন্য পেশাদার রক্তদাতার ওপর নির্ভর করতে হয়। যদিও দেশে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের দূষিত রক্তের ওপর নির্ভরতা আজ থেকে আট-দশ বছর আগেও ছিল ৭০ শতাংশের মতো। তবে জনসচেতনতা বাড়ায় এবং সরকারি নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির নানা আয়োজন ও উদ্যোগে রক্তের উৎসের এই সংস্থান বর্তমানে রোগীর আত্মীয়স্বজন (৮০ শতাংশ) স্বেচ্ছা রক্তদাতা এবং ১০ শতাংশ পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের রক্তে হয়ে থাকে।

এইতো কয়েকদিন আগে একটি সেমিনারে এক চিকিৎসক বলছিলেন, দেশের জনগোষ্ঠীর ২ শতাংশ লোক বছরে একবার রক্তদান করলে আমাদের দেশে রক্তের অভাব থাকবে না। তবে, ২০২০ সালে আমাদের দেশে চাহিদার শতভাগ স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর বিশ্বে ১০৭ কোটি ব্যাগ রক্ত সংগৃহীত হয়। এর মধ্যে ৩১ শতাংশ স্বেচ্ছা রক্তদাতা আর ৫৯ শতাংশ আত্মীয় রক্তদাতা। বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে শতভাগ স্বেচ্ছা রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছা রক্তদানের হার প্রতি ১০০০-এ ৪০ জন আর উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি ১০০০-এ ৪ জনেরও কম।

রক্তের ঘাটতির বিপুল এ চাহিদা পূরণের জন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম চালানোর কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের কার্যক্রম সরকারের পাশাপশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালিয়েও যাচ্ছে।  কিন্তু রক্তদাতা তো অপ্রতুল।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। অগণিত মুমূর্ষু রোগীকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করে যারা জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেন, তাদের দানের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ও উদ্বুদ্ধকরণের মধ্যে রয়েছে এ দিবসের তাৎপর্য।

রক্তের গ্রুপের আবিষ্কারক কার্ল ল্যান্ডইস্টেনার জন্মদিন ১৮৬৮ সালের আজকের দিনে (১৪ জুন)। তার স্মরণে ২০০৪ সাল থেকে এ দিবসকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। তবে এই রক্তদাতা দিবসের শুরুর ইতিহাস আরো আগে থেকে। যতদূর জানি, ১৯৯৫ সালের ১৪ জুন এই দিবসটি পালন করা হয়। তখন অবশ্য দিবসটি জাতীয়ভাবে পালিত হয়। আন্তর্জাতিক রক্তদাতা ফেডারেশনের উদ্যোগে এই দিনে প্রথম রক্তদাতা দিবস পালিত হয়।

তখন থেকেই রক্তদানের বিষয়ে অন্যকে সচেতন করার কাজ করে যাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। আমরা জানি, রক্তদান একটি মহৎ কাজ। নিজের আনন্দ ও শান্তির জন্য রক্ত দেওয়া উচিত। এ জন্য সবাইকে ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করা খুব বেশি প্রয়োজন।

একবার ভাবুন, পৃথিবীতে এই একটি কাজ আছে যার দ্বারা, একজনের ত্যাগে আরেকজন বাঁচার শক্তি পায়। আপনার এক ব্যাগ রক্ত পারে একটি জীবন বাঁচাতে। একমাত্র রক্তদাতারাই পারেন নিজে সুস্থ থেকে অন্যকে বাঁচাতে। মনে রাখবেন, আপনার দান করা রক্ত শুধু একজন মানুষের প্রাণ রক্ষাই করেনা, একটি পরিবারকে ধ্বংসের হাত থেকেও রক্ষা করে। রক্ত দিন, অপরকে বাঁচান, নিজেও বাঁচুন। রক্তই হোক আমাদের আত্মার বাঁধন।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুন ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়