ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে বিজয় বাঙালির শাশ্বত প্রেরণা

সাহেদ মন্তাজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় বাঙালির শাশ্বত প্রেরণা

|| সাহেদ মন্তাজ ||

শুরুতেই বিশ্বকবির একটি উদ্ধৃতির উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন: ‘মানুষের ইতিহাস শান্তচিত্তে অপেক্ষা করে আছে লাঞ্ছিতের বিজয় ঘোষণার জন্য।’ আর বাঙালিকে এই বিজয় অর্জনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার বছর। তবে বাংলাদেশের জনগণ সৌভাগ্যবান এক জাতি। কেননা, মুক্তিযুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ। পৃথিবীর খুব বেশি দেশ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জন্মলাভের গৌরব অর্জনে সক্ষম হয়নি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো ছিল একইসঙ্গে আনন্দ ও বেদনাবিধুর। স্বজন হারানোর ব্যথা আর সম্ভাবনাময় এক গৌরবভূমির আবির্ভাবের আনন্দ একাত্তরকে এ দেশের সহস্র বছরের ইতিহাসে অনন্য করে রেখেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন গৌরবজনক তেমনি বেদনাদীপ্ত এক ইতিহাস।

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। দু’শো বছরের সংগ্রামের পরিণতিতে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান। কিন্তু স্বাধীনতা চিহ্নিত হলো একটি জটিল বিভাজনে- ভারত ও পাকিস্তান। বাঙালি মুসলমান এর মধ্যেও আশার আলো দেখেছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শুরু থেকেই বাংলার ভাষা ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিতে চাইলো। সেজন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র দু’মাসের মাথায় পাকিস্তান গণপরিষদের একজন বাঙালি সদস্য ঘোষণা করেছিলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে এ ধারণা বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানকে উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কেবল একটি উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’

১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার মধ্যকার গড়ে ওঠা সম্পর্ককে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন রিচার্ড নেশনকে সমর্থন করে বলেছেন: ‘অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতাবাদ’। করাচীকেন্দ্রিক পশ্চিম পাকিস্তান হয়ে পড়ল কেন্দ্র এবং পূর্ব বাংলা থেকে গেল প্রান্ত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিসরে পশ্চিম পাকিস্তানে শক্তিশালী হলো বিরাট ভূমিমালিক শ্রেণী, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলো পাঞ্জাবী আমলাতন্ত্রের হাতে, বিকশিত হলো একটি বুর্জোয়া শ্রেণী। অথচ গণতান্ত্রিক অবস্থায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র শাসনের অধিকার ছিল পূর্ব বাংলার। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার করে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলশ্রুতিতে তারা সামান্য অজুহাতে শক্তি প্রয়োগ করত। যেমন মিশেল ফুকো দেখিয়েছেন, রাষ্ট্র ও বুর্জোয়া সমাজের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো শক্তির সামগ্রিক ব্যবহার। বুর্জোয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রেও সামরিক শাসক গোষ্ঠীর শক্তির নগ্ন ব্যবহার অনিবার্য করে তুলেছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে। আর মুক্তিযুদ্ধের এই ইতিহাস সৃষ্টিতে কাজ করেছে এ দেশবাসীর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। ১৯৭১- এর ২৫শে মার্চ শুরু হলেও এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল, বলা যায়, পাকিস্তানি শাসন-শোষণের তেইশ বছর ধরে। এই পটভূমি কয়েকটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে তৈরি হয়েছিল।

প্রথমত পাকিস্তান রাষ্ট্রের খসড়া সংবিধান প্রণয়নের জন্য পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক নিযুক্ত মূলনীতি কমিটির প্রথম খসড়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জনের প্রথম পর্যায় সূচিত হয়। খসড়া সংবিধানে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে বিবেচনায় আনা হয়নি। ঐ রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারিতে পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ নামে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সংগঠনের সৃষ্টি হয়েছিল।

বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তার দ্বিতীয় ও প্রধানতম রাজনৈতিক স্ফূরণ ঘটে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। শুধু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে এত বড় আন্দোলন পৃথিবীর কোথাও সংঘটিত হয়নি। এ আন্দোলন কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল অথবা কোনো জনগণমন অধিনায়ক শুরু করেননি এবং এর নেতৃত্ব দেননি। বলা হয়, উন্মথিত প্রকৃতির মধ্য থেকে উত্থিত ঝড়-তুফানের মতই বাংলাদেশের সমাজে এ আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল।

যে পূর্ব পাকিস্তানি মুসলিম সম্প্রদায় তথা বাঙালি মুসলমান পশ্চিমী মুসলমান এবং তার সবকিছুকে, তার বর্ণমালাসহ উর্দু ভাষাকে চিরকাল প্রশ্নহীনভাবে সম্মান জানিয়ে এসেছে সেই বাঙালি মুসলমানকে উর্দুর একাধিপত্যের বিরোধিতা করে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হলো। কেননা এ কোনো ক্ষণস্থায়ী আবেগ ছিল না, জাতীয় লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর ব্যাপ্তি, এর নিরাপোস দৃঢ়তা, এর তীব্রতা, এর দীর্ঘস্থায়িত্ব এমন ছিল যে কোনো বাঙালি মুসলমান প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করার সাহস পায়নি। যে দুঃসাহস অনেকে মুক্তিযুদ্ধে দেখিয়েছে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন অবশ্য শুধু ভাষা আন্দোলন ছিল না। এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী। প্রধানত, এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের মানুষ ‘জাতি’ হয়ে উঠেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ের, জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে রক্তলাল তোরণদ্বার। বাঙালির অন্তরে সঞ্চিত অগ্নিপ্রভ স্বদেশপ্রেমের প্রখর জ্বালামুখ এই ভাষা আন্দোলন।

১৯৫৪- তে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে এ দেশের জনগণ মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। যুক্তফ্রন্ট ২১-দফা দাবি নিয়ে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। এই ২১-দফার মধ্যে প্রথম দাবি হলো, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ এবং ১৯নং দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন । এই ২১-দফার প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের আপামর মানুষের কি পরিমাণ সমর্থন গড়ে উঠেছিল, নির্বাচনের ফলাফল তার সাক্ষ্য বহন করে। যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন ও মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে। কিন্তু তারপরও যুক্তফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করা হয়।

১৯৫৬-১৯৬১ কালপর্বে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যায়। ১৯৬২- তে সংবিধান বিরোধী ও শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন ছিল মূলত আইয়ুববিরোধী আন্দোলন। সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে হামিদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের মাধ্যমে শিক্ষা সংকোচনের চেষ্টা করলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজে ব্যাপক বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে সশস্ত্র বাহিনী গুলি চালালে সেদিন ১৭ই সেপ্টেম্বরে ওয়াজিউল্লা, বাবুল ও মুস্তাফিজুর শহীদ হন।

এরপর ক্রমান্বয়ে আসে ১৯৬৪-এর মৌলিক গণতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬- এর ছয়-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন। ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন করে। নির্বাচনের রায় অনুসারে কেন্দ্র সরকার গঠনের অধিকার ছিল আওয়ামী লীগের। কিন্তু ১৯৭১-এর ১লা মার্চে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে বাংলাদেশজুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বাংলার আপামর মানুষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

২৫শে মার্চ ১৯৭১-এ বাংলাদেশে অন্ধকার নেমে আসে। অপারেশন সার্চলাইটের নামে পাক হায়েনারা হিংস্র থাবা নিয়ে বাংলার ঘুমন্ত নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাটি ভিজে যায় রক্তে। তাইতো কবিকে বলতে হয়েছে: ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়/তেমন যোগ্য সমাধি কই ?’ মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। তিনি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেন আজ থেকে বাংলার মানুষ স্বাধীন। শুরু হলো যুদ্ধ।

ব্যাপক কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই প্রায় নিরস্ত্র বাঙালিকে সেদিন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। পাকিস্তানি সামরিক চক্রের আকস্মিক আক্রমণ ও গণহত্যার মুখে আপামর বাঙালির যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ব্যাপার খুব কমই ঘটেছে যেখানে ব্যাপক পূর্ব-প্রস্তুতি বা সাংগঠনিক তৎপরতা ছাড়াই শত্রুর বিরুদ্ধে একটি বিরাট আকারের সশস্ত্র প্রতিরোধ সংঘটিত হয়েছে। ফরাসি বিল্পব থেকে শুরু করে সমসাময়িক ভিয়েতনাম যুদ্ধকে অতিক্রম করেছে বাংলার মুক্তিযুদ্ধ। যেমনটি উচ্চারিত হয়েছে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার কবিতায়: ‘হাতিয়ারহীন প্রস্তুতি নেই এল যুদ্ধের ডাক/এল মৃত্যুর এল ধ্বংসের রক্ত মাখানো চিঠি।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধের উত্তেজনায় পীড়িত এক বিশ্ব পটভূমিকায়। গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বিপুল গণরায়ে বিজিত পক্ষকে অস্ত্রের শক্তিতে নিশ্চিহ্ন করার বর্বর সামরিক অভিযান রুখে দাঁড়াবার প্রয়াস থেকে এর সূচনা। কিন্তু বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের আকাঙ্ক্ষা পশ্চিমা দেশের সরকারের আনুকূল্য লাভ করতে পারেনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় মেনে নিতে রাজি ছিল না পশ্চিমা ও আরব বিশ্বের বহু দেশ। অপরদিকে প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে অচিরেই ব্যাপক সমর্থন যুগিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ। এর ফলে শক্তি ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে পারমাণবিক উত্তেজনায় টানটান পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে উঠতে পারে এমন একটা ভয় সবার ছিল। বর্তমান  সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিলোপ-উত্তর বিশ্ব পটভূমিকায় ঐ পরিস্থিতির অনুধাবন প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করেন বিজ্ঞজন।

পরিস্থিতি যত বৈরীই হোক না কেন, এ দেশের জনগণের রক্তাক্ত সংগ্রামের ফল হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব কেউ ঠেকাতে পারেনি। কিন্তু আমাদের জনগণকে এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বড় বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তধারা, দু লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানী ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত ও জঘন্য গণহত্যার ইতিহাস তৈরি করেছিল বাংলার বুকে। এই বেদনার অথচ গৌরবের ইতিহাস যথার্থভাবেই তুলে ধরেছেন প্রাবন্ধিক আব্দুল হক, ‘একাত্তরের গৌরবোজ্জ্বল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আগে বহুকাল বাংলার মাটিতে যুদ্ধ হয়নি। সিপাহী বিপ্লবের সময় চট্টগ্রামে, সিলেটে এবং ঢাকায় যে সংঘর্ষ হয়েছিল তা ছিল ছোটখাটো ব্যাপার, সিপাহী বিপ্লবের ছিটেফোঁটা মাত্র। তিতুমীরের বিদ্রোহ দমনের জন্য উল্লেখনীয় সংখ্যক সৈন্য নিয়োগের দরকার হয়নি। শুধু পলাশীর যুদ্ধই ছিল কিয়দংশে প্রকৃত যুদ্ধ; তবু পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ নয়। মীর জাফরের অধীন বাহিনী যুদ্ধ করলে যুদ্ধ হতে পারত। ইতিহাসের আরো পেছনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কেননা এখানে বলার কথা এই যে বাংলাদেশের মাটিতে বহুকাল আগে বাংলাদেশে সংঘটিত এসব যুদ্ধে প্রধানত বাঙালি অস্ত্র ধরেনি। তিতুমীরের বিদ্রোহ ছাড়া আর কোন যুদ্ধে সশস্ত্র বাঙালির ভূমিকা প্রধান ছিল এমন কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তিতুমীরের বিদ্রোহ যে কোনো বড় রকমের ব্যাপার ছিল তাও নয়। সেই বাঙালি যুদ্ধ করেছে ১৯৭১ সালে। ব্যাপ্তি, তীব্রতা এবং সমগ্র জনসমাজের অংশগ্রহণের দিক দিয়ে বাঙালির ইতিহাসে এর তুলনা নেই। আর এ যুদ্ধ বাঙালি করেছিল অধিকতর সশস্ত্র শিক্ষিত অভিজ্ঞ বাহিনীর বিরুদ্ধে সবকিছু জেনে শুনে। শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা সবই তার ছিল স্বপ্ন, কিন্তু সংগ্রামী ঐক্য, দৃঢ়তা এবং তীব্রতা বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে অতুলনীয়, অভাবনীয়। এটা ছিল বাঙালির নবজন্ম। এই যুদ্ধের আগে বিশ্বসমাজে বাঙালির পরিচয় ছিল না, অথবা থাকলেও সে পরিচয় সম্মানিত ছিল না। জাতি হিসেবে এবং বিপ্লবী সংগ্রামী হিসেবে বিশ্বসমাজে বাঙালির এই প্রথম পরিচয়। আর এ পরিচয় সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।’

এ জন্য যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে স্মরণকালের ইতিহাসে তার জুড়ি বেশি নেই। এ প্রসঙ্গে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না:

‘এ নহে ভিয়েতনাম

কিংবা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নাগাসাকি অথবা হিরোসিমা

মাইলাই-এর রক্ত পিপাসা

কিংবা পলাশীর রক্তক্ষয়...তাও নয়

নয় রক্তক্ষয়ী রুশ বিপ্লব

নয় সিপাহী বিদ্রোহ

এ আমার দেশ

প্রচণ্ড ভয়াল শত হিরোসিমার

প্রলয়ংকার বিস্ফোরণ এই ক্ষুদ্র স্থানে।’

মুক্তিযুদ্ধকালে গ্রামে-গ্রামে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বহু ঘটনার উদ্ভব হয়েছে, স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে বহু বীরত্বগাথা, বহু ত্যাগ-তিতীক্ষা বিশ্বাসঘাতকতা, অত্যাচার ও নিপীড়নের কাহিনি। তাই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রক্তাক্ষরে লেখা এক গৌরবোজ্জ্বল মহাকাব্য। এই মহাকাব্য আনন্দের, গৌরবের। মুক্ত মাটিতে, মুক্ত আকাশে নিঃশ্বাস নেওয়ার আনন্দ, এবং সশস্ত্র বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ার গৌরব, স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর গৌরব। কিন্তু এই আনন্দ ও গৌরবের সাথে আছে বেদনার মিশ্রণ। স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা-সন্তান, ভাই-বোন, বন্ধু, প্রতিবেশী- পরস্পরকে হারানোর বেদনা, সম্ভ্রম হারানোর বেদনা, সহায়-সম্বল হারানোর বেদনা, চিরতরে পঙ্গুত্বের বেদনা, নিঃস্ব হওয়ার বেদনা। তাই মুক্তিযুদ্ধ একই সাথে আনন্দ ও বেদনার গৌরবগাথা। আদর্শের প্রগাঢ়তায়, ত্যাগের ঐশ্বর্যে আর নেতৃত্বের বলিষ্ঠতায় এ সংগ্রাম প্রদীপ্ত। এই সংগ্রামের ইতিহাস বাঙালিকে দেশমাতৃকার প্রেমে অবিচল থেকে সকল সংকট উত্তরণে এবং সকল আনন্দ ও বেদনায় চিরকাল অনুপ্রেরণা যোগাবে।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক, পিএইচ.ডি গবেষক, বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়