ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সুখের সন্ধানে

মো. কামরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৯, ২৭ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুখের সন্ধানে

ছবি : ইন্টারনেট

মো. কামরুজ্জামান : কয়েকদিন আগের কথা, ক্যাম্পাস থেকে রিকশা নিয়ে ব্যাংকে যাচ্ছি। কর্মব্যস্ত দিনে যেখানে আমরা নিঃশ্বাসটুকু শান্তিতে ফেলতে পারি না, সেখানে হঠাৎ খেয়াল করলাম রিকশাওয়ালা আনমনেই গান গাচ্ছেন।

আমার মাথার ওপর রিকশার হুড, রোদে পুড়তে হচ্ছে না, কই আমার মনে তো সেই শান্তি নেই যে গান গাইবো। আমার হয়তো সেই রিকশাওয়ালার মতো অর্থ কষ্ট নেই। পরের বেলায় কী খাবো সেটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। কায়িক শ্রমও করছি না। আমার চিন্তার পাল্লা ভারী, রিকশাওয়ালার শ্রমের পাল্লা। এজন্যেই হয়তো আমরা সমপরিমাণে সুখী কিংবা সমপরিমাণে দুঃখী। যদিও আমাদের সুখ-দুঃখের মাপকাঠি অনেক ভিন্ন। সেদিন জানতে ইচ্ছা করেছিল কীভাবে সেই মেহনতি রিকশাওয়ালা শত কষ্টের মধ্যেও সুখ খুঁজে পায়, ঠিক যেমন সুখ আমিও কোনো এক সকালে সাইকেল চালাতে চালাতে পাই।

ইদানিং ফেসবুকে দেখি আমার অনেক ছাত্র-ছাত্রী ডিপ্রেশনে ভোগে। এমনটা কিন্তু আগে ছিল না। এমনকি নাম করা কিছু ফেসবুক পেজ থেকে ডিপ্রেশন কমানোর উপায় দেখিয়ে ভিডিও শেয়ার করে। এগুলো পূর্বাভাস যে, তরুণ সমাজ ছোট কোনো না-পাওয়াকেই ডিপ্রেশনের কারণ ভেবে নিচ্ছে। না-পাওয়াটা নিয়ে এত বেশি চর্চা করছে যে পাওয়াগুলো না-পাওয়ার মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছে।

এসব কারণের সমাধান কী হতে পারে তা জিজ্ঞেস করলাম গুগল সাহেবকে। একবার নয়, কয়েকদিন টানা জিজ্ঞেস করতেই থাকলাম। সে আমাকে ধরিয়ে দেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলসহ বিভিন্ন নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফাইন্ডিংস। ঐ সকল আর্টিক্যাল পড়ে আমি যা বুঝলাম তা সহজ কথায় আপনাদের সাথে শেয়ার করার প্রয়াস নিচে তুলে ধরলাম।

আসলে পৃথিবীতে মানুষ সমপরিমাণে সুখী ও দুঃখী। সুখকে মানুষ রিসার্চের মাধ্যমে স্কেলিং করতে চাইলেও বাস্তবে পুরোপুরি তা করা সম্ভব হয় না। আপাত: দৃষ্টিতে ধনী মানুষ সুখে আছে মনে করা হলেও ঘটনাটা ঠিক তেমনটি নয়। যাদের টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত কম আছে তাদেরও কিন্তু সুখ কম নয়।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের হরমোনের আবিষ্কার এ ব্যাপারটা আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছে। ডোপামিন, অক্সিটোসিন, সেরোটনিন, এন্ডোরফিন, ফেনাইলেথাইলামাইন এই পাঁচটিকে বলা হয় হ্যাপি কেমিক্যাল যেগুলো আমাদের মস্তিস্কে নির্গত হলে মুড ভালো হয়, সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে, মনে শান্তি অনুভব করে। ফলশ্রুতিতে মানুষ সাধারণত সুখের বহিঃপ্রকাশ করে গান গেয়ে, হেসে, উল্লাস করে।

আমিষ জাতীয় খাদ্য, যেমন-মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি আমরা সহজেই পেয়ে থাকি যেগুলো হ্যাপি হরমোন নিঃস্বরণ করতে সাহায্য করে। ধনী মানুষের খাদ্য তালিকায় আলমন্ড, পনির, ছানা, স্পিনাচ, লবস্টার, কলা, চকলেট ওটসসহ সব জাতীয় আমিষ খাদ্য ইত্যাদির প্রাচুর্য দিয়ে থাকে তাদের হ্যাপি হরমোনের যোগান দেয়।

কিন্তু অভাবী মানুষেরা সব সময় এ ধরনের খাবার খেতে পায় না। তাদের সুখও কিন্তু কম নয়, তবে সুখের কারণ ভিন্ন। গরীব মানুষেরা কঠোর পরিশ্রম করে যেমন রিকশা চালানো, মাঝির নৌকা বাওয়া, কৃষি কাজ, ঘরমোছাসহ গৃহকর্মীর কাজ, কুলির কাজ, দিনমজুরের কাজ। আমরা কী ভেবে দেখেছি যে এদের সুখের উৎস কী?

চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে ব্যায়ামসহ অন্য যেকোনো  শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষের মস্তিস্ক থেকে হ্যাপি হরমোন নির্গত হয়। যার কারণে মানুষ তার মনে সুখ অনুভব করে। তাইতো খেয়া ঘাটের মাঝি এতো রোদে পুড়েও সারা দিন বৈঠা চালিয়ে তার মুখে সুখের গান তোলে। এই কষ্টের কাজগুলি রোদের মধ্যে করেও সে তার অজান্তেই শরীরে ভিটামিন-ডি গ্রহণ করে। এই ভিটামিন হ্যাপি হরমোন নিঃস্বরণের পিছনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যেটা হয়ত বিত্তবানেরা এসি রুমের মধ্যে থেকে পায় না।

শহুরে বিত্তবানেরা বাসায় উষ্ণ পানির বাথটাবে গোসল করেও তাদের সেই সুখ বা শান্তি থাকে না, যা থাকে একজন পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল করা রাখালের মনে। সুর আসে কৃষকের বৃষ্টি ভেজায় কারণ আধুনিক বিজ্ঞান বলে ১৪° সেলসিয়াস তাপমাত্রার ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে ডোপামিনের নিঃস্বরণ সবচেয়ে বেশি হয়।

একদিন বৃষ্টিতে ভিজে দেখেননা, ছাদের ওপর অন্য এক অনুভূতি কাজ করবে, শান্তি দিবে মনে।

ক্যাফেইন, অ্যালকোহল, চিনি, ড্রাগস, পর্নোগ্রাফি, জুয়াখেলা, মাদকদ্রব্য হচ্ছে টেম্পোরারি ডোপামাইন বুস্টার। যেমন নিকোটিন বেজলাইন লেভেল থেকে ২০০%, কোকেইন ৪০০% এবং আলফেটামিনআজড্রপিং ১০০০% ডোপামাইন বাড়াতে পারে। কিন্তু এগুলো আপনাকে অ্যাডিক্টেড করবে এবং আপনার মূল অনুভবের লেভেল বাড়িয়ে দেবে, তখন এই টেম্পোরারি বুস্টার ছাড়া আপনি উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা, বিষণ্ণতায় ভুগবেন। আপনার স্বাভাবিক জীবনযাপন হুমকির সম্মুখীন হবে। এগুলো থেকে সাবধান হয়ে প্রকৃতি প্রদত্ত নিয়ামক উপভোগ করে হ্যাপি হরমোনের নিস্বরণ আপনাকে আনন্দময় ও সুখী জীবন উপহার দিতে পারে।

মানুষ সুখী কি-না এটি নির্ভর করে তার ব্যাক্তি জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব–নিকেশের মাধ্যমে।

প্রত্যেক ব্যাক্তির প্রত্যাশা ভিন্ন ধরনের। কোনো বিত্তবান বাবা মায়ের সন্তান যে খুব আরাম আয়েশের মাঝে বড় হয়েছে তার ক্ষুদ্র কোনো না পাওয়াও অনেক বড় দুঃখের কারণ হতে পারে। নন্দ দুলালকে নেশা করতে দেখা যায়, এমনকি সে আত্মহত্যাও করে বসে। আবার কোনো কৃষকের ছেলের জন্য একটি ঈদের পোশাকও অনেক বড় সন্তুষ্টির বিষয় হতে পারে।

এটিকে একটা ব্যবসায়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। একজন পান দোকানদার যার মূলধন ১০ হাজার টাকা। তার দোকানটি যদি পুড়ে যায় তাহলে তার ১০০% মূলধনই নষ্ট হল। আবার একজন শিল্পপতির শত কোটি টাকার কারখানা পুড়ে গেলে তারও ১০০% মূলধনই নষ্ট হল। দুইজনের টাকার পরিমাণ ভিন্ন হলেও তাদের দুঃখের পরিমাণ সমান, কারণ দুজনই তাদের সর্বস্ব হারাল। দুইজনের দুঃখের প্যারামিটার ভিন্ন হলেও অনুভূতি একই রকম।

সৃষ্টিকর্তা মনে হয় সুবিচারই করেছেন। সুখী অনুভব করার অনুসঙ্গ কেবল নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণিপেশার জন্য না রেখে, সমভাবে বন্টন করেছেন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ মার্চ ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়