ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ত্রিভুবনের জন্য শোকগাথা

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১০, ১৪ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ত্রিভুবনের জন্য শোকগাথা

জাফর সোহেল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আসাদুল হক কাজ করে পরিকল্পনা কমিশনে। সোমবার বিকেলে তার একটি প্রশিক্ষণ ক্লাস ছিল। সেখানেই বারবার তাকে ফোন করছিলাম আমরা ক’জন পরিচিত গণমাধ্যমকর্মী। কী খবর, কিছু জানা গেল কি না, পরিবার কী বলছে, তোমার সঙ্গে কোনো কথা হয়েছে কিনা- নানা প্রশ্ন। সেও যথাসম্ভব তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছিল। এই যোগাযোগের শেষটা ছিল চার শব্দে-‘মনে হয় আর নেই!’

টেলিফোনের ওপারে কণ্ঠটা কতটুকু কেঁপে উঠেছিল জানা হয়নি। এপারে আমরা যারা শুনছি, কিছু মুহূর্ত তাদেরও দম আটকে ছিল। পরিকল্পনা কমিশনের দুই কর্মকর্তা নাজিয়া আফরিন আর উম্মে সালমা ততক্ষণে ‘সংবাদ’ শিরোনামে পরিণত হয়েছেন। উপরওয়ালার কাছে যে পরিকল্পনা কমিশন আছে, এখন থেকে হয়ত তাঁদের কর্মস্থল সেখানেই; স্বর্গের মানুষদের উন্নয়নের জন্য তাঁরা পরিকল্পনা করবেন! সালমার ভাই বলছিলেন, ‘জিও লেটার’টা একদিন পরে এলেই বেঁচে যেতেন তিনি। কিন্তু জীবনের জিও লেটার তো ওপরওয়ালা পাঠিয়ে দিয়েছেন আগেই। কার কী করার আছে?

কী রুদ্ধশ্বাস একটি দিন বাংলাদেশের! ১২ মার্চ, ২০১৮, সোমবার। অনাদি কালের ক্যালেন্ডারেও হয়তো কিছু মানুষ খুঁজে ফিরবেন তারিখটি। ক্যালেন্ডারের পাতার কালো তারিখগুলোর মতো এদিনটিও কালো হয়ে রবে অনেকের কাছে। সোমবার বিকেল থেকে ফেসবুকের পাতাজুড়ে একের পর এক কেবল ছবি হয়ে ভেসে উঠছিলেন ইউএস বাংলা এয়ারলায়েন্সের যাত্রীরা। সঙ্গে ছিল ছবিগুলোর ভেতরে থাকা প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার সেই মর্মন্তুদ ঘটনার কথা। সেসব দেখে দেখে, পড়ে পড়ে কারো চোখের জল বাষ্প হয়ে মিলেছে শোকের বাতাসে। কারো বা ঝরনার মতো গড়িয়ে পড়েছে অশ্রুধারা। যার যায় সে বোঝে। তবু আজ কেন জানি মনে হয়, গোটা বাংলাদেশই বুঝতে পারছে- যাদের গেছে, তাদের কতখানি গেছে। গোটা বাংলাদেশই আজ কাঁদছে।

হিমালয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল মায়ায় এসে পড়েছিলেন নেপালের ১৩ মেধাবী মুখ। সিলেটের জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া মেডিকেলকে বানিয়েছিলেন স্ব্প্নবোনার বাসা।  কে জানতো, বাবুই পাখির বাসার মতোই একদিন হঠাৎ ঝড়ে ছিন্ন হবে তাঁদের এত কষ্টে গড়া স্বপ্নের সেই ঘর। তাঁরা সদ্যই দিয়েছেন এমবিবিএস শেষ বর্ষের পরীক্ষা। কিন্তু সেই পরীক্ষার ফল তাদের আর জানা হলো না। যতটুকু জানি, পরজনমে বিশ্বাস আছে মানবসেবার কারিগর বনে যাওয়া এই চনমনে তরুণ-তরুণীদের। হয়তো তাদের জন্য বিশেষ কোন পরিকল্পনা আছে ঈশ্বরের। কিন্তু সেই মায়ের কী হবে, যিনি পুষ্পের ডালি নিয়ে বসে ছিলেন ত্রিভুবন বিমানবন্দরে; কিংবা সেই বাবার কী হবে, যার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায় ছিল একমাত্র কন্যা; সেই ভাইয়ের কী হবে, যে বোনকে সারপ্রাইজ দেবে বলে না জানিয়েই হাজির হয়েছেন এয়ারপোর্টে; সেই প্রেমিকের জন্যই বা কী সান্ত্বনা, যে বকুল ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল ত্রিভুবনে। আমরা জানি না। আমরা শুধু জানি, ওপারে ভালো থাকবেন বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখা এই আবছায়া মুখগুলো। স্বর্গে তাঁরা মানুষের চিকিৎসা করবেন!

চিকিৎসক প্রায় হয়েই গিয়েছিলেন গোপালগঞ্জ মেডিকেলের এমবিবিএস শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী পিয়াস রায় রনি। মা পূর্ণা রানির জীবনে পূর্ণতা এনে দিতে বাকি ছিল মাত্র কিছু দিন। ছেলে ডাক্তার হবে, বাংলাদেশের মায়েদের এরচেয়ে গর্বের আর কী আছে! কিন্তু দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর শখের সঙ্গে পিয়াসের মনে যে জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ারও একটা শখ ছিল, তা কে জানতো। মা পূর্ণা আর ছোট বোন শুভ্রার অপেক্ষাটা চিরদিনের করে রেখে গেছেন পিয়াস। ওপারে নিশ্চয়ই অনেক ঘুরবেন তিনি; কেবল মায়ের ডাকে আর ছুটে আসবেন না! পূর্ণা রানির কোল চিরদিনের জন্য ফাঁকা হয়ে গেল।

প্রিয়ন্ময়ী শব্দের অর্থ কী? আমি জানি না। তবে বুঝতে পারি, ছোট্ট এই মা-মনির নামটা কতটা আবেগ বহন করছে; কতটা ভালোবাসার ফসল, কতটা প্রিয় মুখ ফটোগ্রাফার ‘প্রিয়ক’র কাছে। ‘বিএস-২১১’ উড়োজাহাজে ছিল প্রিয়ন্ময়ী। ছিল বাবা প্রিয়কও। কেউ আর নেই। মা এ্যানি আছে হাসপাতালের বিছানায় জীবন-মৃত্যুর মাঝে। তিনি কি ফিরে আসবেন? ফিরে এসে কী করবেন; জীবন ঘিরে ছিল যে মুখগুলো, সেগুলো তো পাড়ি জমিয়েছে ওপারের জীবনে; এপারে একা জীবনের বোঝা কী করে বইবেন!

পাখি হয়ে ওড়ার নাকি খুব ইচ্ছে ছিল পাইলট পৃথুলা রশিদের। কী সৌভাগ্য তাঁর, সত্যি সত্যিই উড়ে বেড়াচ্ছিলেন পৃথিবীর আকাশে আকাশে। আকাশে বিচরণ শেষে পাখিদের মতোই দিনশেষে ফিরে আসতেন নীড়ে। মা-বাবা আর ভাইবোনের কাছে। কিন্তু সোমবার ঘটল বিপত্তি। ডানা ভেঙে পথ হারান মানবপাখি পৃথুলা। পৃথিবীর সব পাখি ঘরে ফিরবে একদিন, পৃথুলা আর কোনদিন ফিরবেন না। নেপালের ফুটবল মাঠের সবুজ ঘাসের সঙ্গে পুড়ে গেছে তাঁর উড়ে চলার শক্তি।

হাতে এখনো মেহেদির রং লেগে আছে এমন এক নবদম্পতিও ছিলেন অভিশপ্ত ফ্লাইটটিতে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার মতো তাদের স্বপ্নগুলো টুকরো টুকরো করে দিল সোমবারের দুপুর। বিয়ের সপ্তম বার্ষিকী উদযাপনে ইউএস বাংলায় চেপেছিলেন চিকিৎসক শাওন আর স্ত্রী শশী। শশী আর নেই, শাওন কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বেডে। ওপারে একযোগে এত মানুষের হানিমুন! ঈশ্বর, সব ঠিক আছে তো? আরেকজন যাওয়ার আগে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন- তৃতীয় হানিমুনে যাচ্ছেন! হানিমুনের জন্য হিমালয় কন্যা নেপাল দারুণ পছন্দের জায়গা, সন্দেহ নেই। কিন্তু কে জানতো, তাদের জীবন নিয়ে উড়ে চলা পাখিটা ডানা ভেঙে পড়ে যাবে সেদেশের ফুটবল মাঠে! এটাই হয়তো কপালের লিখন- তৃতীয় হানিমুনটা স্বর্গেই করবেন প্রাণোচ্ছ্বল এই দম্পতি! 

গল্পের পর গল্প। পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়, ফেসবুকে। একেকটি গল্প পড়ি আর বুকের ভেতরে দলা বেঁধে ওঠে কান্নার রোল। চেনা মানুষেরা তো আছেনই, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আজ অচেনা মানুষদেরও কষ্টের সীমা নেই। আহা, কোন মায়ের বুকটা খালি হয়ে গেল; কোন বাবা হারালেন সন্তান; কোন নারী বিধবা হয়ে গেলেন কিংবা কোন শিশুরা হয়ে গেল এতিম- এমন আফসোস আর দীর্ঘশ্বাস ঘিরে ধরেছে বাঙালি মায়েদের।

চলার পথে বিপদ আসবেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন নষ্ট করে দিতে পারে অনেক মানুষের স্বপ্ন তেমনি অস্বীকার করার উপায় নেই, বর্তমানে মানুষ নিজেরাই কারণ হয় অনেক দুর্যোগ দুর্ঘটনার। এই বাংলাদেশে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ডুবে ডুবে দক্ষিণাঞ্চলের কত মানুষের সমাধি হয়েছে পদ্মা-মেঘনার গভীর জলে, তার হিসাব নেই। অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার জন্য আমরা অনেক দেশের চেয়েই এগিয়ে। উন্নয়ন যে ঠিক ইট-পাথরেই নয়, ব্যবস্থাপনায়ও দরকার তার প্রয়োজনীয়তা আমরা খুবই কম উপলব্ধি করি।

যে প্রশ্নটি আজ উঠেছে, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে, উন্নয়নের শেখরে পৌঁছার দৃপ্ত শপথে পথ চলতে গিয়ে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এগিয়ে যেতে গিয়ে আমরা আসলে ব্যবস্থাপনাগত বিষয়গুলোকে আর কত অবহেলা করব? আমাদের দেশের মানুষের আয়-উন্নতি অনেক বেড়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম বা ঢাকা-যশোর রুটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি যাত্রীও বেড়েছে। বোঝা যাচ্ছে উড়োজাহাজ খাতে ব্যবসা মোটামুটি বেশ সম্ভাবনাময়। কিন্তু এই আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনায় আমরা কতটুকু সক্ষমতা অর্জন করেছি?

ইউএস বাংলা এয়ারলায়েন্সের যে উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়েছে সেটি কার দোষে বা কার ভুলে তা জানতে কিছুদিন হয়তো সময় লাগবে। কথা উঠেছে দু’রকম। ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের সংকেত পাঠানোয় দুর্বলতা অথবা পাইলটের কোন না কোন ভুল। তদন্তে নিশ্চয়ই সঠিক কারণ বেরিয়ে আসবে। তবে বাংলাদেশী আকাশ পথের যাত্রীরা এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন এই উড়োজাহাজটির ফিটনেস নিয়ে। এক হলো, এটি ১৭ বছরের পুরনো। আবার এটি এমন এক আন্তর্জাতিক কোম্পানির বিমান যাদের পরিবহন বর্তমানে এড়িয়ে চলছে সবাই। যাদের কাছে এসব পরিবহন ছিল তারা ফেরত দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এই উড়োজাহাজগুলোই যাত্রী পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছে।

একটি দৈনিকের প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় অনলাইনে এক যাত্রী লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে নাকি তাদের সফরসঙ্গী হয়েছে কতিপয় তেলাপোকা!’ বোঝাই যাচ্ছে আকাশপথে যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থার হাল! আরো অনেক অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে। আকাশপথের মতো এমন গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ পথের ব্যবস্থাপনায় নজর দেয়ার জন্য বোধ হয় এরচেয়ে উপযুক্ত সময় আর হবে না। ইউএস বাংলার উড়োজাহাজটির দুর্ঘটনা আশাকরি আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। অবশ্য কাকে কী বলব, বাংলাদেশ বিমান তো আকণ্ঠ নিমজ্জিত দুর্নীতিতে। আগে এই সংস্থাটির যথার্থ সংস্কার জরুরি। সংস্কার দরকার আমাদের মন ও মননের। যারা নীতি নির্ধারক পর্যায়ে আছি তাদের মনের ভেতরে আগে কাজ করতে হবে যে- হ্যাঁ, এখানে আমাদের দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। একটা ভালো ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। মানের ক্ষেত্রে কোন স্বজনপ্রীতি সহ্য করা হবে না। তবেই হয়তো ভালো কিছু পাবে দেশবাসী। নিরাপদ হবে দেশের মানুষের আকাশ পথের যাত্রা। আর তাহলেই অন্তত অকালে ঝরে যাবে না পৃথুলা রশিদ, পিয়াস রায় কিংবা শাওনের মতো দেশের সম্ভাবনাময় তরুণেরা। ‘তৃতীয় হানিমুনে’র জন্য বেরিয়ে কেউ চলে যাবে না ওপারে, না ফেরার দেশে। হয়তো স্বর্গে ঈশ্বরের দেশেই তাদের হানিমুন হবে। তবু, পৃথিবীর জলে ও মাটিতে তো তারা আর ফিরতে পারবে না।

হানিমুন যাত্রার নর ও নারীরা, তোমরা যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।

লেখক : সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়