ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

রাজীবের মৃত্যু কী বলে গেল?

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩১, ১৮ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজীবের মৃত্যু কী বলে গেল?

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সময়ে রাজীব (ফাইল ফটো)

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার থেকে ১২শ’ মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিনের তথ্য মতে, প্রতিদিন আগত মানুষের ১০ ভাগই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসেন। অর্থাৎ কেবলমাত্র ঢাকা মেডিকেলে প্রতি বছর গড়ে ৩৬ হাজারেরও বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে চিকিৎসা নেন।

এবার সারাদেশের একটি পরিসংখ্যানে চোখ রাখা যাক। বেসরকারি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ৯ হাজার থেকে ২১ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, প্রতি বছর যা দুর্ঘটনা হয়, তার ৯০ ভাগ দুর্ঘটনার জন্যে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাবই দায়ী। এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক বলেছেন, পরিবহন খাতের অসুস্থ প্রতিযোগিতাই সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। এই প্রতিযোগিতা চালককে বেপরোয়া করছে। এটা এখনই বন্ধ করতে হবে।

রাজীব হোসেন। তিনি তিতুমীর কলেজের বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর হাত হারানো থেকে চলে যাওয়া পর্যন্ত ঘটনাবলি আমরা জানি। এটাও জানি, বাসের বেপরোয়া চালকের জন্যে রাজীব প্রথমে হাত হারালেন, পরে জীবন। চালকদের দৌরাত্ম্যের কথা এবং এর পরিসংখ্যান পূর্বেই তুলে ধরা হয়েছে। রাজীবের মৃত্যু বারবার প্রশ্ন করছে- বেপরোয়া চালকদের রাশ টানার দায়িত্ব কার? সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করার দায়িত্ব কার? তার কি প্রশ্ন ছিলো না, সে কেন স্বাভাবিক জীবন-যাপনের অধিকার পেলো না?

সড়ক দুর্ঘটনার কারণে প্রতিনিয়ত কত পরিবার যে নিঃস্ব হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্ঘটনায় কারো জীবন যাচ্ছে, কারো কপালে জুটেছে পঙ্গুত্ব। শিশু, স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, পুলিশ, ডাক্তার কেউ-ই দুর্ঘটনা থেকে বাদ যাচ্ছেন না। প্রতিদিন লাশের সারি দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। সেজন্যে বাংলাদেশের সড়ককে বলা হয় ‘মৃত্যুফাঁদ’। আর কোথাও কোনো দেশের সড়ককে এমন বলা হয় কি? আমরা রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক জীবন-যাপনের দাবি জানিয়েছি বহুবার। অনেক মানববন্ধন, অনেক বক্তব্য, অনেক আশ্বাস  দেয়া হয়েছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কি কমেছে? রাষ্ট্র কি আমাদের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে পেরেছে? মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া, হাত হারানো রাজীব কি অসংখ্য প্রশ্ন আমাদের সামনে রেখে যায়নি?  তাঁর হাত হারানো, মৃত্যু চলমান ব্যবস্থা নিয়ে এমন অসংখ্য প্রশ্ন রেখে গেছে আমাদের সামনে। আর আমরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।

রাজীব চলে গেছেন। কাল আরও অনেকে যাবেন। সার বেঁধে, দল বেঁধে আমরা এমন মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চলছি। আমরা জেনে গেছি, প্রতিদিনই কারো না কারো ভাই, স্ত্রী, বাবা এ সড়কে প্রাণ দেবেন। আমরা জেনে গেছে, প্রতিদিন আট-দশ-পনেরজনকে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হবে। আর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা ঘুরেফিরে একই কথা বলে চলবেন, আমরা চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি। এক কথা সাধারণ মানুষকে কতবার বলা হবে? আমরা আর কথা শুনতে চাই না। আমরা কেবল কাজ দেখতে চাই। আমরা স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই। নিরাপদ সড়ক চাই। যাতে আর কোনো রাজীবের করুণ পরিণতি দেখতে না হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, তার দপ্তর, সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন কি এত মৃত্যু দেখেও চমকে ওঠে না? রাজীব কি চলে গিয়ে বারবার বলে যাননি- ওঠো, ঘুমিয়ে পড়ো না। আর কারো সাথে যেন এমন না হয়। এ নির্মম মৃত্যুর মহড়া বন্ধ যেন হয় চিরতরে।

সড়কের বেহাল অবস্থা কাটেনি। ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে। অদক্ষ চালকরা সদম্ভে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন। ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতায় নামছেন। কোনো মৃত্যুই তাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে না। ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হয়নি। অনেক জেলা শহরে অটো, সিএনজি, অটোরিকশার দৌরাত্ম্যে মানুষ নাজেহাল। গাড়ির লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে, অথচ যে চালক গাড়িটি চালাবে, তার লাইসেন্স নেই! বিআরটিএর হিসেব মতে, সারাদেশে ৩৩ লাখ যানবাহন রয়েছে। লাইসেন্সধারী চালক আছে ২১ লাখ।  অর্থাৎ লাইলেন্স নেই এমন ১২ লাখ চালকরা সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দুর্ঘটনা কি ঘটবে না? বিআরটিএ যদি জানে, দেশে ১২ লাখ চালক লাইসেন্সবিহীন, তারা ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে-তাহলে তাদেরকে আইনের আওতায় কেন আনা হচ্ছে না?

অনেক যাত্রীই চরম অসচেতনতার পরিচয় দিচ্ছেন। ফ্লাইওভার থাকতেও ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন তারা। অনেকে মোবাইল কানে নিয়ে, হেডফোন কানে দিয়েও হাঁটছেন। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটছে। যাত্রীদেরকেও দায় থেকে দূরে রাখা যায় না। রাজীবের মৃত্যু বারবার দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। সরকারকেই আগে দায়িত্বশীল হতে হবে। বেপরোয়া ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালনাসহ যেসব বিষয়ের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে তা বন্ধ করতে কার্যকর ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে। সাধারণ মানুষকেও দায়িত্বহীন হলে চলবে না। নতুবা, আরো অনেক রাজীবের অসহায় মুহূর্ত আমাদের বিদীর্ণ করবে। বারবার বলতে হবে, আমরা আমাদের সড়ককে নিরাপদ করতে পারিনি। আমাদের ক্ষমা করো রাজীব, ক্ষমা করো।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়