ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

অভিবাসন নীতি, কূটনীতি || সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৬, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভিবাসন নীতি, কূটনীতি || সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। বাংলাদেশ সরকার গুরুত্বের সাথে দিনটি পালন করছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিরাপদ অভিবাসনের উপরই গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি।

ছোট দেশ, বিপুল জনসংখ্যা, ভয়ংকর বেকার সমস্যা ও কর্মসংস্থান ঘাটতি। ফলে প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে বহুসংখ্যক মানুষ বাইরে পাড়ি জমাতে লড়াই করছে। বিদেশ গিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তারা দেশের জন্য রেমিট্যান্স পাঠান। এতে দেশের অর্থনীতি সবল হয়, প্রবৃদ্ধি বাড়ে, উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। কিন্তু দেশ তাদের জন্য কী করছে?- এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ বছর অভিবাসন খাতে রেকর্ডসংখ্যক ৯ লাখ ৬৪ হাজার কর্মীর বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে বলে সরকার থেকে জানানো হয়েছে।

নিরাপদ অভিবাসনের বিষয়টি খুব সহজ নয়। শ্রমিকদের নিজস্ব সচেতনতা খুব কম এবং সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ আর উদ্যমেও সমস্যা আছে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ায় তরুণ সমাজ, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজ জীবনের অভাবী ঘরের ছেলে, মেয়েরা কাজের জন্য মরিয়া। এই মরিয়া ভাবটার কারণে, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে দালালদের প্ররোচনায় অবৈধ পথে এমনকি বৈধ পথে গিয়েও অনিরাপদ অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে অনেকেই। সরকারও এ বিষয়ে অবগত এবং অবৈধ পথে অভিবাসন ঠেকাতে প্রশাসনের সক্রিয়তা আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রবাসী আয়নির্ভর দেশ হওয়ায় অভিবাসন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এখানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নামে আলাদা মন্ত্রণালয় করাও হয়েছে।
সর্বাধিক সংখ্যায় অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৬২টি দেশে প্রায় এক কোটি অভিবাসী শ্রমিক কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিবাসন বিষয়ে সুষ্ঠু বৈশ্বিক নীতি প্রণয়নের কথা বলে আসছেন। এই বাস্তবতায় আমাদের অভিবাসন নীতি ও কূটনীতির স্বরূপ কী হতে পারে- সেই আলোচনা প্রয়োজন।  

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ যেহেতু অভিবাসী শ্রমিকদের দিক থেকে আসে, সেজন্য আর সুযোগ নেই অপরিকল্পিতভাবে বিষয়টি দেখার। আমাদের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস ছিল যেকোনভাবে লোক বাইরে পাঠাতে হবে। এখন বদলে যাওয়া দুনিয়ায় সেই অবকাশ নেই আর। আন্তর্জাতিক পরিবেশে কাজ করার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন তা আমাদের শ্রমিকদের দিতে হবে। শিক্ষা, ভাষা পারদর্শিতা, সংস্কৃতি-বোধ, আচরণ-বিধি এখন শ্রমিক পাঠানোর প্রধান বিবেচ্য হতে হবে। আমাদের অভিবাসী শ্রমিকদের অর্ধেকই অদক্ষ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণের অভাবে শ্রমিকরা বিদেশ থেকে বড় অংকের অর্থ উপার্জনে ব্যর্থ হচ্ছে।

অদক্ষতার কারণে বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকরা মূলত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ পান। এক্ষেত্রে তাদের বেতন খুব কম হয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের চুক্তিপত্র সম্পাদিত হয় না। ফলে পদে পদে তারা হয়রানি ও প্রতারণার শিকার হন। বিদেশগামীদের খরচ মাত্রাতিরিক্ত, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। সরকারীভাবে নির্ধারিত হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শ্রমিকরা অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। যাওয়ার বেলায় এমন অতিরিক্ত ব্যয় তার আয়কে কোনভাবে স্বস্তির স্থলে আনতে পারছে না।

দেশের শীর্ষ জাতীয় আয়ের অংশীদার অভিবাসন খাতে আধুনিকীকরণ এখন সময়ের চাহিদা। স্বচ্ছ ও সৃজনশীল নীতি প্রণয়ন করেই স্বস্তি আনতে হবে। কূটনীতির প্রসঙ্গে বলতে চাই, উন্নয়ন অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিবিড় দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সম্পর্কের বিকল্প নেই। আমাদের আলাদা মন্ত্রণালয় আছে, কিন্তু একই সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাকে আরো বিস্তৃত করতে হবে। দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বড় সমন্বয় প্রয়োজন।

অভিবাসনে সাফল্য চাইলে প্রাতিষ্ঠানিকতার বিকল্প নেই। বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক তৈরির প্রয়োজনে ভিন্ন ভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অদক্ষ শ্রমিকের যে ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছ, তা থেকে বের হতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শ্রম অভিবাসন পড়ানো যায় কিনা ভাবা দরকার। গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করলে্ অবশ্যই একটি টেকশই শ্রম-অভিবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

দীর্ঘদিনের সমস্যা অভিবাসন ব্যয়। সংখ্যায় সাফল্য থাকলেও অভিবাস ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এবং এটিই এখন পর্যন্ত সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অভিবাসন ব্যয় কমানো, ভিসা ট্রেডিং বন্ধ করা, নতুন শ্রমবাজার তৈরি করা, দক্ষ কর্মী প্রেরণ, ডায়াসপোরাদের সম্পৃক্ত করা, নারী কর্মীদের সুরক্ষাসহ অভিবাসী কর্মীদের সার্বিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ বিধান করার কাজ করছে সরকার ঠিকই, কিন্তু কোথাও একটি বড় সমস্যা রয়েই গেছে। অনলাইন ভিসা চালু, কর্মী প্রেরণে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতির ব্যবস্থা, স্মার্ট কার্ড প্রবর্তন করা গেলেও দালাল ও মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। বিদেশে কর্মী প্রেরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, দুর্নীতি, অনিয়ম, হয়রানি ও প্রতারণা বন্ধ করার কোন সৃজনশীল ব্যবস্থা খুঁজে পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা।

প্রায ৩০টি দেশে লেবার অ্যাটাচি নিয়োগ, কয়েকটি দেশের সঙ্গে স্বল্পব্যয়ে বা বিনা খরচে জিটুজি পদ্ধতিতে শ্রমিক প্রেরণসহ বিভিন্ন দেশে আনডকুমেন্টেড বাংলাদেশি কর্মীদের ডকুমেন্টেড করা অভিবাসন কূটনীতির ইতিবাচক দিক। কিন্তু তারপরও কর্মী প্রেরণে নিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করাটাই সরকারের জন্য এখনো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

দক্ষ জনবল সৃষ্টি করে সুস্থ অভিবাসন প্রক্রিয়ার পথে উদ্ভূত বাধাগুলো চিহ্নিত করতে গেলে সব ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সৃজনশীলতা ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। আরেকটি বিষয় কখনো আলোচনায় আসে না। বিদেশে কর্মপ্রত্যাশীদের যেমন নিরাপদ অভিবাসন প্রয়োজন, তেমনি তাদের প্রেরিত অর্থের সঠিক ব্যবহার কী হবে তা নিয়ে কোন সুস্থ পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। ভালো পরিকল্পনা, নীতি ও কূটনীতি চাই কিন্তু সেই সাথে চাই সদিচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল, সততা, আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতা।

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টিভি

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়