ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কীর্তিমান গাজীউল হক

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ১৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কীর্তিমান গাজীউল হক

হাসান মাহামুদ : ‘ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না/ এই একুশে ফেব্রুয়ারি, ভুলব না’ গানটির মাধ্যমে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত ভাষা দিবসের প্রভাতফেরি করা হতো। আমরা অনেকেই জানি না এই গানটির রচয়িতা মহান ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজীউল হক।

আবার অবিভক্ত ভারতবর্ষের একমাত্র কিশোর যে সরকারি ভবন থেকে বৃটিশ পতাকা নামিয়ে ফেলার অপরাধে স্কুলের ছাত্রাবস্থায় কারাবরণকারীও সেই গাজীউল হক।

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি এমন অসংখ্য বীরত্ব ও অর্জন রয়েছে তার। কিন্তু আমাদের উদাসীনতার কারনে ইতিহাসে পরিপূর্ণ বিকশিত হয়নি এই ভাষা সৈনিক।

আমাদের দেশে কারো কারো একটি-দুটি কীর্তি কোনো কারণে বহুল উল্লিখিত হয়। কিন্তু সেই মানুষটিরই জীবনের অন্যান্য উজ্জ্বলতা এই একটি কীর্তিরই বহুল উচ্চারণের নামাবলিতে ঢাকা পড়ে যায়। শুধু তাই নয়, বহুল উল্লিখিত কীর্তিটিও যথেষ্ট পরিচ্ছন্নভাবে বিশ্লেষিত বা ব্যাখ্যাত হয় না বলে সেই মানুষটি শেষ পর্যন্ত একটা অস্পষ্ট কিংবদন্তী হয়ে বেঁচে থাকেন।

ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের বেলাতেও এমনটিই ঘটেছে। গাজীউল হক যে ভাষাসৈনিক ছিলেন সে-কথাটিই কেবলমাত্র প্রচারিত তথ্য, কিন্তু ভাষাসৈনিক হিসাবে তার ভূমিকাটি বায়ান্ন’র ভাষা-আন্দোলনে ঠিক কী ছিল তা তার সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মীদের জানা থাকলেও উত্তর প্রজন্মের এমনকি সচেতন মানুষদেরও অনেকেরই তেমন জানা নেই। এর জন্য আমাদের সমাজের সামগ্রিক ইতিহাস-চেতনার অভাবই দায়ী।

এ-কথা ঠিক যে, ভাষা আন্দোলনে গাজীউল হকের ভূমিকা ছিল তার সমগ্র জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র হলে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার ছাত্রসভায় গাজীউল হক সভাপতিত্ব করেন এবং সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য মন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। এ আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিস আদালতে রাজপথে সবখানে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠের পাশে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত) গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়। এরপরের কাহিনী আমাদের জানা। বীর বাঙ্গালী যুবকদের সংগ্রাম ও বুকের তাজা রক্তের বিসর্জনের কারণে আমরা আজ বাংলায় কথা বলি।

গাজীউল হকের সাহসিকতার পরিচয় কেবল ভাষা আন্দোলনের সময়ই দেখা যায়নি। পরবর্তী সকল অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন, সাংস্কৃতিক ও জাতীয় সংগ্রামে গাজীউল হক অংশ নিয়েছেন। ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪-র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রথমে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠক হিসাবে ও পরে জাতীয় পর্যায়ের লেখক এবং সংগঠকের ভূমিকায় তাকে পাওয়া গেছে।

১৯৭১ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। ২৭ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল ৬০ জন পুলিশের একটি দল পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ১ এপ্রিল গাজীউল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা আড়িয়া ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ চালিয়ে ৬৯ জন পাক সেনাকে বন্দি করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৫৮ ট্রাক গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। ১৬ এপ্রিল গাজীউল হক অস্ত্র সংগ্রহ এবং অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে উত্তরাঞ্চল যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ভারত যান। হিলিতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে একটি খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৬ সালে সামরিক আদালতে যে বিচার হয়েছিল কর্নেল তাহেরসহ অনেক বিপ্লবীদের সেখানে কর্নেল তাহেরের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক। এটি তখনকার সময়ে ছিল অন্যরকম একটি দুঃসাহসিক কাজ। তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল ১৯৮০-র দশক জুড়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও।

১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত। সে আদালতে আজকের মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের ফাঁসির রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। আর সেই গণআদালতের রায়টি পড়ে শোনান ভাষা সৈনিক গাজীউল হক।
 

সময়ের তাগিদে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে গাজীউল হক কখনও হয়েছিলেন সাংবাদিক, পত্রিকার হকার, প্রাবন্ধিক, কথাশিল্পী, কবি ও গীতিকার। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে গাজীউল হক তার সৃজনশীলতারও পরিচয় দিয়েছেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৯টি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রথম বই লিখেন গাজীউল হক।  বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর বেশ ক’টি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। তার লেখা গ্রন্থ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ব্যাপক সাড়া জাগায়।

বাংলা একাডেমি ও দেশের বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় বিদেশেও তার একাধিক গ্রন্থ এবং নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য তিনি যে আপোসহীন সংগ্রাম করে আসছিলেন তারই প্রমাণ রয়েছে তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘উচ্চতর আদালতে বাংলা প্রচলন’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তনে গাজীউল হকসহ আরেক ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি দেওয়া হয়। ২০০০ সালে তিনি একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০১ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে ‘জাহানারা ইমাম পদক’ পান তিনি। ২০০৪ সালে পান ‘শের-ই-বাংলা জাতীয় পুরস্কার’৷ তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যও ছিলেন। এছাড়া গাজীউল হক প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি)  চেয়ারম্যান ছিলেন।

আমরা অনেকেই জানি না, ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরবর্তীতে ছাত্রনেতা ইশতিয়াক, মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান প্রমুখের আন্দোলনের চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই মহান সৈনিককে এমএ ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয় ।

ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের মধ্যে আমরা অনেকেই জানি শহীদ ভাষা সৈনিক সালামের বাড়ি ফেনীতে। কিন্তু গাজীউল হকও যে ফেনীর সন্তান তাও আমরা অনেকে জানিনা। গাজীউল হকের জন্ম ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ১৩৩৫ সালের ১ ফাগুন ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে।

বাড়ির পাশের মক্তব থেকে তার শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৩৫ সালে হাজী মোহাম্মদ মহসীন বৃত্তি নিয়ে নিম্ন প্রাইমারি পাস করে কাশীপুর উচ্চ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৩৭ সালে পুনরায় চার টাকার বৃত্তি নিয়ে উচ্চ প্রাইমারি পাস করে ছাগলনাইয়া হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ছাত্রজীবনেই প্রতিবাদী কিশোর হিসেবে রাজনীতির প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ বিরোধী মিছিলে থাকা অবস্থায় ফেনী জেলার অন্তর্গত ছাগলনাইয়ার এক সরকারি অফিসের উপর থেকে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে মুসলিম লীগের পতাকা লাগানোর অপরাধে তাকে জেলে যেতে হয়।

দেশবরেণ্য ধর্মীয় গুরু সুপন্ডিত পিতা মাওলানা সিরাজুল হক এবং তার পরিবার কিশোরের কর্মকান্ড দেখে দিশাহারা হয়ে যান। কি করবেন ভেবে না পেয়ে স্কুল শিক্ষকের পরামর্শে নিরাপত্তার জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়ায়। ভর্তি করা হয় বগুড়া জিলা স্কুলে। ১৯৪৬ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ছাত্র রাজনীতিতে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েন।

গাজীউল হক লিখেছিলেন, ‘অক্ষমতার লজ্জার চাইতে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে?’ বাংলাভাষার প্রথম প্রাণপুরুষ ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সর্ম্পকে একবার গাজীউল হককে লিখতে অনুরোধ করেছিলেন একজন সম্পাদক। তখন তিনি নিবন্ধের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘একটা অনুরোধ, একটা লেখা দিতে হবে ধীরেনদার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। ধীরেনদা অর্থাৎ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। লিখি আর ছিঁড়ে ফেলি। কী নিদারুণ লজ্জা যে বারবার বাধা দিচ্ছে লিখতে তা বোঝাই কী করে? ধীরেনদার কাছে যে আমাদের অপরিসীম ঋণ! তাই তো আজকের এই মুহূর্তে তাঁকে স্মরণ করতে একটা লজ্জা, একটা গ্লানি চেপে ধরে’।

কিন্তু আমরা অবলীলায় জাতীয় বীরদের কথা, তাদের অর্জন ভুলে যেতে পারি। কোনো রকম গ্লানি তো নয়ই, লজ্জাও পাই না আমরা।
 

মহান এই ভাষা সৈনিক ২০০৯ সালের আজকের দিনে (১৭ জুন) বিকেলে রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। কিন্তু জীবনব্যাপী সংগ্রাম আর আদর্শের যে দৃষ্টান্ত তার কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি রেখে গেছেন, তা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উদীপ্ত করবে। এই মহান যোদ্ধা, যার সারাজীবনের কর্মই দেশ ও মানুষের প্রতি এক পরম প্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে এবং থাকবে। শুধু আমরা ঋণী হয়ে থাকবো এসব মহাপুরুষের কাছে, তাদের যোগ্য সম্মানটুকু দিতে না পারার অপরাধে।

লেখক: সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ জুন ২০১৭/হাসান/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়