ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিষণ্ন মন বিবর্ণ ঈদ

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৩, ১৫ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিষণ্ন মন বিবর্ণ ঈদ

ক্যাপ্টেন তানভীর ও স্ত্রী টুকটুক

সাইফ বরকতুল্লাহ : জ্যৈষ্ঠের শেষ সন্ধ্যায় (৩১ জ্যৈষ্ঠ, ১৪ জুন ২০১৭) তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেল রাজধানীতে। রাত সাড়ে দশটায় অফিস শেষ করে বাসে বাসায় ফিরছিলাম। মৌচাক-মালিবাগ মোড় থেকে বেশ কয়েকজন যাত্রী উঠলেন বাসে। সবার হাতেই শপিং ব্যাগ।

তখন বাইরে অবশ্য বৃষ্টি নেই। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ঈদের শপিং করলেন ভাই! উনি হাসলেন। আমার মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল মফিজুর, দ্বীন মোহাম্মদ, ক্যাপ্টেন তানভীরের কথা।

দুই.
মফিজুর দিনমজুর। মা, স্ত্রী আর তিন সন্তানকে নিয়ে  ছিল সাজানো সংসার। অভাব-অনটন থাকলেও অন্তত মুখে হাসিটা ছিল একদিন আগেও। অথচ প্রকৃতির কী নির্মম পরিহাস, মফিজুরের সেই মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে পাহাড় ধস। ভারি বৃষ্টিতে মঙ্গলবার রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নের মঘাইছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে সবাইকে হারিয়েছেন মফিজুর। সঙ্গে নতুন কেনা ঘরের আসবাবপত্রও গেছে মাটির গর্ভে। পরনের শার্ট আর লুঙ্গি ছাড়া মফিজুরের এখন কিছুই নেই।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মফিজুর বলেন, ‘মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে সবাই বাড়িতে ছিল। খুব বৃষ্টি পড়ছিল। সকালে কাজের খোঁজে বের হয়ে বাজারের একটি দোকানে গিয়ে বসি। তখন পাশের বাড়ি থেকে খালাত বোনের ফোন পেয়ে ছুটে আসি। এসে দেখি ঘরের ওপর মাটি চাপা। মুনমুনকে এলাকার লোকজন মিলে দেড় ঘণ্টা পর মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করে। এরপর স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে তিনি জানান মুনমুন মারা গেছে। অনেক কষ্টে ঘরে কিছু জিনিসপত্র কিনেছিলাম। পরিবারের সবাইকে হারালাম। জিনিসপত্রও সব গেছে। এখন আমার কিছুই নেই।’ [সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৪.৬.২০১৭ ]

একই অবস্থা ইটভাটার শ্রমিক দ্বীন মোহাম্মদের (৫০)। পাহাড় ধসে স্ত্রী ও তার সঙ্গে দুই নাতি পারভেজ (৭) ও হোসেন আহমেদকে (১৭) হারিয়েছেন তিনি। আর ঘরের সামনে বসে থাকা অবস্থায় মাটির নীচে চাপা পড়ে আহত হন দ্বীন মোহাম্মদের ছেলে ইউসুফ (১৯)। অথচ সামনেই  ঈদ। কত আনন্দ করতে চেয়েছিলেন ঈদে ওরা। কিন্তু সব শেষ।

তিন.
বিয়ে করেছেন মাত্র ১০ মাস আগে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পেজটি বিয়ের স্মরণীয় মুহূর্তের ছবিতে এখনও সতেজ। বলছি ক্যাপ্টেন তানভীর সালাম শান্ত’র কথা। প্রতিটি ছবিতে হাতে হাত রেখে হাস্যোজ্জ্বল স্বামী-স্ত্রী। হয়তো কথা ছিল জীবনভর একসঙ্গে চলার। স্ত্রীর হাতের মেহেদির রঙও মুছে যায়নি। কিন্তু বছর না পেরোতেই তানভীর নবপরিণীতাকে একা রেখে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মঙ্গলবার পাহাড়ধসে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করতে তিনি অংশ নেন উদ্ধার অভিযানে। কিন্তু ফেরা হয়নি তার। মাটিচাপা পড়ে মৃত্যু হয়। পটুয়াখালী জেলার বাউফলের ছেলে তানভীর ২০০৯ সালে যোগদান করেন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে। ৬৪তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে কমিশন লাভ করেন তিনি। পরে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় উন্নীত হন। বিয়ে করেন ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর। তানভীর ও তার স্ত্রীর ফেসবুক ওয়ালে বিয়ের স্মরণীয় মুহূর্তের ছবি এখনও সজীব। তানভীরের প্রোফাইল ছবিও তার বিয়ের ছবি। [সূত্র : জাগোনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৪.৬.২০১৭ ]

চার.
তরুণ কবি শাম্মী ইসলাম নীলা। ১৩ জুন রাতে ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আমার বন্ধু চট্রগ্রাম পলিটেকনিকের ৪র্থ পর্বের ইলেক্ট্রনিকস বিভাগের ছাত্র ইশতিয়াক মাহমুদ ও তার পরিবারের সবাই সকালে পাহাড় ধসে ইন্তেকাল করেছে (ইন্নালিল্লাহি...)। সবাই দোয়া করবেন আল্লাহ জেনো আমার বন্ধুকে এবং তার পরিবারের সবাইকে জান্নাতবাসী করে ( আমিন)। শুধু তার আম্মু বেঁচে আছে...।

আমার প্রাক্তন সহকর্মী রাঙামাটির আলমগীর ফেসবুকে লিখেছেন, এতদিন দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের নিউজ করেছি। নিয়তির নির্মমতায় নিজেই এখন নিউজের অংশ হয়ে গেলাম। হে পরোয়ারদেগার রহম করুন আমায়। এই কঠিনতম মুহূর্ত থেকে আমায় উদ্ধার করুন আল্লাহ। তার আরো একটি স্ট্যাটাস, কিছুই ভালো লাগছেনা। নানা চিন্তায় মনের ভেতরটা চিনচিন করছে। আশ্রয় কেন্দ্রের বাইরে খোলা আকাশের নিচে বসে ভাবছি এই দুর্যোগ কিভাবে কাটিয়ে উঠবো।

এসব স্ট্যাটাস পড়ে মনটা আরো বিষণ্ণ হয়ে গেল। আর কদিন পরেই ঈদ। সবাই যখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঈদের আর তখন ওদের অবস্থার কথা একবার ভেবে নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। কীভাবে ঈদ উৎসব হবে স্বজন হারাদের? ওরা কী এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারবে? হাজারো প্রশ্ন মাথায়।

পাঁচ.
সবশেষ খবর অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় পাহাড় ধসে মারা গেছেন ১৫৩ জন। গত এক দশকে পাহাড় ধসে প্রাণহানির সবচেয়ে বড় ঘটনা এটাই। এই বিপর্যয়ের পর পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া হবে তা নিয়ে এখন সর্বত্রই আলোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা প্রতিবাদ হচ্ছে। হয়তো আরো কিছুদিন চলবে এসব ঘটনা। কিন্তু যারা স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু হারাল তাদের কী হবে? পাহাড় কাটা কী থামবে? পাহাড়ে বসতি স্থাপন কী বন্ধ হবে? দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী গেয়েছেন- পাহাড়ের কান্না দেখে তোমরা তাকে ঝরণা বলো/ওই পাহাড়টা বোবা বলেই কিছু বলে না/তোমরা কেন বোঝো না যে/কারো বুকের দুঃখ নিয়ে কাব্য চলে না ...।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ জুন ২০১৭/সাইফ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়