ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইলিশ উৎপাদন: জেলেদের মূল্যায়ন করুন

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৯, ১৮ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইলিশ উৎপাদন: জেলেদের মূল্যায়ন করুন

জাফর সোহেল: সেপ্টেম্বর মাসের কোনো একদিন হবে। বাসা থেকে বেরিয়ে স্থানীয় বাজারে গেলাম কিছু দেশীয় মাছ কিনব বলে। কিন্তু বাজারে গিয়ে আমি রীতিমতো বিস্মিত হলাম! দেশীয় মাছ যারা বিক্রি করতেন প্রায় সবাই ইলিশ বিক্রি করছেন। বাজারের চার ভাগের তিন ভাগ মাছের ব্যাপারীর সামনেই ইলিশের ডালা। বিকিকিনিও চলছে ধুমছে।ইলিশ যে খুব পাওয়া যাচ্ছে এবার, আমি জানতাম। তাই বলে এতটা ইলিশময় হয়ে যাবে মাছের বাজার তা ছিল কল্পনাতীত।

হতাশ হয়ে পাশেই যেখানে অস্থায়ী বাজার বসে সেখানে গেলাম। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনের এই অস্থায়ী মাছের বাজারে ঢাকার কাছের কয়েকটি জেলা যেমন নরসিংদী ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে দেশীয় কৈ, শিং, মাগুর, শোল প্রভৃতি তাজা মাছ নিয়ে আসেন ক্ষুদ্র মাছ ব্যবসায়ীরা। সেখানেও একই অবস্থা! ইলিশে ইলিশে গোটা বাজার সাদা হয়ে গেছে।এখানে শতভাগ বিক্রেতা ইলিশ বিক্রি করছেন! জিজ্ঞেস করালাম- ঘটনা কী? দেশী মাছ পাওয়া যাবে না? তাঁরা বললেন, অন্তত এক-দুসপ্তাহ না।

খুব বেশিদিন হয়নি আমরা ইলিশের জন্য ভরা মৌসুমেও হাহাকার করেছি। একটি ইলিশ কিনতে গুণতে হয়েছে এমনকি ৫ হাজার টাকাও। কিন্তু গত কয়েক বছরে চিত্র বদলেছে ঈর্ষণীয়ভাবে। আগে যেখানে এক থেকে দেড় লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদনে কষ্ট হতো, এখন সেখানে ইলিশ উৎপাদন হচ্ছে ৩ লাখ মেট্রিক টনের ওপরে! এজন্য সংশ্লিষ্ট জেলাসমূহের প্রশাসন, মৎস্যবিভাগ এবং জেলেরা সমানভাবে কৃতিত্বের দাবিদার।

ইলিশ আমরা খাই মজা করে, ভেজে কিংবা সরষে দিয়ে রান্না করে এবং আরো বিভিন্নভাবে। কিন্তু একজন জেলে এই জিবে জল এনে দেয়া সুস্বাদু জলজ প্রাণিটি শিকার করতে কী কষ্টই না করেন! জেলে তাঁর জীবন বাজি রাখেন ইলিশ শিকার করতে গিয়ে।বঙ্গোপসাগর কিংবা পদ্মা-মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তারা। রাতের পর রাত কাটান সমুদ্রের নোনা জলে।কেউ কেউ জীবন বিসর্জনও দিয়ে দেন একাজ করতে গিয়ে। সমুদ্রে সলিল সমাধী হয় অনেক জেলের। মানছি, জীবনের তাগিদেই তারা এটা করেন। কিন্তু তাদের এই অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল যখন আমরা এবং সামগ্রকিভাবে দেশ ভোগ করি তখন কৃতজ্ঞতাটা জানানো নেহায়েত কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আমরা কি সেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি? অন্তত এই মুহূর্তে আমি বলব- না। এই লেখা যখন লিখছি তখন টিভিতে সংবাদ হচ্ছে- বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, চাঁদপুরসহ ইলিশ উৎপাদনকারি জেলার জেলেরা এখনো পাননি ভর্তুকির টাকা বা চাল। কিসের এই ভর্তুকি? মা ইলিশ রক্ষায় বিশেষ সুরক্ষা হিসেবে সরকার তাদের নির্দিষ্ট একটা সময় নদী ও সাগরে মাছ ধরতে নিষেধ করেছে। সময়টা এখনো চলছে। চলবে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত।

জীবন-জীবিকার একমাত্র উৎস বন্ধ থাকলে জেলেরা খাবে কী? তাই সরকার তাদের এই সময়ে চাল দেয়ার কথা।কিন্তু কর্মসূচির আজ ১৭তম দিন পার হলেও কোথাও কোনো জেলে সরকারি এই বিশেষ সহায়তা পাননি।উল্টো বিভিন্ন স্থানে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার অপরাধে আটক ও জরিমানার শিকার হয়েছেন কয়েকশ জেলে। আমি সরকারের কঠোরতাকে সমর্থন করি। কিন্তু জেলেদের না খাইয়ে মারার কাজ সমর্থন করতে পারি না। আমি জানি, কিছু জেলে এই ভরা মৌসুমে ইলিশ শিকারের মতো লোভ সামলাতে পারছে না। কিন্তু এটাও তো সত্য, অনেক জেলের ক্ষেত্রে বাস্তবেই অন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তাদের পক্ষে ইলিশ শিকার না করে উপায় নেই।একটা বিষয় এখানে জানা দরকার, ইলিশ শিকার বন্ধ মানে কেবল ইলিশ নয়, সব মাছ শিকারই কার্যত বন্ধ আছে। অর্থাৎ জেলেরা নদীতেই নামতে পারছেন না। তাহলে তারা খাবেন কী? এমন তো নয় যে, এক মাস ইলিশ শিকার করলে তিন মাস বসে খাওয়া যাবে।হতে পারে কিছু ব্যাপারী, যারা অর্থ লগ্নি করে, তাদের কিছু বাড়তি অর্থ আয়ের সুযোগ হয়েছে। কিন্তু, যারা নিতান্তই শ্রমিক পর্যায়ের, যারা দিন আনে দিন খায়, তারা একদিন কাজ না করলে দিন শেষে বাড়িতে কী নিয়ে যাবে। তাদের স্ত্রী-সন্তানেরা কী খেয়ে বাঁচবে?

এসব প্রশ্ন ওঠার কোনো দরকার হতো না, যদি সরকার নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচির শুরুতেই বা অন্তত এক সপ্তাহের মধ্যে জেলেদের প্রাপ্য সহায়তাটুকু দিয়ে দিত। কত সহায়তা? মাত্র ২০ কেজি চাল! এটা কেউ এখন বিশ্বাস করবে না যে সরকার ইচ্ছে করলে উপকূলের এসব জেলেদের এই সামান্য সহায়তাটুকু যথা সময়ে দিতে পারে না। বাংলাদেশ এখন এমন দেশ নয় যে, এ পরিমাণ সাহায্য জেলেদের দিতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। কিংবা দাতাগোষ্ঠীর শরণাপন্ন হতে হবে।

আমার মনে হয় বিষয়টা সম্পূর্ণ আন্তরিতার। যে সরকারি কর্মকর্তারা ১ অক্টোবর থেকেই নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন, জেলেদের ধরে ধরে শাস্তি দিচ্ছেন, জরিমানা করছেন, জাল পুড়িয়ে দিচ্ছেন- তাঁরা কি জানেন না জেলেদের ঘরের খবর? এমন তো নয় যে, হুট করে একটা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এটা তো পূর্ব ঘোষিত এবং নির্ধারিত কর্মসূচি। তাহলে এর এক অংশ বাস্তবায়নে আপনারা যতটা সক্রিয় বাকি অংশ বাস্তবায়নে ততটাই নিস্পৃহ কেন? তারা জেলে বলে? নিম্নগোত্রীয় বলে? তাদের জন্য রাজপথে সংগ্রাম হবে না বলে?

উপকূলীয় বরগুনাসহ কয়েকটি জেলায় খবর নিয়ে জানতে পারলাম হয়তো বিশ অক্টোবর থেকে জেলেদের চাল দেয়া শুরু হতে পারে।তাও ভালো যে শেষ মুহূর্তে হলেও বঞ্চিত মানুষেরা তা পাবে। কিন্তু আমার কথা হলো, যে চাল আমি এখন দিতে পারব, তা ২০ দিন আগে কেন দিতে পারব না? ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে এটা তো অসম্ভব ছিল না। সম্ভভ এই কাজটি যথাসময়ে করলে তো জেলেদের আর ঝুঁকি নিয়ে নদীতে নামতে হয় না, জেল-জরিমানার মুখোমুখি হতে হয় না্। সরকারের পক্ষেও কাজটা বেশ সহজ হতো। জেলেরা তাদের শতভাগ সহায়তা করতো। এখনো বেশিরভাগ জেলে কর্মসূচি মেনেই চলছে। বিক্ষিপ্তভাবে যারা আইন অমান্য করছে তাদের পক্ষে কথা বলার তখন কেউ থাকতো না।গণমাধ্যম সরকারি প্রচেষ্টাকে শতভাগ সমর্থন দিয়ে জেলেরা যাতে মাছ না ধরতে পারে সে ব্যাপারে সহায়তা করত।কিন্তু সবকিছুই যেন এখনো লাল ফিতার দৌরাত্মের কাছে হার মানছে।

আমি বলছি না, এটা খুব বড় ধরনের ডিজেস্টার। জেলেরা চাল পায়নি বলে না খেয়ে মরে গেছে বা উপকূলে বিপর্যয় নেমে এসেছে- তাও না। কিন্তু আমাদের কেন প্রশ্ন তুলতে হবে এই ছোট বিষয়ে, কেন টেলিভিশনের পর্দায় বারবার ভেসে উঠবে জেলেদের অসহায় মুখ- যারা বলছেন, সরকার তাদের প্রতিশ্রুত সহায়তা দিচ্ছে না! এই নেতিবাচক খবর তো আমাদের করার দরকারই হতো না যদি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা যথাসময়ে যথার্থ দায়িত্ব পালন করতেন। এখানে স্পষ্টতই জেলেদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমাজের নিম্নবর্ণের প্রতি এই হীনম্মন্যতার শেষ কোথায়?

লেখক: সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়