ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পরিবহনে নতুন নৈরাজ্য, শৃঙ্খলা আনবে কে?

জাফর সোহেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ২৫ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরিবহনে নতুন নৈরাজ্য, শৃঙ্খলা আনবে কে?

জাফর সোহেল : পরিবহন চালক আর সহকারীরা আর কিছু পারুক বা না-পারুক পাশের দেশ থেকে খুব দ্রুত একটা জ্ঞান আমদানি করেছে এবং সেটা নিজেদের প্রয়োজনে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহারও শুরু করেছে। বাংলাদেশের কিছু বুদ্ধিজীবী বেহুদাই বলে থাকেন, এদেশের চালকেরা অশিক্ষিত! আমি তো দেখি, এরা অনেকের চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত। যেমন গৃহিণীগণ হিন্দি সিরিয়াল দেখে তা নিজের পরিবারে খাটাতে কিছু সময় নেন, কিন্তু আমাদের একজন বিশিষ্ট নেতার ছায়ায় লালিত বিশেষ মেধাবী এই চালকেরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ‘বৈদেশ হইতে বিদ্যা অর্জন’ এবং তা জাহির করা শুরু করেছে! সড়কে নয়, চলন্ত বাসে মানুষ হিসেবে তারা নারীকে চিনতে পারছে। এরপর ধর্ষণ অথবা লাঞ্ছনার অসীম সাহসী বিদ্যা ফলানো শুরু করেছে। এবং তা বেশ দাপটের সঙ্গেই।

কিছুদিন আগে চলন্ত বাসে ধর্ষণ শেষে তারা রূপাকে হত্যা করে ফেলে দেয় মধুপুর বনে। আমরা অনেকে  ভেবেছিলাম, এটা ব্যতিক্রম ঘটনা। এমনটা আর হবে না। কিন্তু না, বাংলাদেশের পরিবহন শ্রমিকেরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তারা এত অল্পতে ক্ষ্যান্ত দিতে রাজী নন! তাই খোদ ঢাকার রাজপথেও বিশ্ববিদ্যালয় তরুণীদের বাসে আটকে রেখে যৌন নিপীড়নের চেষ্টা তারা করেছে। সংসদ ভবনের সামনে ইডেনছাত্রীর নিপীড়ণের ঘটনার পর দুদিন আগে শুনলাম, তুরাগ পরিবহনে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর হয়রানির খবর। অর্থাৎ মনে হচ্ছে এই প্রবণতা বাসের চালক-সহকারীদের মধ্যে দিনে দিনে বাড়ছে।  

তুরাগ পরিবহনের বিষয়ে জানা যায়, গাড়িতে যাত্রী না থাকায় চালক ও সহকারীকে বারবার বলেও বাস থেকে নামতে পারেননি সেই শিক্ষার্থীনি। বাসের চালক-সহকারীরা তাকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে তুরাগ পরিবহনের ৩০টিরও বশি বাস আটক করে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। তারা এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং সারাদেশের শিক্ষার্থীদের এই প্রতিবাদে শরিক হওয়ার আহ্বান জানায়। এ ঘটনায় পুলিশ ৩ জনকে আটক করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন ঘটনা কেন বাড়ছে? পরিবহন খাতে নৈরাজ্য এমনিতেই চরম আকার নিয়েছে। গতির প্রতিযোগিতায় তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছে যে, শেষ পর্যন্ত নিজেরা নিজেদের প্রাণও কেড়ে নিচ্ছে। এই সপ্তাহের সোমবার ভোরে পল্টনের ফাঁকা রাস্তায় ঘটেছে এমনই একটি ঘটনা। দুই বাসের রেষারেষিতে একে অপরকে ধাক্কা দেয় চালকেরা। এতে এক চালক মারা যান। এর আগে কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ে দুই বাসের একটি অপরটিকে পার হয়ে যাওয়ার সময় চাপা দেয়। এতে প্রথমে হাত পরে প্রাণ হারান তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে গোপালগঞ্জে এক বাসের সহকারীর হাত বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং রাজধানীর বনানীতে বিআরটিসির বাসচাপায় এক তরুণী গৃহকর্মীর পা বিচ্ছিন্ন হওয়ার খবরও আমরা পাই। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই চালকের দোষ খুঁজে পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা অন্তত তাই বলছেন। সুতরাং চালক সমাজের মধ্যে দক্ষতা ও যোগ্যতার যে ঘাটতি আছে এই সত্য অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

এই সত্য তো একদিনের নয়। চালকেরা বহুদিন যাবতই এই দেশে অদক্ষতা এবং অসচেতনতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। এমনকি আগামীর যারা চালক, এখনকার সহকারী, তারাও যে খুব দক্ষ, প্রশিক্ষিত এবং সচেতন হবেন তারও গ্যারান্টি নেই। কারণ, আমরা জানি এখনকার যে সহকারী, আগামীতে তিনিই চালক হবেন এবং যেই চালকের সহকারী হিসেবে তিনি এখন কাজ করছেন তার থেকেই তিনি শিখছেন। এই শিক্ষাটাই পরিবহন মালিক ও কর্তৃপক্ষের কাছে যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। চালক হতে হলে আর কোন শিক্ষা-দীক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণের দরকার নেই বলে মনে করেন তারা। তাহলে পরিবহন খাতে ‘নৈরাজ্য’ বলে একটা শব্দ যে পরিচিতি পেয়েছে তার আয়ুও বোধকরি অনেকদিনের হবে!

বিষয়টি খেদোক্তির মতো শোনালেও বাস্তবতার নিরীখে এই অনুভূতির বাইরে অন্যকিছু মনে করার কিংবা করানোর কোন আশা তো দেখি না। অন্তত আমাদের পরিবহন মালিক এবং এই খাতের নেতা ও মন্ত্রীরা সে ধরনের কোন আশা আমাদের দেখাতে পারছেন না। পারতপক্ষে তারা বিষয়গুলোকে কতটা আমলে নিচ্ছেন, সে ব্যাপারেও সন্দিহান হবার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে কোন মানুষের প্রাণহানি হলে তাকে হত্যাকাণ্ড ধরে দুএকটি ঘটনায় বাংলাদেশের আদালত সংশ্লিষ্ট চালককে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু সারাবাংলার চালক সমাজ এতে রাগান্বিত হন। তারা বাস চলাচল বন্ধ করে দেন। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকারও নতজানু হয় তাদের কাছে। অর্থাৎ মালিক-শ্রমিক-পরিবহন নেতাদের কথা হলো, এইদেশে কোন চালকের শাস্তি হতে পারবে না! তাহলে চালকেরা কীভাবে সংযমী হবেন? কীভাবে বেপরোয়া মনোভাব থেকে বের হয়ে পরোয়া করা শিখবেন?

সড়কে নিরাপদ চলাচলের জন্য চালকের ট্রাফিক আইন জানা এবং মানা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। এখন বাংলাদেশের তাবৎ চালকগণকে যদি এই আইন-কানুন জানা সংক্রান্ত পরীক্ষার টেবিলে বসানো হয়, ক’জন পাশ করবেন? আমার ধারণা, ৫ শতাংশ চালকও পাশ করবেন না। বিশেষ করে গণপরিবহন এবং ট্রাক চালক। ব্যক্তিগত গাড়ির কিছু চালক হয়ত পরীক্ষায় পাশ করতে পারেন। এখন বিষয় হলো, বাংলাদেশের সরকার চালকদের এই পরীক্ষায় বসাবে কি না? তার আগে প্রশ্ন হলো, সরকার পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে চায় কি না? কিংবা এই চাওয়াটা কতটা প্রাধান্য পায় সরকারের কাছে?

যথাযথ প্রশিক্ষণহীন, ট্রাফিক আইন না জানা চালকের গাড়িতে ওঠা মানে জীবন হাতে নিয়েই ওঠা। এখন আমরা যারা প্রতিদিন রাস্তায় নামি, বাসে উঠি- তারাই বা এ ব্যাপারে কতটা সচেতন থাকি? আমরা তো উচ্চমানের জ্ঞান-গরিমা নিয়েও মতিঝিল থেকে বাসাবো যাওয়ার জন্য লেগুনা নামের একটি গাড়িতে উঠে বসি; গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে কার হাত সেদিকে তাকানোর সময় নেই। ১২/১৩ বছরের কিশোর যে স্টিয়ারিং ধরে আছে এবং যে গাড়ির পেছনে পাদানিতে দাঁড়িয়ে আছে আরও কম বয়সী কোন শিশু, সেই গাড়িতে আমরা প্রতিদিন যাতায়াত করছি। আমাদের কারও কোন গা নেই। তাহলে পরিবহন খাতের মালিকেরা গা করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা বোধ করারই বা বাধ্যবাধকতা কীভাবে তৈরি হয়! সুতরাং শৃঙ্খলা আনার জন্য অনেক কিছু দরকার। বেশি দরকার সরকার আর জনগণের মিলিত সচেতনতা এবং দায়িত্ববোধ। তারপরে আসে পরিবহন মালিকদের বিচার বিবেচনা বোধের বিষয়। যেহেতু পরিবহন মালিকেরা, এমনকি চালকেরা নিজেরাও, বৃহত্তর জনগণেরই অংশ, সেহেতু বৃহত্তর স্বার্থে তারা নিজেদের শৃঙ্খলিত করতে এগিয়ে আসতেও পারে; সেজন্য দরকার তাদের বিষয়টার গুরুত্ব ও তাৎপর্য, লাভ-ক্ষতি ভালভাবে বুঝিয়ে বলা। এরপরও কাজ না হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দড়ি একটু টাইট দেয়া। তাতে পরিবহন নেতারা একটু বিরাগভাজন হলেও আপাতত এই ফর্মূলার বাইরে কার্যকর কিছু দেখি না।

লেখক: সাংবাদিক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ এপ্রিল ২০১৮/তারা         

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়