ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বর্ষায় লোকালয়ে বিষধর সাপ, ভয় এবং ভ্রান্ত ধারণা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৭, ২৭ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বর্ষায় লোকালয়ে বিষধর সাপ, ভয় এবং ভ্রান্ত ধারণা

জাহাঙ্গীর আলম বকুল: দেশের গ্রাম-গঞ্জে বর্ষা মৌসুমে সাপের উপদ্রব বাড়ে। এ সময় সাপের আবাসস্থল মাঠ-বিল বা বন-জঙ্গলে পানি জমে যাওয়ায় এবং এতে খাদ্যের সংকট হওয়ায় সাপ আশ্রয় এবং খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এতে সাপ এবং মানুষ উভয়ই বিপদের মুখে পড়ে।

প্রতিবছর বর্ষার শুরুতে সাপ লোকালয়ে আসে এবং মানুষের হাতে মারা পড়ে। এ সময় ব্যাপক সংখ্যক মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। অনেকে মারাও যায়। কিন্তু এ বছর যেন মাত্রাতিরিক্ত মাত্রায় সাপের উপদ্রব বেড়েছে এবং ব্যাপক সংখ্যায় মানুষের হাতে মারা পড়ছে।  

দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা রাজশাহীর বিভিন্ন উপজেলায়, টাঙ্গাইল, ঝিনাইদহ, মানিকগঞ্জ, কুষ্টিয়া এবং সাতক্ষীরায় চার-পাঁচ শত গোখরা সাপ বা সাপের বাচ্চা ধরা পড়েছে। এসব সাপ স্থানীয়রা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। এর মধ্যে কয়েকটি বড় গোখরা সাপ সাপুড়ের হাতে ধরা পড়েছে। তবে সৌভাগ্যক্রমে কেউ এসব সাপের কামড়ের শিকার হননি। এ সময় সাপের শতাধিক ডিম পাওয়া গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, সাপ মূলত খাবারের সন্ধানে ঘরে আসে। গ্রামাঞ্চলে প্রত্যেক বাড়িতে ইঁদুর থাকে। ইঁদুর খেতে ঘরে আসে সাপ। বিশেষ করে, মাটির বাড়িতে। যেসব ঘর-বাড়িতে ইঁদুরের গর্ত আছে এবং ধানের গোলা আছে, সেখানে সাপের উপস্থিতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি অতিবর্ষণের সমস্যা তো আছেই।

মানুষের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক সাপ কিন্তু ভীত স্বভাবের প্রাণী। সাপ আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার জন্য কামড় দেয়। কামড় দিলেই মানুষ মারা যাবে, তেমন নয়। কারণ, সব সাপ বিষধর নয়। বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ বইয়ে ৯৪ প্রজাতির সাপের নাম উল্লেখ আছে। দেশে যেসব সাপের দেখা মেলে এর তিন-চতুর্থাংশই বিষহীন। যেসব সাপের বিষ আছে, এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি প্রজাতির সাপের বিষ মারাত্মক। প্রাণিবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ আলী রেজা খান তার একটি বইয়ে ৫২টি বিষহীন আর ২৭টি বিষধর প্রজাতির সাপের বিবরণ দিয়েছেন। এই বিষধর প্রজাতির মধ্যে ১২ প্রজাতি থাকে বঙ্গোপসাগরে। বিষধর সাপের মধ্যে মাত্র দুই থেকে তিন প্রজাতির দেশের গ্রামাঞ্চলে দেখা মেলে। 

গ্রামাঞ্চলের বন-জঙ্গলে, ফসলের ক্ষেতে কিংবা বসতবাড়ির আশপাশে যে বিষধর সাপ দেখা যায় তার নাম গোখরা। গোখরার তিনটি প্রজাতি রয়েছে। এরা হলো গোখরা, খইয়া গোখরা এবং রাজ গোখরা। রাজ গোখরা পৃথিবীর বিষধর সাপের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং অন্যতম।

গোখরার মতোই বিষধর কেউটে সাপ। এ দেশে তিন প্রজাতির কেউটে দেখা যায়। এরা হলো সাদা বেড় কেউটে, কাল কেউটে এবং শঙ্খিনী। এরা নিশাচর। উজ্জ্বল হলুদ-কালো ডোরাকাটা শঙ্খিনী সাপ দেখতে আকর্ষণীয়। সাধারণত এরা জলাধারের আশপাশে থাকতে পছন্দ করে।

সুন্দরবন, সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলে উজ্জ্বল সবুজ রঙের সবুজবোড়া সাপ দেখা যায়। এরা বিষধর সাপের তালিকায় অন্যতম। আমাদের দেশে তিন প্রজাতির সবুজবোড়া থাকলেও বেশি দেখা যায় সাদাঠোঁট সবুজবোড়া।

দেশে উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বের পাহাড়ি বনাঞ্চলে লাল-ঘাড় ঢোঁড়া নামে বিষধর সাপ রয়েছে। এরা দিবাচর। বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙ, গিরগিটি ইত্যাদি খায়। দেশে কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ দেখা যায়। অধিকাংশ সামুদ্রিক সাপই বিষধর।

রূপকথার কালনাগিনী সাপের নাম শুনলেই মনে হয়, এই সাপের কামড়ে মৃত্যু অনিবার্য। এটি সচরাচর দেখা যায় না এবং প্রকৃতপক্ষে এটি সাপটির বিষ নেই।

গবেষকরা বলছেন, সাপ দেখলেই মানুষ ভয় পায়। কিন্তু সাপ নিজে ভয় না পেলে আক্রমণ করে না। সাপের সামনে বস্তু যদি না নড়ে বা শব্দ তৈরি না করে, তাহলে সাপ ওই বস্তুকে ক্ষতিকর মনে করে না এবং কামড়ায় না।

আর সাপে কামড়ালেই রোগী বিষে আক্রান্ত হয় না। আমাদের চারপাশে সচরাচর যে সাপের দেখা মেলে এগুলো অধিকাংশই বিষহীন। আবার বিষধর সাপে কামড়ালেই যে বিষে আক্রান্ত হবে তাও নয়। কারণ, সাপের বিষের থলিতে সব সময় বিষ থাকে না। যেমন- সাপ যে শুধু মানুষকে কামড় দেয়, তা নয়। নিজেকে অনিরাপদ মনে করলে সাপ যেকোনো বস্তুতে ছোবল দেয়। এতে সেখানে বিষ ঢেলে দিতে পারে। নতুন বিষ তৈরি হতে সময় লাগে। আবার সাপ যদি ছোঁবল দিয়ে কামড় দেওয়ার সুযোগ না পায়, তাহলে বিষ ঢালা কঠিন হয়ে পড়ে।

তবে সাপে কামড় দিলেই দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কেননা, জানার সুযোগ নেই- রোগী বিষে আক্রান্ত হয়েছেন কি না। সাপে কাটা রোগীর ওষুধ অ্যান্টি স্ন্যাক ভেনম। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে সেটা প্রয়োগ করবেন। রোগীকে হাসপাতালে আনতে দেরি করলে, এই ওষুধ প্রয়োগ বেশি লাগতে পারে। রোগীর মৃত্যু শঙ্কাও বেড়ে যাবে। 

সাপে কাটার পর প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে ক্ষতস্থান দিয়ে অবাধে রক্ত পড়তে দেওয়া এবং যথাসাধ্য রোগীকে শান্ত থাকতে হবে। আতঙ্ক বা ভয় রোগীর হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়। যদি সাপটি বিষধর হয়, তাহলে হৃদকম্পনের কারণে শরীরে দ্রুত বিষ ছড়িয়ে পড়বে। কখনোই ওঝা বা কবিরাজের ওপর রোগীকে সঁপে দেবেন না। সাপটি যদি বিষধর হয়, তাহলে ঝাড়-ফুঁক করে বিষ নামানো যাবে না। ঝাড়-ফুঁক করে বিষ নামানোর চেষ্টা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।

ওঝার চিকিৎসায় সেই রোগীই ভালো হয়, যাকে এমন সাপে কামড় দিয়েছে যার বিষ নেই। আর এভাবে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কাছে- এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ওঝা বিষ নামিয়ে রোগীকে সুস্থ করে।

রূপকথায়, গল্পে-সিনেমায় সাপ নিয়ে এত কাহিনী তৈরি হয়েছে যে- এটি নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারণা সত্য বলে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সাপের মাথায় মনি পাওয়া যায়, সাপ আক্রমণকারীকে চিনে রাখে এবং রাতে এসে কামড় দেয়, লেজ দিয়ে আঘাত করলে সেই স্থানে পচন ধরে, বাঁশি বাজিয়ে সাপ আনিয়ে বিষ তুলিয়ে মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করা- এগুলো ভ্রান্ত বিশ্বাস, যার ভিত্তি নেই। 

(তথ্য সংগৃহীত)


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুলাই ২০১৭/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়