ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের শিল্পী সংগ্রামীর খোঁজ রাখেনি কেউ

দীপংকর গৌতম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৮, ৯ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের শিল্পী সংগ্রামীর খোঁজ রাখেনি কেউ

দীপংকর গৌতম : মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যেক বাঙালির জীবনের আকাঙ্খার ধন। এ আকাঙ্খা অনেক পুরনো। নানাকার, টঙ্ক, তেভাগা, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহসহ বিভিন্ন কৃষক সংগ্রাম বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ছোটখাটো সংগ্রামও স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে আলাদা ছিলো না। বাঙালির গণসংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় ৫২, ৬২, ৬৯-এর পথ পেরিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আসে মুক্তির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- আমাদের স্বাধীনতা।

২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে। নিরপরাধ নিরস্ত্র বাঙালির উপর চালানো নারকীয় হত্যার মধ্য দিযে তারা প্রতিবাদমুখর স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে চিরতরে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক ঐ পরিকল্পনার মাধ্যমে নারকীয় গণহত্যা চালালেও স্তব্ধ করা যায়নি বীর বাঙালিকে। শুরু হয় প্রতিরোধ। দেশ হানাদার মুক্ত করতে মরণপণ লড়াইয়ে অংশ নেয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, শিল্পী-সংগ্রামী নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ। পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবেলার জন্য গড়ে তোলে প্রতিরোধ। সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি মননশীলতার মধ্য দিয়েও যুদ্ধকে গতিশীল করা হয়। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

অন্যদিকে সংস্কৃতিকর্মী সনজীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। নানা রকম কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত ছিলেন তারা। তাদেরই একটি গানের দল বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়ে শোনাত। এসব জাগরণী গানের মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত হতো মুক্তিসেনারা। স্বাধীনতার স্বপ্নভরা চোখে তারা খুঁজে ফিরত শত্রুর বাংকার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চেতনা জাগানিয়া গান, আবৃত্তি, খবর, চরমপত্র- এগুলো ছিলো শত্রুর বিরুদ্ধে  ছোড়া এক ঝাক বুলেটের চেয়েও অনেক শক্তিশালী। দুর্বার মুক্তির লড়াই, মুক্তিবাহিনীর নিত্যদিনের বিজয়াভিযানের প্রদীপ্ত সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতারের ছোট স্টুডিও ঘরে বসে বিক্ষিপ্ত অবিন্যন্ত যন্ত্রপাতিতে রেকর্ড করে স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটারে প্রচার করা হতো।

শত্রু কবলিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম-নৃশংস হত্যার শিকারে পরিণত হওয়ার সমূহ বিপদের সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েও প্রতিটি বাঙালি সেদিনের লড়াইয়ের দিনগুলোতে ঘরের কোণে, লেপের ভেতরে, আড়ালে, রাতের আঁধারে লুকিয়ে শব্দ একেবারে কমিয়ে, কানের কাছে রেডিও নিয়ে বসতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যদি না থাকত তবে বিভিন্ন রণাঙ্গনের প্রতিদিনের খবর কে পৌঁছে দিত বাংলার ঘরে ঘরে? দুরন্তপ্রাণ সৈনিকের অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করত যখন শত্রুকে, মুক্তিসেনা যখন দৃপ্তপদভারে স্বদেশকে মুক্ত করত মরণপণ লড়াই করছে সেই খবর যদি স্বাধীন বাংলা বেতার প্রচার না করত, তবে অধিকৃত এলাকার যন্ত্রণাকাতর মানুষ কোথা থেকে পেত যুদ্ধদিনে বেঁচে থাকার প্রেরণা। গুটিকয়েক দুরন্ত জীবনপথিক সংগ্রামের যাত্রাপথে একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে যদি এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ না নিতেন, তবে কী হতো বলা মুশকিল।

শুধু তাই নয়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে চলত সাংস্কৃতিক লড়াই। এখানে বসেই গান লিখে, সুর করে গাওয়ার মধ্য দিয়ে চলত সংগ্রামের আরেক অধ্যায়। তবে শুরুতে এই কেন্দ্রের নিজস্ব গান ছিল না। তখন বাজানো হতো দেশপ্রেমের অমূল্য সব সংগীত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা দেশপ্রেম ও দ্রোহের গানের সঙ্গে গণনাট্য সংঘের গানগুলো গাওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রের গান প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর রাখে। এ সময় গোবিন্দ হালদার, আবদুল লতিফ, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, অপরেশ লাহিড়ী, সিকান্দার আবু জাফর, ফজল এ খোদা, আপেল মাহমুদসহ বিভিন্ন গীতিকারের লেখা গান গাওয়া হতো। এসব গানের মধ্যে ছিলো- ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা, মোদের গরব মোদের আশা, দেশের মানুষের কণ্ঠে ভেসে আসে, একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিণু পল্লী জননী কিংবা ধন ধান্য পুষ্পভরা, মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি, আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, ভয় কি মরণেসহ এমন অনেক দেশপ্রেমের উদ্দীপক গান। মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা যোগানো গানের মধ্যে সেই অমর গানটির কথা স্মরণযোগ্য। যে গানটি এখন আমাদের জাতীয় সংগীত- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

এমন সব দেশাত্মবোধক গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণে সঞ্চারিত করেছে যুদ্ধের চেতনা, দেশের মানুষের মনে জাগিয়েছে স্বাধীনতার আশার বাণী। এক ঝাঁক মুক্তিকামী শিল্পী, সুরকার, গীতিকারের সমন্বয়ে তৈরি গান গাইতেন শিল্পীরা। মুক্তিসেনারা এসব গান শুনে উদ্দীপ্ত হয়ে মাতৃভূমি রক্ষায় শত্রুর বাংকারে হানা দিত। সেইসব গান আজ ইতিহাস। বাংলাদেশের জন্মদাগ যদি মুক্তিযুদ্ধ হয় তাহলে গেরিলা যোদ্ধাদের চেযে এসব শিল্পী কুশলীরাও কোনো অংশে কম নন। গীতিকার গোবিন্দ হালদারের লেখা গানে সুর দিলেন সংগীত পরিচালক সমর দাস। সে গান ধমনীতে  ছড়িয়ে দিলো মুক্তির নেশা :

 

পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে

 

রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল

জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে

রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল…


কবি সিকান্দার আবু জাফরের লেখা গানে সুর দিলেন সুরকার শেখ লুৎফর রহমান। শিল্পীরা গাইলেন :

জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই

জনতার সংগ্রাম চলবেই…

গীতিকার নঈম গওহরের গানে সুর দিলেন আজাদ রহমান। গাইলেন কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন। এ গানে জনসমুদ্রে ঝড় ওঠে। মুক্তিসেনার চোখে উঁকি দেয় নতুন এক সকাল:

জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো

এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাক

তোমার কথায় হাসতে পারি

তোমার কথায় কাঁদতে পারি

মরতে পারি তোমার

বুকে যদি রাখো আমায়…


মুক্তিসেনাদের উদ্বুদ্ধ করার আরেকটি শাণিত অস্ত্র ছিল গান। এমনই একটি গোবিন্দ হালদারের লেখা গানে সুরারোপ করে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা আপেল মাহমুদ:

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।

মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি…

শিল্পী আপেল মাহমুদের লেখা আরেকটি অমর সংগীত, যে গানে এখনও মানুষ উদ্দীপ্ত হয়। গানটিতে শিল্পী নিজেই সুরারোপ করে কণ্ঠ দেন। যদিও এটি একটি সমবেত সংগীত:

তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে,

আমরা ক'জন নতুন মাঝি

হাল ধরেছি শক্ত করে রে…

বাংলাদেশের রূপের বর্ণনা দিয়ে কলকাতার গীতিকার শ্যামল গুপ্ত লিখেছেন একটি স্নিগ্ধ শ্যামল গান। বাংলার চিরন্তন রূপ দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। হাজার বছর পরে হলেও বাংলার রূপের আকর্ষণে আবার ফিরে আসতে হয়। অপরেশ লাহিড়ীর সুরে গানটি গেয়েছেন শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী আবদুল জব্বার:

হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে

বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে…

গীতিকার, ভাষাসৈনিক ও সুরকার আবদুল লতিফ সেই দেশের কথাই মুক্তিযোদ্ধাদের শুনিয়েছেন তার গানে। যেমন:

সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা

সোনা নয় তত খাঁটি

বলো যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি

বাংলাদেশের মাটি

আমার বাংলাদেশের মাটি ...

মুক্তির অবারিত দ্বার খুলে দিতে গীতিকার নঈম গওহর লিখলেন আরেকটি গান। তাতে সুর দিলেন সংগীত পরিচালক ও সুরকার সমর দাস:

নোঙর তোল তোল

সময় যে হলো হলো

নোঙর তোল তোল…

একটি লাল-সবুজ পতাকা মুক্ত আকাশে উড়াতে গীতিকার গোবিন্দ হালদার লিখলেন। সুরারোপ করলেন শিল্পী আপেল মাহমুদ এবং কণ্ঠ দিলেন শিল্পী স্বপ্না রায়:

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে

বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা…

কবি ও গীতিকার ফজল এ খোদা লিখলেন এবং তাতে কণ্ঠ দিলেন শিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার:

সালাম সালাম হাজার সালাম

সকল শহীদ স্মরণে,

আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই

তাদের স্মৃতির চরণে…


গানের এই তালিকা দীর্ঘ। শুধু যে বাঙালিরাই মুক্তিযুদ্ধের সময় গান গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন যুদ্ধপীড়িত দেশের মানুষদের তা নয়। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশী শরণার্থীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলেন সে সময় জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জোয়ান বায়েজসহ আরো অনেকে! লাখো মানুষের অংশগ্রহণে সফলভাবে আয়োজিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আরেক অধ্যায়। ইতিহাস যার সাক্ষী। এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলো। নতুন পতাকা শোভিত হলো ঘরে ঘরে। আনন্দের জোয়ারে ভেসে গেল বাঙালির হৃদয়। তারপরের ইতিহাস রক্তের দাগে ভরা। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানপন্থী শাসন শুরু হয়। শুরু হয় ক্ষমতা দখলের খেলা। একাত্তরে যেসব মহানায়কেরা জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন তারা হয়ে পড়েন ব্রাত্যজন। মানবেতর জীবন যাপন করে বেঁচে থাকেন অনেক মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা পড়ে ইতিহাস। বিক্ষত করা হয় সংবিধান। এ সময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা ছিলেন তাদের যে ধরনের ভূমিকা রাখার কথা ছিলো, তা করেননি। অনেক মুক্তিযোদ্ধার মতো সেই অগ্নিঝরা দিনের শিল্পী সংগ্রামীর খোঁজ রাখেনি কেউ। তাদের সম্মান জানালে জাতি সম্মানিত হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি শিল্পী সংগ্রামীদেরও তালিকা করে তাদের খবর নেয়া জরুরি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়