ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সিনেমা আমদানি অথবা যৌথ প্রযোজনা- কোনটা হুমকি?

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০০, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিনেমা আমদানি অথবা যৌথ প্রযোজনা- কোনটা হুমকি?

রাহাত সাইফুল : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অনেকদিন ধরেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে।  নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত চলচ্চিত্র শিল্প। সমস্যার সমাধান হয়েও যেন হচ্ছে না। কিছু সমস্যা নিয়ে চলচ্চিত্রাঙ্গণের সকলে আন্দোলনও করেছেন। এখানেও পক্ষ-বিপক্ষ ছিল। ফলে আন্দোলন-পাল্টা আন্দোলন, বয়কট-পাল্টা বয়কট, সংগঠন-পাল্টা সংগঠন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এর শেষ কোথায়? সমাধান কী? এ নিয়ে যেন কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।

সম্প্রতি যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় ভারতীয় শিল্পী, নির্মাতাসহ কলাকুশলীদের আধিক্য বেশি লক্ষ্যণীয়। এ দেশের নামেমাত্র শিল্পী ও কলাকুশলী নিয়ে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ করা হচ্ছে। গত ঈদুল ফিতরে চলচ্চিত্রের ১৮টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় চলচ্চিত্র পরিবার। তারা যৌথ প্রযোজনার সঠিক নিয়ম-নীতির দাবিতে আন্দোলনে নামে। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শাকিব খানকে বয়কট ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে চলচ্চিত্রের এ সংগঠনটি। এর সঠিক সমাধান এখনো হয়ে ওঠেনি। এদিকে জাজ মাল্টিমিডিয়া ও শাকিব খানও পাল্টা সংগঠনের পরিকল্পনা করছেন।

যৌথ প্রযোজনার সিনেমায় কিছু হলেও বাংলাদেশের শিল্পী ও কলাকুশলী থাকছেন। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় বাংলাদেশে যে সব ভারতীয় চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে তাতে সিনেমাজুড়ে ভারতীয় শিল্পী, নির্মাতা, কলাকুশলী থাকে। এবং এগুলোর কাহিনিও ভারতীয় সংস্কৃতি নির্ভর। দেশীয় হল মালিকগণও অধিক আগ্রহে এসব ভারতীয় সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিচ্ছেন। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বাংলাদেশের সিনেমার জন্য হুমকি নাকি ভারতীয় সিনেমা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য বেশি হুমকি?

এ প্রশ্নটির উত্তর পেতে গভীরভাবে ভাবনার প্রয়োজন হয় না। সাধারণভাবেই বলা যায়, ভারতীয় সিনেমা মুক্তি দেওয়া ঢাকাই সিনেমার জন্য অধিক হুমকিস্বরূপ। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। অথচ যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নিয়ে কত কথাই না বলছেন সকলে। কথায় আছে, পায়ের সমস্যায় আগে ওষুধ সেবন করবেন নাকি গলার সমস্যায় আগে ওষুধ সেবন করবেন? এর উত্তরে অবশ্যই বলবেন- আগে গলা, তারপর পা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিবার আগে পায়ের চিকিৎসা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তারা গলার চিকিৎসার কথা ভাবছেন না।  যৌথ প্রযোজনার সঠিক নিয়ম নিয়ে আন্দোলন করছেন তারা কিন্তু সাফটা চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশে মুক্তি পাচ্ছে- এ বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।

বাংলাদেশ-ভারত সিনেমা বিনিময় নিয়ে কিছুদিন আগে শুরু হয়েছিল নানা বিতর্ক। যদিও এ বিষয়টি নিয়ে মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ করেছিলেন ঢাকাই সিনেমার পরিচালক, প্রযোজকরা। এর সঠিক সুরাহা হয়নি। এখনো ভারতীয় সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। গেজেট অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে একটি চলচ্চিত্র ভারতে রপ্তানি ও প্রদর্শনের বিপরীতে ভারতের কলকাতার একটি সিনেমা আমদানি করে দেশে দেখানো যাবে। এটা হচ্ছে সিনেমা বিনিময়। বাংলাদেশের প্রযোজক সমিতির যেকোনো সদস্য প্রতিষ্ঠান কলকাতা থেকে সিনেমা আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে সিনেমা রপ্তানি করতে পারবে। তবে তারা কোন সিনেমা আনবেন বা পাঠাবেন, এ নিয়ে কোনো সুষ্ঠু নীতিমালা নেই। ফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে কলকাতার সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমা আমদানি করা হচ্ছে এবং রপ্তানি করা হচ্ছে ঢালিউডের পুরোনো সিনেমা অথবা মানহীন সিনেমা। বাংলাদেশ থেকে নেওয়া সিনেমাগুলো নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং চালানো হচ্ছে কলকাতার অজপাড়াগাঁয়ের একটি বা দুটি প্রেক্ষাগৃহে। সেসব জায়গায় সিনেমাটি চালিয়ে ব্যবসা করার কোনো মানসিকতা নেই রপ্তানিকারকের। এর কারণ হচ্ছে ভারতীয় যে সিনেমাটি বাংলাদেশে মুক্তি পাচ্ছে সেটি দিয়ে যে লাভ হয় তাতে বাংলাদেশ থেকে কম মূ্ল্যে মানহীন সিনেমা কিনে রেখে দেওয়াই লাভজনক।

কলকাতা থেকে আমদানি করা সিনেমাগুলো যেভাবে জনবহুল এলাকার সর্বোচ্চসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হচ্ছে, রপ্তানি করা সিনেমাগুলোর ক্ষেত্রেও তাই করা হোক। অবাক করা ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সিনেমা কয়টি হলে মুক্তি দেওয়া হবে তারও নিশ্চয়তা দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। তা ছাড়া বাংলাদেশে যখন ভারতীয় সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয় তখন এদেশের হল মালিকগণ ভারতীয় সিনেমা অধিকসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিয়ে থাকেন। অথচ একই সময় দেশীয় সিনেমা হলে মুক্তি দিতে আগ্রহ দেখান না। ফলে ভারতীয় সিনেমা অধিক প্রেক্ষাগৃহে আর দেশীয় সিনেমা কমসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে। দেশীয় সিনেমা দেশের প্রেক্ষাগৃহে স্থান পাচ্ছে না- এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনকই বটে।

ঠিক এ ঘটনাই ঘটেছে ‘পোস্ত’ ও ‘খাঁচা’র ক্ষেত্রে। আজ শুক্রবার থেকে বাংলাদেশের সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে কলকাতার সফল সিনেমা ‘পোস্ত’। এ সিনেমায় অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মিমি চক্রবর্তী, যিশু সেনগুপ্ত, লিলি চক্রবর্তী, সোহিনী সেন, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে। সাফটা চুক্তির আওতায় সিনেমাটি আমদানি করেছেন ঢাকার খান ব্রাদার্সের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম চৌধুরী। সিনেমাটি নির্মাণ করেন নন্দিতা রায় ও শিব প্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সিনেমাটি বাংলাদেশের মোট ২৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে। একই দিনে মুক্তি পাচ্ছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী জয়া আহসান অভিনীত বাংলাদেশের সিনেমা ‘খাঁচা’। দুই বাংলায় জনপ্রিয় জয়া। আকরাম খান পরিচালিত এ সিনেমাটিতে আরো অভিনয় করেছেন আজাদ আবুল কালাম, মামুনুর রশীদ, চাঁদনী, শাহেদ আলী, কায়েস চৌধুরী, পিদিমসহ অনেকে।  ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের ওপর ভিত্তি করে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক রচিত গল্প অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমাটি মাত্র ৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে।

এমন দৃশ্য এর আগেও দেখা গিয়েছে। ভারতীয় সিনেমা বেশি হলে মুক্তি দেওয়া হয় আর একই সময় দেশীয় সিনেমা নামেমাত্র কয়েকটি হলে মুক্তি দেওয়া হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশে বিশেষ কোনো উৎসবের সময় ভারতীয় সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয়। এতে করে এ দেশের প্রযোজকরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব কারণে অর্থ লগ্নীকারীরা চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করতে আসছেন না। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের জনপ্রিয় সিনেমা এবং আনুমানিক কতসংখ্যক প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেওয়া হবে তার নিশ্চায়তা দিয়েই সাফটা চুক্তির মাধ্যমে ভারতে বাংলাদেশি সিনেমা মুক্তি দেওয়া উচিৎ। কোন সিনেমা বাংলাদেশে আমদানি করা হবে এবং কোন সিনেমা রপ্তানি হবে এজন্য চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। কমিটির অনুমতি সাপেক্ষে এসব সিনেমা আমদানি, রপ্তানি করা হবে। এতে সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। সিনেমায় এ দেশের বিনিয়োগকারীদের লোকসান গুনতে হবে না। পাশাপাশি এ দেশের সিনেমা ভারতে মুক্তির সুযোগ পাবে। প্রযোজক লগ্নীকৃত টাকা ফেরত পেলেই নতুন করে সিনেমা প্রযোজনা করতে আগ্রহী হন। এতে বাংলাদেশের শিল্পী ও কলাকুলশীরা যৌথ প্রযোজনার সিনেমার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে দেশীয় সিনেমায় কাজ করবেন। 

চলচ্চিত্রকে সরকার অনেক আগেই শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এর বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে? চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের অর্থ, অবকাঠামোসহ আনুষাঙ্গিক সুবিধা। বিএফডিসির মহাপরিচালক হবেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, আমলা নন। অন্যান্য শিল্পের মতো চলচ্চিত্র শিল্পেও সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। বছরে কিছুসংখ্যক সিনেমায় অনুদান দিলেই চলচ্চিত্র শিল্পের ভাগ্যের উন্নতি হবে না। প্রয়োজন মৌলিক বিষয়গুলোর সংস্কার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রাহাত/শান্ত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়