কুমিড়ার যুদ্ধ এবং ফেলে আসা ৪৭ বছর

মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূইয়া : আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য অধ্যায় ‘কুমিড়ার যুদ্ধ’। মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট খ্যাত এই যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায়।

বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের ২৭ মার্চের আলোচিত ঘোষণাটির একদিন আগে। ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী এই লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। একটি হেভি মেশিনগান ও কয়েকটি লাইটগান এবং বাকিগুলো রাইফেল নিয়ে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী ব্যাটেলিয়ানের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা মাত্র ১০২ জন যোদ্ধা। যাদের মধ্যে সিভিলিয়ানরা রয়েছেন। এই যুদ্ধে লে. কর্নেল শাহপুর খান বখতিয়ারসহ পাকবাহিনীর ১৫২ জন সৈন্য নিহত হয়। এতে তাদের ক্ষয়ক্ষতিও হয় ব্যাপক। কুমিড়ার এই যুদ্ধটি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শিক্ষা কোর্সে পড়ানো হয়। এমনকি ঢাকার সেনানিবাসস্থ সেনাকুঞ্জের বিজয় কেতনের ডিসপ্লে বোর্ডে এই যুদ্ধের নানা দিকের কথা উল্লেখ রয়েছে।

২৬ মার্চ ১৯৭১। ইচ্ছে ছিল সন্ধ্যার আগেই ক্যান্টনমেন্ট দখল করব। কিন্তু জানতে পারলাম শত্রুপক্ষের শক্তি বৃদ্ধির জন্য কুমিল্লা থেকে ২৪ নং এফ এফ রেজিমেন্ট এগিয়ে আসছে। এটা বাধা দেওয়াই তখন প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল।

বিকেল ৫টা। ২৪ নম্বর এফ এফকে প্রতিহত করার জন্য  কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হলাম। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআর-এর মাত্র ১০২ জন সৈন্য নিয়ে অভিযানে বের হলাম। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানিদের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সম্বল মাত্র একটা হেভি মেশিনগান, বাকি সব রাইফেল। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পুরো একটা সুসংগঠিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাওয়ার ঝুঁকি যে কী ভয়াবহ এবং তার পরিণাম যে কী মারাত্মক হতে পারে, সেদিন তা উপলব্ধি করতে পারিনি। কোনো প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের আগে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাইনি বলেই যে এত বড় একটা ঝুঁকির পরিণাম উপলদ্ধি করতে পারিনি তা নয়, আসলে মনটা ছিল প্রতিশোধের স্পৃহায় উন্মত্ত। ক্ষোভে, ক্রোধে ও আবেগে উত্তেজিত। তাই ঠান্ডা মাথায় আগ-পিছ বিবেচনা করে পরিকল্পনা করার সুযোগ ছিল না। অন্য কিছু না থাকলেও যুদ্ধের সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি প্রয়োজন, সেই সাহস, সেই উদ্দীপনা, সেই আকাঙ্ক্ষা আমাদের ছিল। আমাদের এই দৃঢ় মনোবল ও আত্মবিশ্বাস সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি যুগিয়েছিল।

আগেই খবর পেয়েছিলাম শত্রুবাহিনী ফেনীর কাছে শুভপুরের ব্রিজ পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। অতএব যত দ্রুত তাদের গতি প্রতিহত করা যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমার কথা মতো স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন কর্মী ৫টা ট্রাক এনে হাজির করল। তখন আমার সৈন্যদের ও জনসাধারণের মধ্যে প্রত্যেকেরই যেন একটা যুদ্ধংদেহী ভাব। তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত বেদনা, বঞ্চনা, ক্ষোভ, আক্রোশ বিদ্রোহের আগুনে ফুঁসে উঠেছে, যা এক দুর্জয় সংগ্রামের ভেতর দিয়েই যেন স্ফূরিত হতে চায়। ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণ ও অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে আজ সবাই যেন বদ্ধপরিকর।

আমি আমার দলের ১০২ জন যোদ্ধাকে ৪টি ট্রাকে উঠালাম আর বাকি ট্রাকটিতে গুলির বাক্স উঠিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মোটর সাইকেলে চড়ে সবার আগে চললাম। উদ্দেশ্য এগোনো সাথে সাথে পথের দু’পাশে এমন একটি উন্মুক্ত স্থান খুঁজে নেওয়া যেখান থেকে শত্রুর ওপর সাফল্যের সাথে আঘাত হানা যায়। শুভপুরের উদ্দেশে সেদিন আমাদের যাত্রাপথের দৃশ্য ভোলার নয়। রাস্তার দু’পাশে শত শত মানুষের ভিড়। তাদের মধ্যে কল-কারখানার শ্রমিকই বেশি। মুখে তাদের নানান শ্লোগান, সেই হাজারও কণ্ঠে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছিল। গত রাতে শহরের বিভিন্ন স্থানে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া বর্বরবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ, নির্মম হত্যা, বিশেষ করে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদেরকে পাশবিকভাবে হত্যা করার খবর এরই মধ্যে প্রতিটি মানুষের কানে পৌঁছে গেছে। যেকোনোভাবে এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য যেন তারা প্রস্তুত। সুতরাং যখনই তারা দেখতে পেল খাকি পোশাক পরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর জোয়ানরা অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মুহুর্মুহু তারা শ্লোগান দিতে লাগল, জয় বাংলা, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জিন্দাবাদ, ইপিআর জিন্দাবাদ এদিকে তাদের কেউ কেউ সৈন্যদেরকে কী দিয়ে কীভাবে সাহায্য করতে পারবে তাই নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আমাদের সৈন্য বোঝাই ট্রাকগুলো তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে। এমন সময় একজন বুড়ো তার পথের পাশে দোকান থেকে তিন কার্টুন সিগারেট নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিল।

বলল, স্যার, আমি গরীব মানুষ, কিছু দেওয়ার মতো আমার ক্ষমতা নেই, এই নিন আমার দোকানের সিগারেট, আপনার জোয়ানদের মধ্যে বিলিয়ে দিন। বৃদ্ধের এই সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় আমার মন ভড়ে ওঠল। আর একজন একটি ট্রাকে করে প্রায় এক ড্রাম কোকাকোলা নিয়ে এলো। কেউ কেউ খাদ্যসামগ্রীও নিয়ে এলো।

তাদের এই আন্তরিকতা ও ভালবাসা আমাদের আনন্দে উদ্বেল করে তুলল। কেমন করে কীভাবে তারা সেসব জিনিস সেই দিন সংগ্রহ করেছিল, তা ভাবলে আজও অবাক লাগে।

সন্ধ্যা ৬টা। আমরা কুমিড়ায় পৌঁছে গেলাম। শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য স্থানটি খুবই উপযুক্ত মনে হলো। পথের ডানে পাহাড় এবং বাম দিকে আধ মাইল দূরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধক, সেজন্য শত্রুকে এগুতে হলে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তাই সেখানেই পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেখানে পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই তার পিছনে একটি খাল। ঐ খাল থেকে ৫০০/৬০০ গজ সামনে অর্থাৎ উত্তর দিকের জায়গা বেছে নেই। খালটা কোনো পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন বাধা নয়। উদ্দেশ্য ছিল যদি শত্রু আমাদেরকে বর্তমান পজিশন ছাড়তে বাধ্য করে তখন খালের পিছনে গিয়ে পজিশন নিতে পারব। এটা ছিল আমার বিকল্প পরিকল্পনা। এলাকাটা দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রতিরোধের (অ্যামবুশ) পরিকল্পনা তৈরি করে নিলাম। স্থির করলাম ১ নং প্লাটুন ডানে, ২ নং প্লাটুন বামে এবং ৩ নং প্লাটুন আমার সঙ্গেই থাকবে। তিন জন প্লাটুন কমান্ডারকে ডেকে খুব সংক্ষেপে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নিতে নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী হেভী মেশিনগানটি পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হলো। ইপিআর সুবেদার নিজে ভারী মেশিনগানটির সঙ্গে রইল। কারণ এই ভারী মেশিনগানটি ছিল আমাদের প্রধান হাতিয়ার এবং সবচেয়ে বড় সম্পদ আমি বাম দিকের কয়েকটি এলএমজি পজিশন ঠিক করে দিলাম। আমার নির্দেশ মতো সবাই মাটিতে পজিশন নিয়ে নিল। পজিশনের অবস্থাটা হলো অনেকটা ইংরেজি (ইউ)-এর মতো। অর্থাৎ ডানে বাঁয়ে এবং পিছনে আমাদের সৈন্য। যেদিক থেকে শত্রু এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটাই খোলা।

কুমিড়া পৌঁছেই মোটরসাইকেল যোগে একটা লোককে আমরা পাঠিয়ে ছিলাম শত্রুর অগ্রগতি সম্পর্কে খবর নিতে। এরই মধ্যে সে খবর নিয়ে এসেছে যে শত্রু আমাদের অবস্থানের আর বেশি দূরে নেই। মাত্র চার পাঁচ মাইল দূরে। তবে তারা ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে আসছে। যে লোকটাকে পাঠিয়েছিলাম সে পাঞ্জাবীদের কাছে গিয়ে রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে সিগারেট কিনে ফিরে এসেছে। সে আমাকে জানালো, পাঞ্জাবীদের পরনে কালো বেল্ট, কাঁধে কালো ব্যাজ এবং কি যেন একটা কাঁধের ওপর তাও কালো। তখন আমি নিশ্চিত হলাম যে, ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সৈন্যরাই এগিয়ে আসছে, কারণ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সদস্যরাই কেবল কালো বেল্ট, কালো ব্যাজ ও কালো র‌্যাংক ইউনিফর্ম ব্যবহার করে থাকে। আমাদের অবস্থানের ৭০/৮০ গজ দূরে একটা বড় গাছ ছিল। স্থানীয় লোকদের সাহায্য নিয়ে গাছের মোটা ডালটা কেটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে ফেললাম। গাছের ডাল দিয়ে রাস্তার ওপর সুন্দর একটা ব্যারিকেড সৃষ্টি করলাম। রাস্তার আশপাশ থেকে কিছু ইট এনে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রাখলাম।

এত অল্প সময়ে জনসাধারণ কীভাবে গাছের ও মোটা ডালটা কেটে ইট সংগ্রহ করে ব্যারিকেড সৃষ্টি করলো আজ তা ভাবতে অবাক লাগে। সৈন্যদের জানিয়ে দেওয়া হলো, শত্রু সৈন্য যখন ব্যারিকেড সরানোর জন্য গাড়ি থেকে নামবে এবং একত্রিত হবে তখন আমার ফায়ার করার সাথে সাথে সবাই একযোগে শত্রুর ওপর গুলি ছোঁড়া শুরু করবে। বিশেষ করে ভারী মেশিনগানটা দিয়ে অবিরাম ফায়ার করবে।

প্রায় এক ঘণ্টা সময় শত্রুর প্রতীক্ষায় কেটে গেল। সন্ধ্যা তখন সাতটা। আমরা শত্রুর অপেক্ষায় ওঁৎপেতে আছি। আমাদের সামনে শত্রু বাহিনীর উপস্থিতি প্রায় আসন্ন বলে মনে হলো। দেখলাম তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ব্যারিকেড দেখে সামনের গাড়িগুলো থেমে গেল। কয়েকজন সিপাই গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেডের কাছে এলো। ওদের কেউ কেউ ইটগুলো তুলে দূরে ফেলে দিতে লাগল। পেছনের গাড়িগুলোর তখন সামনে এগিয়ে এসে জমা হতে লাগল।

সন্ধ্যা সোয়া ৭টা, শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত, তখনই আমি ফায়ার করলাম। সাথে সাথে আমাদের ডান দিকের ভারী মেশিনগানটি গর্জে উঠল। শুরু হলো শত্রু নিধন পালা। চারিদিক থেকে কেবল গুলি আর গুলি। ভারী মেশিনগান থেকে মাঝে মাঝে উজ্জ্বল ট্রেসার রাউ-বের হচ্ছে।

আমাদের আকস্মিক আক্রমণে শত্রুপক্ষ হতচকিত। ওদের সামনের কাতারের অনেকেই আমাদের গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ল। সে কি ভয়াবহ দৃশ্য। তাদের কাতর আর্তনাদ আমাদের কানে আসছিল। আর যারা দিশেহারা হয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছিল তারাও মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুদের পিছনের সৈন্যরা এ অবস্থা সামলে নিয়ে মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারি  থেকে অবিরাম গোলা বর্ষণ শুরু করল।

এভাবে কতক্ষণ চলল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও শত্রুরা আমাদের ব্যূহ বেধ করতে পারল না। তাদের সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাকে আগুন ধরে গেল। আমাদের মেশিন গানটা ‘নিউট্রালাইজ’ করার জন্য তারা প্রচুর পরিমাণ আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করতে লাগল। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবাণীতে শত্রুর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা প্রাণপণ লড়ে তারা শেষ পর্যন্ত দুই ট্রাক অস্ত্র ফেলে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পড়ে রইল তাদের নিথর অনেকগুলো দেহ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বয়স আজ ৪৭। জানিনা এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীর সেনারা আজ কে কোথায় আছে। ক’জনই বা বেঁচে আছেন। যারা বেঁচে আছেন কীভাবে বেঁচে আছেন! চাকরি জীবনে দু-একজনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হত। কাউকে কাউকে ব্যক্তিগত সহায়তার করার চেষ্টা করেছি। এখন আর কারও সাথে যোগাযোগ হয় না। তবে এখনও স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। এখনও এই স্মৃতি চোখে জ্বল জ্বল করে। গভীরভাবে ভাবলে শিহরিত হই। মনে হয় সেই ২৬ বছরের যুবক আমি। এখনও যেন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি।

লেখক : প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৮/সাইফ