ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাণিজ্যের অবসান প্রয়োজন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ২৮ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাণিজ্যের অবসান প্রয়োজন

হাসান মাহামুদ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরে। অসামান্য দেশপ্রেম নিয়ে আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন থেকে শুরু করে তাদের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ সেই প্রথম থেকেই রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের শিকার- সেটা একটা ওপেন সিক্রেট।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়ার পরও সর্বমহলস্বীকৃত একটি তালিকা এখনো তৈরি হয়নি। এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন ও হালনাগাদের কাজ চলছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় যাচাই বাছাই কার্যক্রমে সততা নিয়ে অভিযোগ আসছে বিভিন্ন মহল থেকে। এমনকি যাচাই-বাছাইয়ে নামে ‘ভুয়াদের’ মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে অভিযোগ করছে বিভিন্ন সংগঠন।

বৃহস্পতিবার শেষ হলো চলতি বছরের জেলা প্রশাসক সম্মেলন। এই সম্মেলনে ৩২১টি ইস্যু ভিত্তিক আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়টি। কিন্তু প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সম্মেলনেও মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভোগের চিত্র নিয়ে আলোচনা করতে হয়েছে সরকারের নীতি নির্ধারকদের। যেখানে সম্মেলনে উপস্থিত একজন জেলা প্রশাসকের ভাষায়, ‘আলোচনা হওয়া দরকার ছিল, আর কি কি করা যায় এই মহান মানুষগুলোর জন্য। কিন্তু আমরা আটকে আছি এখনো উদ্যোগ, পরিকল্পনা আর তালিকার আলোচনায়’।

সম্মেলনের তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর সরকারি সুবিধা সংবলিত কাগজপত্র ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে। এ সম্পর্কিত কাগজ খুব তাড়াতাড়ি জেলা প্রশাসকদের পাঠানো হবে। এ সময় কেউ কেউ বলেছেন, আগে তো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করতে হবে। অর্থাৎ ঘুরেফিরে তালিকা প্রসঙ্গ।

সরকার দেশে জঙ্গি দমনকে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বলতে গেলে গুলশানের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর, মাত্র এক বছরে সরকার জঙ্গিবাদ নির্মূলের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তেমনি ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বিষয়টিকেও ‘টপমোস্ট প্রায়োরিটি’ ঘোষণা করে বিভিন্ন অসামঞ্জস্য নির্মূল করা কি যায় না?

বধ্যভূমি ও মুক্তিযোদ্ধাদের কবর একই নকশায় করার নির্দেশ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের যেসব স্থান সারা দেশে এখনো নির্ধারণ করা হয়নি, তার জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আর এ জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেবে বলে ঘোষণাও দিয়েছে। এক্ষেত্রে নিয়ম মোতাবেক সরকার অবশ্যই একটি কমিটি গঠন করবে। আমাদের চাওয়া সরকারের এই বাস্তবায়ন কমিটির পাশাপাশি একটি ‘জাতীয় কমিটি’ও গঠন করা প্রয়োজন। যে কমিটিতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, শিক্ষক এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অর্ন্তভুক্ত থাকবেন। তাদের কাজ হবে বাস্তবায়ন কমিটিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা এবং তদারকি কার্যক্রমে নিজেদের জড়িত রাখা। একটি নিরপেক্ষ জাতীয় কমিটি গঠন করা গেলে অন্তত এই পরিকল্পনাকেন্দ্রিক অসাধু তৎপরতা, রাজনীতি ও ঘুষ বাণিজ্য কম হতে পারে।

যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে বধ্যভূমি ও মুক্তিযোদ্ধাদের কবর তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় জমি বিদ্যমান বাজার দরে কেনার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেহেতু কিছু অসামঞ্জস্য হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে যায়। জাতীয় কমিটিকে এই দামের বিষয়েও সুপারিশ করার একতিয়ার দেওয়া যেতে পারে।

আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও এরই মধ্যে জানা গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদেরও বীরত্বের জন্য ‘বীরত্ব সূচক খেতাব’ প্রদানের চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের। এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের মূল্যায়ন করে খেতাব না দেয়া হলে মনে হবে এটা সামরিক মুক্তিযুদ্ধ ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সামরিক নয়, রাজনৈতিক জনযুদ্ধ ছিল। সেক্ষেত্রে খেতাব প্রদানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যারা মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন, তারা মর্যাদার অধিকারী। তারা জাতীয় বীর হিসেবে সম্মান বা মর্যাদা পেতেই পারেন। জীবন বাজি রেখে ময়দানে যুদ্ধ করে তারা এ মর্যাদা বা সম্মান অর্জন করেছেন। এমনি এমনি এ সম্মান বা মর্যাদা অন্য করো হাতে তুলে দেয়ার বিষয় নয়। এই দুর্লভ অর্জনকে যারা কালিমালিপ্ত করেছে বা করছে বা করার চেষ্টা করছে তাদেরকে কোনো মতেই ক্ষমা করা যায় না। এই যে হাজার হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার জন্ম হলো এর জন্য দায়ী কারা?

স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী প্রধান এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের মে মাসে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাবগুলো দেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ, জনযুদ্ধ। মাত্র দু’একজন ছাড়া রাজনৈতিক কেউ মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব সূচক খেতাব পাননি। এতে রাজনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। রাজনৈতিক-বেসামরিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করা না হলে এটা বৈষম্য হবে। এভাবে চলতে থাকলে মনে হবে মুক্তিযুদ্ধ সামরিক যুদ্ধ ছিল।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ যে সারাদেশের আপামর জনসাধারণের যুদ্ধ ও সংগ্রাম ছিল, সেই বিষয়টিও সরকারি ভাবে নিশ্চিত করাও এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। সেক্ষেত্রে খেতাব প্রদানের বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন বলে আমরা আশা করছি।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা (মুক্তিবার্তা-গেজেট) সংরক্ষিত রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা সরকারিভাবে এ মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা হয়নি এবং সংরক্ষণও করা হয়নি। তবে রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের নামসহ তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ সরকারের রয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রবিরোধীদের তালিকাও দ্রুত প্রণয়ন করা জরুরী।

২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ষোঘণা দিয়েছিলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে তাদের কাছ থেকে তা ফেরত নেওয়া হবে। কিন্তু এই ঘোষণার আর কোনো অগ্রগতি আমরা দেখতে পাইনি। ভুয়া তালিকায় নাম তুলে যারা এ যাবতকালে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে এই অর্থ উদ্ধার করা গেলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, যারা অভাবে অনটনে দিন কাটাচ্ছেন- তাদের কল্যাণে অনেক কিছু করা সম্ভব।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি ও বাণিজ্য বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পরিশুদ্ধ তালিকা প্রণয়ন কোনোমতেই সম্ভব নয়। তবে বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা প্রকাশ্যে ও গোপনে সুষ্ঠু তদন্তের মধ্য দিয়ে যাচাই-বাছাই করতে পরলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন এমন বহু লোক এখনো বেঁচে আছেন। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাও বেঁচে আছেন। তাদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

পরিশেষে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিছু মহান হৃদয়ের সাহসী মানুষ দেশ স্বাধীন করায় অবদান রেখেছেন। এসব সাহসী মানুষদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের বিনিময়েই আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে না পারলে আমরা জাতীয়ভাবে কলংকমুক্ত হতে পারবো না।

লেখক : সাংবাদিক।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়