ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

আজন্ম সংগ্রামী মানুষ, ছিলেন গণমানুষের কবিও

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৩০, ১৫ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আজন্ম সংগ্রামী মানুষ, ছিলেন গণমানুষের কবিও

হাসান মাহামুদ : আপাদমস্তক একজন কবি, সাম্যবাদী সাহিত্যিক, তিনিই আবার আজন্ম সংগ্রামী মানুষ। দুটো বিপরীত সত্তা হলেও রথীন্দ্রকান্তনাথ ঘটক চৌধুরী ছিলেন তেমনই একজন উপমাতীত ব্যক্তিত্ব।

তিনি ছিলেন সত্যিকারের গণমানুষের কবি। আমৃত্যু সৃষ্টি করে গেছেন মানুষের মুক্তিকামী সাহিত্য। মানুষই ছিল তার সাহিত্যের প্রকৃত আরাধনা। মরমী প্রেমিকের মতো তিনি আমৃত্যু মানুষের অধিকার, সাম্য মৈত্রী, সত্য সুন্দর মানবতার জয়গান করছেন- তার চিন্তা ও সৃষ্টিকর্মে। কবিতা গল্প প্রবন্ধ নাটক নাটিকা পত্রসাহিত্যে তার দুর্লভ রুচির পরিচয় মেলে আদর্শিক নীতি ও নিষ্ঠায়। সুসাহিত্য ও সুসংস্কৃতির লেখক হিসেবে সমাজের দায়বদ্ধতা সচেতনভাবে তার জীবন ও সাহিত্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কাগজ সম্পাদনা, আবৃত্তি, উপস্থাপনা, প্রতিবেদন, কথিকাপাঠ, সঙ্গীত রচনা করেছেন অসংখ্য। কবি রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতনের ছাত্র হয়েও নিজের এলাকার মানুষের উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের স্বার্থে তিনি নিজ জেলা শরীয়তপুরের পালং ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দীর্ঘকাল পালন করেছেন সততার সঙ্গে।

খুব কম মানুষই এতো বেশি গুণের সম্ভার নিয়ে জন্ম নেয়। রথীন্দ্রকান্ত জন্ম নিয়েছিলেন। ১৯২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর তিনি বর্তমান শরীয়তপুর জেলার দক্ষিণ বালুচর গ্রামে এক শিক্ষিত সংস্কৃতিমান পেশাজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

জমিদার পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি কখনোই জমিদারপ্রথার পক্ষে ছিলেন না। উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল জমিদারির মালিক হলেও স্কুলজীবনে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তিনি ছিলেন সক্রিয় কর্মী। এর জন্য অবশ্য তাকে স্কুলজীবনেই দেড় বছর কারাবাসে কাটাতে হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনাড়ম্বর রুচিস্নিগ্ধতা-মানবহিতৈষণা-লোকায়ত ঐতিহ্যের অনুরাগী এবং মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি, সবই তিনি মনের ভেতর লালন করেছেন তারুণ্য থেকে মৃত্যু অবধি। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজকর্মে তার আত্মনিয়োগ প্রচলিত সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু নিজেকে কখনোই প্রকাশ করতে চাননি।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর সাহিত্যের হাতে খড়ি শৈশবে পারিবারিক পরিমন্ডলে। তৎকালীন প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ ও পারিবারিক শিক্ষার প্রেরণায় ব্রিটিশবিরোধী, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিপ্লবী অনুশীলন দলে যুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পাস করে পিতার হাত ধরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশ্রম শিষ্যরূপে শান্তি নিকেতনে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। শান্তি নিকেতনে অধ্যয়নকালে ‘সাহিত্যিকা’ সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪০ সালে বিশ্ব কবির সভাপতিত্বে সাহিত্য সভায় রথীন্দ্রকান্ত স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। ১৯৪১ সালে শান্তি নিকেতন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির পর মার্কসীয় দর্শনের রাজনৈতিক, কবি, সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে। তিনি আমৃত্যু শ্রেণি সংগ্রাম ও বামপন্থী সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি অবিচল বিশ্বাসী ছিলেন।

তিনি কবিতা গল্প নাটক নাটিকা প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রহসন রচনা করেছেন অসংখ্য। প্রেমের কবিতায় তিনি জীবনের আশা ও সংগ্রামকে একাত্ম করেছেন। প্রবন্ধ গল্পও তার কবিতার সহোদর ছিল আজীবন। প্রেম মানবতা উদারতা সেবার ব্যাপকতা তার সৃষ্টি কর্মে প্রতিফলন ঘটে। শিক্ষক ও সমাজসেবক হিসেবে দীর্ঘকাল নিয়োজিত থেকেও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিকে জীবনের অপরিহার্য বিষয় হিসেবে নিয়েছিলেন।

এই সাহিত্যমনা মানুষটির ছিল বীরত্বপূর্ণ মানসিকতাও। নিজ এলাকায় আর্তমানবতার সেবায় লঙ্গরখানা রিলিফ আন্দোলন, মেডিক্যাল সেবা, হাসপাতাল দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন, কুটির শিল্প চর্চার প্রচলনসহ অসংখ্য কল্যাণমুখী ও মহৎ কার্যক্রমে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী নিজেকে আত্মোৎসর্গ করেছেন। আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে শ্রেণি সংগ্রামে তিনি বৃহত্তর ফরিদপুরে নেতৃত্ব দেন।

গণমানসে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনকারী ত্যাগী মানুষ কবি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী। নিজ এলাকায় স্কুল, কলেজ, স্টেডিয়াম, পাবলিক লাইব্রেরি, শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আপাদমস্তক বিপ্লবী কবি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত থেকে আড়াই শতাধিক প্রবন্ধ, নিবন্ধ, শতাধিক ছোটগল্প, বেশ কিছু নাটক, নাটিকা, অর্ধ শতাধিক সঙ্গীত, কিছু প্রহসন রচনা করেন। দেশ আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতী, অমৃতবাজার, দৈনিক পাকিস্তানসহ দুই বাংলার অধিকাংশ ম্যাগাজিন ও দৈনিকে তার লেখা প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া সহস্রাধিক পত্র রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী গ্রন্থ নিকেতনে সংরক্ষিত রয়েছে। রেডিও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বেতারে তালিকাভুক্ত গীতিকার ও কথিকা পাঠক হিসেবেও তিনি সুনাম অর্জন করেন।

রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর গ্রন্থ সমূহের মধ্যে ‘কয়েকজন লোক কবি ও প্রসঙ্গত’ (লোক গবেষণা গ্রন্থ) ‘পূর্বাপর’ (কাব্যগ্রন্থ) সুকান্তে হস্তাক্ষরে কবিতার পান্ডুলিপি (গবেষণা গ্রন্থ) ‘ঝরাপাতা’ (গল্পগ্রন্থ) ‘রবীন্দ্র তরুমূলে’ (শান্তি নিকেতন শিক্ষাজীবনের স্মৃতি) ‘পদক্ষেপ’ (কবিতা গ্রন্থ) ‘অভ্যুদয়’ (কবিতা গ্রন্থ) উল্লেখযোগ্য। ’৮৮ সালে রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর মৃত্যুর পর- কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক কায়েস আহমেদ রচিত রথীন্দ্র জীবনী বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। রাজনীতি, শিক্ষকতা, সমাজগঠন সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করলেও রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর স্বভাবধর্ম ছিল সাহিত্য চর্চায় নিবেদিত।

এখানো প্রকাশের অপেক্ষায় রয়ে গেছে রথীন্দ্রকান্তকে লেখা বিভিন্ন সাহিত্যিক ও গুণীজনের চিঠিপত্র সংকলন। তার মৃত্যুর পর কেটে গেছে ২৯টি বছর। আগামীতে বাংলাদেশ যখন তার স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবে, সেই বছর রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ হিসেবেও চিহ্নিত হবে। তার জীবন ও স্বদেশের অভিযাত্রা যে এমনভাবে মিলে-মিশে রয়েছে সেটা নিছক কাকতালীয় নয়। বহু মানুষের অবদানের সম্মিলিত ফসল বাঙালির সংস্কৃতিমণ্ডিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। এই জাগরণে স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে নির্মাণের যেসব সাধনা তা অবশ্যই দৃষ্টিসীমায় রাখতে হবে আমাদের। সেখানে আরো অনেকের সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী।

এই উপমাতীত গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিত্ব ১৯৮৮ সালের আজকের দিনে (১৫ জুন) মৃত্যুবরণ করেন। তার সর্ম্পকে বিভিন্ন বোদ্ধা সাহিত্য-সমালোচকদের লেখা থেকে পাওয়া যায়, তিনি জীবন-কর্ম সবটুকু মানুষের কল্যাণে নিবেদন করে গেছেন। বিরল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী মানুষ হিসেবে তিনি প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের কাছে চির জাগ্রত রয়েছেন। তার সৃজনশীলতা বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে এক অনন্য সংযোজন। তার প্রতিটি সৃষ্টিকর্ম ভবিষ্যতের মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তার চিন্তা-চেতনা, সৃষ্টিশীলতা ও মানব প্রেম পশ্চাৎপদ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুন ২০১৭/হাসান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়