ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

এভারেস্ট আজও পর্বতারোহীদের প্রধান লক্ষ্য || মুসা ইব্রাহীম

মুসা ইব্রাহীম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২১ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এভারেস্ট আজও পর্বতারোহীদের প্রধান লক্ষ্য || মুসা ইব্রাহীম

এভারেস্টের চূড়ায় দেশের পতাকা হাতে লেখক

মাছ পানির ওপরে তুললে ভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে না নিতে পেরে যেভাবে খাবি খেতে থাকে, এভারেস্ট অভিযানে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতা পার হওয়ার পর মানুষেরও একই ধরনের সমস্যা হতে থাকে। মূলত উচ্চতাজনিত কারণে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় সৃষ্ট শারীরিক সমস্যাগুলো স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে’র এভারেস্ট চূড়ায় প্রথম পা রাখার ১৯৫৩ সালের ২৯ মে থেকে আজ পর্যন্ত একইরকম আছে। মানুষ পর্বতারোহণে বহু কৃতিত্বের স্বাক্ষর আজকাল রাখছে ঠিকই। কিন্তু প্রকৃতিকে বশ মানাতে একদমই পারেনি। পর্বতারোহণে সবাই প্রকৃতির কৃপা খোঁজে। কখন আবহাওয়া ভালো থাকবে, কখন বাতাসে গোঙানির আওয়াজ থাকবে না, কখন তুষারঝড়ের হুমকি থাকবে না, কখন ঠান্ডাটা সহনীয় থাকবে ইত্যাদি বিষয়গুলো আজও মানুষ পরাজিত করতে পারেনি। বরং এদের তাণ্ডব পাশ কাটানোর সুযোগ অনুসন্ধান করে মানুষ পর্বত জয়ের জন্য বের হয়। যদিও এডমন্ড হিলারি এভারেস্ট জয়ের পর তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছিলেন- উই হ্যাভ নকড্ দ্য বাস্টার্ড অফ।

তাঁর বলার যথেষ্ট কারণও অবশ্য আছে। এই এভারেস্টের পেছনে লেগেছিল বিক্রমপুরের বাঙালি গণিতবিদ ও জরিপ কর্মকর্তা রাধানাথ শিকদার ১৮৫২ সালে যখন ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা নয়, পিক ফিফটিন বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্বত হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেদিন ব্রিটিশ সার্ভে ক্যাম্প তো বটেই, বিশ্বে তোলপাড় পড়ে গেছে। রাধানাথ শিকদার ত্রিকোণমিতি ব্যবহার করে যখন মেপে দেখালেন পিক ফিফটিনের উচ্চতা প্রায় ২৯ হাজার ফুট (কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতের উচ্চতা ২৮ হাজার ১৬৯ ফুট এবং বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত), সবাই তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন। এরপর ১৮৫৬ সালে পিক ফিফটিনের উচ্চতা আনুষ্ঠানিকভাবে ২৯ হাজার ২ ফুট বলে স্বীকৃতি লাভ করে (যদিও এখন নেপাল ও চায়না সরকার এভারেস্টের উচ্চতা ২৯ হাজার ৩৫ ফুট বা ৮ হাজার ৮শ ৪৮ দশমিক ১৩ মিটার বলে স্বীকৃতি দিয়েছে)। আর ১৮৬৫ সালে তৎকালীন সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জর্জ এভারেস্টের নামে পিক ফিফটিনের নামকরণের প্রস্তাব এলে বৃটিশ রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটিতে এর নাম ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ হিসেবে গৃহীত হয়। তবে নেপালে একে সাগরমাথা (সমুদ্রের সবচেয়ে উঁচু স্থান বা চূড়া) এবং তিব্বতে চোমালুংমা (পবিত্র মাতা) হিসেবে ডাকে স্থানীয়রা।

বলছিলাম এডমন্ড হিলারির কথা। তাদের এভারেস্ট জয়ের আগে মানুষ আরও ১২ বার এভারেস্ট জয়ের চেষ্টা করেছে। এটা শুরু হয়েছিল ১৯২১ সাল থেকে। আর ১৯২২ সালে এভারেস্টের দিকে ব্রিটিশ এক্সপেডিশনে জর্জ ফিঞ্চ (অস্ট্রেলিয়ান) ও ক্যাপ্টেন সি. জিওফ্রি ব্রুস (ব্রিটিশ) ২৩ মে প্রথমবারের মতো ৮ হাজার মিটারের মার্ক অতিক্রম করেন। তারা তিব্বতের দিক থেকে ৮ হাজার ৩২১ ফুট পর্যন্ত আরোহণ করার পর আবহাওয়া খারাপ হতে থাকলে নিচে নামতে বাধ্য হন। এটাই ছিল কোনো মানুষের সর্বপ্রথম কোনো পর্বতে ৮ হাজার মিটার উচ্চতা অতিক্রমের ঘটনা। এরপর এভারেস্টের দিকে তিব্বত থেকে ৯টি অভিযান (১৯২১, ১৯২২, ১৯২৪, ১৯৩৩, ১৯৩৪, ১৯৩৫, ১৯৩৬, ১৯৩৮ ও ১৯৪৭) পরিচালিত হয়েছে।

এ সময় তিব্বতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সরকারের প্রচণ্ড বিরোধ হলে চায়না সরকার তিব্বতের দিক থেকে সকল বহিরাগতদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে চীনের তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক একই সময়ে ১৯৫০ সালের দিকে নেপাল শাসন করতো রানা পরিবার। এই রানা পরিবারের একটা বিশ্বাস ছিল, তারা যদি বিদেশীদের প্রবেশে সুযোগ দেয়, তাহলে তাদের নেপালের ওপর থেকে দখল সরে যেতে পারে। এই ভয়টাই শেষ পর্যন্ত কাবু করে ফেলে রানা পরিবারকে। তারা বর্হিশক্তির চাপে নত হতে বাধ্য হয় এবং রাজা ত্রিভুবনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে কাঠমান্ডু ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে রাজা ত্রিভুবন রানা পরিবারের তুলনায় অনেকটাই উদারপন্থী ছিলেন। ফলে তিনি নেপাল দিয়ে এভারেস্টের দিকে অভিযান বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ফলে শুরু হয় নেপাল দিয়ে এভারেস্ট অভিযান। ১৯৫৩ সালের আগে মাত্র তিনটি অভিযান (১৯৫০, ১৯৫১ ও ১৯৫২) নেপাল বা এভারেস্টের দক্ষিণ দিক দিয়ে পরিচালিত হয়।

এর অর্থ হলো মানুষ ১৩তম প্রচেষ্টায় এভারেস্ট জয় করে (এখন ১৩ শুভ না অশুভ সংখ্যা, সেটা বিবেচনায় নিতে পারেন)। এখানে বলে রাখা ভালো যে ১৯৫৩ সালের ২৯ মে যখন স্যার এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে এভারেস্ট জয় করেন, সে সময় তারা ছিলেন দলনেতা কর্নেল জন হান্টের ‘সেকেন্ড চয়েস’। হান্টের প্রথম পছন্দের দলে ছিলেন টম বর্ডিলন এবং চার্লস ইভান্স। বর্ডিলন ও ইভান্স ১৯৫৩ সালের ২৬ মে চূড়ার ১০০ মিটার বা ৩০০ ফুট দূর থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁরা যখন ৮ হাজার সাড়ে সাতশ মিটার বা ২৮ হাজার সাতশ ফুট উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছান, ক্লান্তি-শ্রান্তি তাদের শেষ করে দিয়েছিল। অক্সিজেন সরঞ্জামের সমস্যা ও সময় ফুরিয়ে আসার কারণে বর্ডিলন ও ইভান্স ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আর ২৭ মে কর্নেল হান্ট তাঁর ‘সেকেন্ড চয়েস’ নিউজিল্যান্ডবাসী এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগেকে মাঠে নামিয়ে দেন। তেনজিং এর আগে ১৯৫২ সালের সুইস এক্সপেডিশনে এভারেস্টের দিকে এমন উচ্চতায় আরোহণ করেছিলেন, যা ওই সময়ের জন্য রেকর্ড ছিল। এই দল ২৯ মে সাউথ কোল রুট ধরে বেলা সাড়ে এগারোটায় এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছেছিল এবং সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস।

২.
এভারেস্ট জয়কে পর্বতারোহণে অলিম্পিকের স্বর্ণপদক জয়ের সমান মর্যাদা দেয়ার একটা অলিখিত সমঝোতা রয়েছে বোদ্ধাদের মধ্যে। কারণটা হলো এভারেস্টের এনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে খ্যাত মিস এলিজাবেথ হাউলির হিসাব মতে ১৯৫৩ সালের ২৯ মে থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এভারেস্টকে ১৫টি রুট ধরে ৪ হাজার ৪৬৯ জন মানুষ ৭ হাজার ৬৪৬ বার জয় করেছেন। আর এভারেস্ট আরোহণ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২৮২ জন পর্বতারোহী।

বিশ্বে যতো পর্বতারোহী আছেন, তাদের মধ্যে এভারেস্ট অভিযানে নামার যৌক্তিকতাটুকু সবচেয়ে অনুপুঙ্ক্ষ বুঝিয়েছিলেন ব্রিটিশ পর্বতারোহী জর্জ লেই ম্যালরি তার ‘বিকজ ইটজ দেয়ার’ কথাটুকু দিয়ে। তার হাত ধরেই সর্বপ্রথম ১৯২৪ সালে এভারেস্ট চূড়া জয়ের জন্য প্রথম অভিযান পরিচালিত হয়েছিল (১৯২১ ও ১৯২২ সালের অভিযান ছিল মূলত সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যে, এভারেস্টের দিকে অভিযান করা যায় কি না, তা বুঝতে)। ১৯২৪ সালে ম্যালরির সঙ্গী ছিলেন অ্যান্ড্রু স্যান্ডি আরভাইন। সেবার তিব্বতের রুট ধরে এভারেস্ট চূড়ার একেবারে দুয়েকশ মিটার নিচ থেকে তারা প্রচণ্ড তুষারঝড়ে পড়ে এভারেস্টের উত্তর-পূর্ব রিজ থেকে হারিয়ে যান। ১৯৯৯ সালে আরেক অভিযানে এভারেস্ট চূড়ার মাত্র প্রায় ছয়শ ফুটের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল ম্যালরির মৃতদেহ। এভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল এভারেস্টে প্রথম পর্বতারোহণ উপাখ্যান। কিন্তু তাদের ক্যামেরাটি পাওয়া না যাওয়ায় তারাই এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছানো প্রথম ব্যক্তি কি না, তা নিয়ে আজও রহস্যের কোনো কুলকিনারা হয়নি। আর আমরা এটাও জানি যে, তেনজিং এভারেস্ট অভিমুখে তার সপ্তম প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলেন।

 


এই যে প্রায় সাড়ে চার হাজার পর্বতারোহী ও শেরপা এভারেস্ট জয় করেছেন, তাদের বেশিরভাগই একবাক্যে স্বীকার করেছেন- এভারেস্ট জয়টা আসলে প্রতীকী। পর্বতারোহীরা সেই দুর্গম, বন্ধুর, প্রাণহারী এভারেস্ট জয় করে না, জয় করে নিজেকে। কারণ পর্বতে তুষারঝড়সহ চরম বিরূপ আবহাওয়া, একঘেয়ে পরিবেশে দীর্ঘ সময় ধরে ধৈর্য্য পরীক্ষায় উৎরানো, মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা- এই বিষয়গুলোর ভিত্তিতে চরম কঠিন স্পোর্টসগুলোর মধ্যে পর্বতারোহণ এক নম্বরে। আর উচ্চতার কারণে এভারেস্ট অভিযানে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাও থাকে তীব্র মাত্রায়। অনেকেই তীব্রভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এভারেস্ট অভিযানে। আর ২৫ হাজার ফুট থেকে শুরু হওয়া ডেথ জোন ছাপিয়ে পর্বতারোহীরা আসলে নিজেকেই জয় করেন। ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উঁচু সেই চূড়া সমতলের মানুষদের বোঝার জন্য একটা উচ্চতামাত্র।

৩.
২০১০ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ সময় ৫টা ১৬ মিনিটে এভারেস্ট চূড়ায় লাল-সবুজ পতাকা পৌঁছানোর পর থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ৬৭তম এভারেস্টজয়ী দেশ। এদিন যখন এভারেস্ট চূড়ায় পা রেখে বাংলাদেশের পতাকা সেখানে উড়িয়েছিলাম সেই মুহূর্তে আমার মতো খুশি আর মনে হয় কারো হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু খুশি হওয়ার বদলে আমার মনে শঙ্কা ঢুকেছিল যে, যে পথে চূড়ায় এসে পৌঁছেছি, ঠিক সেই পথেই আমাকে নামতে হবে। ঠিকঠাক নামতে পারবো তো? বহু মানুষের প্রাণহীন দেহ দেখে এসেছি। খাড়া পথে উঠতে গিয়ে তো আমার অক্সিজেন টিউবটাই ফুটো হয়ে গিয়েছিল। আর পর্বতারোহীরা এভারেস্ট চূড়ায় পৌঁছানোর জন্যই তাদের সকল মানসিক আর শারীরিক শক্তি অনেক সময় ব্যয় করে ফেলে। ফলে নামার সময়ই দুর্ঘটনাগুলো বেশি হয়। পর্বতারোহীরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

সেকেন্ড স্টেপ নামার পরই যেমন স্কটিশ একজন পর্বতারোহীকে দেখলাম, তিনি তার আরোহণ সেখানেই সমাপ্ত করে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কারণ? তার অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছিল। তার কাছে যতোটুকু  অবশিষ্ট ছিল, তিনি সেটা ব্যবহার করে চূড়ার দিকে গেলে অক্সিজেনের অভাবে আর নাও ফিরতে পারেন। সে কারণে তিনি তার অভিযান বাতিল করলেন। এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটে এভারেস্ট অভিযানে। আর এভারেস্ট রিজের যে বিশালত্ব, তা রাতের বেলা আরোহণের কারণে যতো না সহজ মনে হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি বিপজ্জনক মনে হয় নামার সময়।

এসবের যে কোনোটাই সাধারণ চিন্তায় উপলদ্ধি করা কঠিন। সেখানে যারা গিয়েছেন, তাদের পক্ষেই শুধু পুরো পরিস্থিতি অনুধাবন করা সম্ভব। এমনকি যতোই আমি সাংবাদিকদের প্রশ্নে আমার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করি না কেন, কাউকেই আসলে পুরো পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলতে পারবো না। অনেকেই আবার জিজ্ঞেস করেন, সাম্প্রতিককালের ‘এভারেস্ট’ চলচ্চিত্রটি দেখেছি কি না? অনেকে বলেন, মুভিটা দেখতে গিয়ে আপনার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। শুনে একটু মুচকি হাসি। মনে মনে বলি, এটাও তো সত্যিকারের আরোহণ নয়। সুতরাং যা কিছু দেখানো হয়েছে, সবই পিকচার- পারফেক্ট মুভির জন্য পরিস্থিতি তৈরি করে দেখানো হয়েছে। বাস্তবতা আরও ভয়াবহ।

এই এভারেস্ট অভিযানে চূড়ায় পৌঁছার মধ্য দিয়ে পর্বতারোহীদের নতুন করে জন্ম হয়। তারা নিজেকে চিনতে পারেন। সাফল্যের প্রেরণা থেকে আরও চ্যালেঞ্জ গ্রহণে অগ্রগামী হয়ে ওঠেন। আসলে আমরা সবাই সফল হতে চাই। জীবনের প্রতিটি যুদ্ধে জয়ী হতে চাই। অনেকেই জিজ্ঞেস করেন,  আমি কেন এভারেস্টে গিয়েছিলাম? এভারেস্টে যাওয়ার পেছনে আমার অনুপ্রেরণা কী ছিল?

এর উত্তর হলো, আমাদের সবার জীবনে একটা করে এভারেস্ট আছে। সেটা জয় করার প্রাথমিক অনুপ্রেরণা ছিল বাস্তবের এভারেস্টকে জয় করার দৃঢ় স্পৃহা। এটাই এখন আমার চালিকাশক্তি। আমি জানি আমার সামর্থ্য। সেটা ভর করেই এখন আগামী দিনের কাজগুলোর সাফল্য দেখতে চাই।

বিশ্বের সবচেয়ে সফল অ্যাডভেঞ্চারকারী ধরা হয় আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াবাসী জন গডার্ডকে। তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে তার ১২৭টি লক্ষ্য অর্জনের তালিকা তৈরি করেছিলেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি সেই লক্ষ্যের ১০৯টি অর্জন করেছেন। এসব লক্ষ্যের কোনোটাই সাধারণ কোনো বিষয় ছিল না। একাই বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ নীলনদ পাড়ি দেয়া থেকে শুরু করে, বিশ্বের বহু নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে উচ্চতর লেখাপড়া করা, জেট প্লেন চালানো, ৪০ ফুট পানির নিচে ডাইভ দিয়ে আড়াই মিনিট দম ধরে রাখা এবং বিশ্বের প্রায় পনেরোটি পর্বত জয়ের তালিকায় এভারেস্টও রয়েছে। একজন মানুষের পক্ষে যে আসলে বহু কিছু করা সম্ভব, সেটা তিনি করে দেখাতে চেয়েছেন। তিনিই আমার প্রেরণা।

আপনারা যদি এভারেস্টের মতো জীবনের সব জায়গায় নিজেকে সফল দেখতে চান, তাহলে কয়েকটা বিষয় অবশ্যই মনে গেঁথে নিতে হবে। তা হলো স্বপ্ন দেখতে হবে, নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রাখতে হবে। লক্ষ্য স্থির করে অর্জনের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্বপ্ন বাস্তব করে তুলতে বা লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা করতে হবে, আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে সুশৃঙ্খল হয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নিতে হবে। কাজে ফাঁকি দেয়া যাবে না। যদি কোনো বাধা আসে, তাহলে সেটাকে পেছনে ফেলে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলে ভাগ্যই এগিয়ে এসে ধরা দেবে। একটা বড় বিষয়- জীবনকে এমন সৎভাবে উপস্থাপন করতে হবে যেন তা অন্যের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকে। নিজের সম্মান বজায় রাখার স্বার্থে জ্ঞানের স্তর এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যে জ্ঞানের আলো সারাজীবন জ্বলতে থাকে। তাহলেই সবাই আপনাকে সম্মানের চূড়ায় বসিয়ে দেবে। সব শেষে একটা কথা কখনোই ভুলে গেলে চলবে না। তা হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের দেশই প্রথম এবং দেশের পতাকা যেন সবসময় প্রত্যেকের হৃদয়ে ওড়ে।

এভারেস্ট জয়ের মধ্য দিয়ে আমরা বাঁচার, প্রতিকূলতা ছাপিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা পাই। এই প্রেরণা কাজে লাগিয়ে যদি এখন প্রিয় লাল-সবুজ পতাকা বুকে ধারণ করে প্রিয় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যয়ী হই, তাহলেই তা হবে আমাদের জন্য এক নতুন প্রজন্মের উন্মেষ। আমরা এগোতে চাই, পেছাতে নয়। আমরা দিগ্বিজয়ী হতে চাই, কাপুরুষ হতে নয়। আমরা হাতে হাত ধরে তিমির রাত পাড়ি দিতে চাই, ভেদাভেদ তৈরি করতে নয়। আমরা ভালোবেসে সমস্যা দূর করতে চাই, ঘৃণায় বা বিদ্বেষে নয়। এসবই আমাদের জন্য প্রেরণাদায়ী। তরুণদের সাফল্যের মিছিলে এসব একেকটি আলোর মশাল। এই চেতনা সঙ্গী করে বের হয়ে আসুক আরও হাজারও এভারেস্টজয়ী। মানুষের জয় হোক।

 

 

লেখক: বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্টজয়ী

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়