ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

কুসুমের ‘নেশা’ কুসুমাস্তীর্ণ নয়

নাজমুস সালেহী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কুসুমের ‘নেশা’ কুসুমাস্তীর্ণ নয়

নাজমুস সালেহী : যে কোনো জিনিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ কিংবা সমালোচনা তার প্রতি মানুষের কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আলোচিত কিংবা সমালোচিত হতে মানুষ সমাজের প্রবহমান স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে নানা কর্মকাণ্ড করে। সেই সকল কাজ মানুষ, সমাজ বা রাষ্ট্র কীভাবে নিল তা মূখ্য না হয়ে পরিচিতিই তাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য হয়ে ওঠে। পর্নোগ্রাফির মামলা না হলে হয়ত বাংলাদেশের অভিনয়শিল্পী কুসুম সিকদারের ‘নেশা’ গানটি দেখা কিংবা শোনার ইচ্ছে অনেকেরই হতো না।

গানের মিউজিক ভিডিওটিকে পর্নোগ্রাফির সাথে তুলনা করে এর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর আগে আগস্ট মাসে গানটি রিলিজ হবার পর অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে এর বিরুদ্ধে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছিলেন এক আইনজীবী। তখনও ভিডিওটি দেখার আগ্রহ না হলেও এবার নতুন করে আলোচনায় আসার ফলে মনোযোগ দিয়ে সেটি দেখলাম। গানটির মিউজিক ভিডিও নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করতে চাই।

গানটির শুরুর কথাগুলোতে যৌনতার গন্ধ আছে। আছে যৌন খোরাক। মনে হচ্ছে কথাগুলোর মাধ্যমে যৌনঘোরে বুঁদ হয়ে আছেন এক নারী। তবে পরের কথাগুলো বেশ নান্দনিক। সুরের মধ্যে খানিকটা ঘোর আর মোহ আছে। কুসুম সিকদারের নিজের লেখা ও গাওয়া গানটি যে প্রবহমান সময়ের একটি ব্যতিক্রমী কাজ তাতে সন্দেহ নেই, গায়কিও অসাধারণ। তবে গানের মিউজিক ভিডিওর শুরুতেই সুইমিংপুলে প্রায় নগ্ন কুসুমের স্নানদৃশ্যের সাথে সহ-অভিনেতার কামুক চেহারার অভিব্যক্তি যেন বলছে এর উন্মাদনা একটু আলাদা। পুরো গানে প্রায় নগ্ন বা অর্ধনগ্ন কুসুমের পাঁচটি গোসলের দৃশ্য, সাতটি সুইমিংপুলের দৃশ্য, একটি শয্যা আর তিনটি চুম্বন দৃশ্য রয়েছে।

যার প্রতিটি দৃশ্যেই খোলামেলা বা অর্ধনগ্ন পোশাকে কুসুম সিকদার যেন নেশার ঘোরে কাতরাচ্ছেন। আর সহ-অভিনেতা সুজনের খালি গায়ে চুম্বন ও জড়িয়ে ধরার দৃশ্য যেন মনে হচ্ছিল কামনায় তিনিও বুঁদ। তাছাড়া তাদের অঙ্গভঙ্গিতেও প্রকাশ পাচ্ছিল স্বাভাবিক অভিনয়ের চেয়ে উস্কানিমূলক মাদকতা। এমন দৃশ্যের সাথে নান্দনিক শিল্পগুণে সমৃদ্ধ কথামালার এমন একটি গানের কোনো মিল নেই বলেই মনে হয়েছে আমার। তাছাড়া গানের থিম বা মূল বক্তব্যের সাথে দৃশ্যায়নেরও কোনো সংযোগ নেই। নিতান্তই গানটিকে দ্রুত জনপ্রিয় করার সস্তা পথ হিসেবে এটি করা হয়েছে। পুরো গানের যে আলো-আঁধারি আর মাদকতায় ঠাসা দৃশ্যের চিত্রায়ন তাতে আমি মনে করি, পুরুষ এমনকি নারীরাও এই ভিডিওটির ব্যাপারে আপত্তি জানাবেন।

এর কভার ফটোতে যে ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, তাতে দেখা যায় একটি ছেলে খালি গায়ে দুহাতে জড়িয়ে একটি মেয়েকে চুমু খাচ্ছে। সেখানে দুজনই গভীর আবেদনে আলিঙ্গনরত যা অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়। এ ধরনের একটি বিশেষ ভাবধারায় নির্মিত মিউজিক ভিডিও আর যাই হোক, বিনোদনপ্রেমী বাঙালির মনের খোরাক মেটাতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া এই ভিডিওটি উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের উস্কানি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না বলেই মনে হয় আমার। নারীর এমন খোলামেলা শরীর আর কামুক উত্তেজনার ভরপুর চিত্রায়ন তরুণদের নারী শরীরের প্রতি আরো আগ্রহী করে তুলবে। এবং এর কুপ্রভাব পড়বে সমাজে।  

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি এদেশের তরুণরা এরচেয়ে বেশি নগ্নতা বা ইউরোপ-আমেরিকার পর্নোগ্রাফি দেখে না? দেশে কি এই গানের আগে এমন ভিডিও দেখা যায়নি? বাংলাদেশে কি এর আগে মুনমুন-ময়ূরী কিংবা পলিরা নগ্ন শরীর প্রদর্শন করে দেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেয়নি? সবকটি প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ। তবে মনে রাখতে হবে, সেই সময়ের বাঙলা ছবিতে যাদের অর্ধনগ্ন হয়ে নাচতে দেখা গেছে তারা সবাই ঝরে পড়েছে। তাদের মানুষ মনে রাখেনি। এর মানে প্রথম কদিন তাদের শরীরের মেদে কিছু মানুষের বিনোদনের খোরাক পূরণ হলেও কদিন পর ঠিকই তারা ছিটকে পড়েছে। সেই সময়ে অশ্লীল সিনেমা বন্ধের দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন আর তথ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্মারকলিপি দিতেও দেখা গেছে। অশ্লীলতার দায়ে অনেক সিনেমা আটকে গেছে সেন্সর বোর্ডে। আর এক শ্রেণীর রুচিশীল দর্শক হলমুখী ছিলেন না। সর্বদা অশ্লীলতার বিরুদ্ধে বলেছেন তারা। সেই সময় সিনেমা ফ্লপের কারণে মুনাফা অর্জনে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন নির্মাতারা। তবে সেই দিন আর নেই। চলচ্চিত্রে আবার ফিরেছে সুদিন। নির্মিত হচ্ছে ভালো সিনেমা।

আর যদি বিদেশি ব্লু ফিল্মের কথা বলি, সেটা এখনও খারাপের চোখেই দেখা হয় আমাদের সমাজে। কেউ উন্মুক্ত জায়গায় কিংবা পরিবারের সাথে তা দেখার সাহস করেন না। অভিভাবকরাও সচেতন যাতে তাদের সন্তানেরা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত না হন সে ব্যাপারে। সম্প্রতি তথ্য মন্ত্রণালয় পর্নোগ্রাফি আসক্তি ঠেকাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যা থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় সবাই অশ্লীলতার বিরোধী। এবং আমাদের শিক্ষক, পিতামাতা ও সমাজের বড়রা আমাদের নীতি নৈতিকতা ও শালীনতার যে শিক্ষা দিয়ে আসছেন আবহমান কাল ধরে সেখানে শুধু পর্নোগ্রাফিই নয়, যে কোনো ধরনের অশ্লীলতার বিন্দুমাত্র স্থান নেই। ‘নেশা’ গানটির অহেতুক যৌন আবেদনময়ী এমন ভিডিও চিত্রায়ন কেবল মিউজিক ইন্ডাষ্ট্রি নয় গোটা সমাজ পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য বিব্রতকর বলেই মনে করি।

লেখক : সাংবাদিক, রেডিও টুডে



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়