ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের প্রতি

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ৭ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের প্রতি

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : সদ্যপ্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফল দেয়ার পর ভালো ফলধারী অনেকে আনন্দিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর বিপরীতে ব্যথিত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কম নয়। এই বেদনার কারণ তারা অনেকেই উত্তীর্ণ হতে পারেনি অথবা ফল তাদের মনঃপুত হয়নি। এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক হাজার নয়, কয়েক লাখ। এবার সারাদেশে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ নিয়েছিলো ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে পাস করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। গড় পাসের হার ৭৭.৭৭ ভাগ। পরিসংখ্যানটি যোগ-বিয়োগ করলে দেয়া যায় এ বছর ৪ লাখ ৫০ হাজার ৪৭০ জন শিক্ষার্থী এসএসসিতে পাস করতে পারেনি। গড় অকৃতকার্যের হার ৩২.৩৩ ভাগ।

নিঃসন্দেহে ফল প্রকাশের দিনটি ছিলো অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের জন্যে ভীষণরকম দুঃসহের। এদিন অসংখ্য শিক্ষার্থীর যেমন স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, তেমনি স্বপ্নভঙ্গও হয়েছে অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর। পাস-ফেলের গল্পগুলো সংখ্যার হের-ফের ছাড়া প্রতিবছরই প্রায় একই থাকে। অনেক অভিভাবক আছেন যারা ফেল করা আর জীবনকে বরবাদ করে দেয়ার মধ্যে কোনো প্রকার তফাৎ দেখেন না। যে শিক্ষার্থীটি ফেল করেছে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ অনেক অভিভাবক ফেল করার দায়ে সেই বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীকে বকাঝকা করতে দ্বিধা করেন না। ফলে স্বপ্নভঙ্গ, অভিভাবক ও স্বজনদের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় তাকে দীর্ঘ বিমর্ষতায় পেয়ে বসে। ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা করার পরিবর্তে সে আরো ভেঙে পড়ে। কিন্তু যারা ফেল করেছে তারা কি কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারে না?

এই প্রশ্নের বিপরীতে বিশ্ববিখ্যাত কিছু ছাত্রের উদাহরণ দিতে চাই। তারা অনেকেই স্কুল পালিয়েছেন, স্কুল কলেজ থেকে ঝরে পড়েছেন। শৈশব ও কৈশোরে টমাস আলভা এডিসন পড়াশোনায় ভালো ছিলেন না। তার স্বজনরা বলতেন এডিসনকে দিয়ে পড়াশোনা হবে না। কিন্তু তারপর? এডিসনকে দিয়ে কিছু হয়নি? তাঁকে দিয়ে কী হয়েছে তা পৃথিবীবাসী জানে।  বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস্ও ছিলেন একজন ড্রপার। তিনি ১৯৭৩ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েন। তাকে দিয়ে হার্ভার্ডে পড়াশোনা হয়নি বলে কি তিনি থেমে গিয়েছিলেন? বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রযুক্তিবিদ স্টিভ জবসও কলেজ ডিঙাতে পারেননি। ‘টাইটানিক’ ছবির পরিচালক জেমস ক্যামেরনেরও অবস্থা একই। দুনিয়া কাঁপানো পপশিল্পী লেডি গাগা ভর্তি হয়েছিলেন নিউইয়র্ক আর্ট ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু একবছরও পড়াশোনা করতে পারলেন না। তাই বলে থেমে গেছেন? তাহলে আমরা থেমে যাবো কেন?

মাশরাফি বিন মুর্তজার কথা বললে তাঁকে কে না চিনবেন। কখনো কি কেউ জানতে চেয়েছে তিনি এসএসসিতে কি পেয়েছেন? সাবিনা ইয়াসমিন কিংবা মান্না দের ফলাফল ভালো ছিলো কি? টেন্ডুলকার? মেসি? টম ক্রুজ? এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটিই- আমরা বলতে চাই ফেল করা মানে থেমে থাকা নয়। ফেল করা মানে আর ভালো কিছু করা যাবে না এমন নয়। সম্প্রতি মাশরাফি বিন মুর্তজার একটি লেখা পড়ে ভালো লাগলো। জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত ‘জীবন এখানেই শেষ নয়’ গদ্যে তিনি লিখেছেন : ‘আমার কাছে জীবনটা শুধু জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন ‘এ’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমার কাছে জীবনের মানে অনেক বড়। পরীক্ষায় সবাই ভালো করবে না, সবাই জিপিএ-৫ পাবে না, কেউবা উত্তীর্ণই হবে না- এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কারও মধ্যে মেধা বা সামর্থের কমতি আছে, তা তো নয়।’

মাশরাফি যথার্থই বলেছেন। অথচ তারপরেও আমরা অনেকেই জীবনকে কেবলমাত্র পাস ও ফেলের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি। এমন ভাবনা যে কোনো জাতির জন্যেই আত্মঘাতি। যে তরুণরা দেশের জন্যে কাজ করবে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তারা কেবলমাত্র ফেল করাকে যদি জীবনের চূড়ান্ত অধঃপতন ভাবে তাহলে সেটি যে ভয়াবহ ভাবনা হবে- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

আজকে যারা ফেল করেছে তাদের জন্যে আগামীর দরজা বন্ধ হয়ে যায়নি। আগামীবার তারা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফল অর্জন করতেই পারে। অবশ্যই অনুত্তীর্ণ হওয়া সাড়ে চার লাখ পরীক্ষার্থী ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তারা যদি ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়, নতুন উদ্যমে পথচলা শুরু করে তাহলেই শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে। অভিভাবকদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, কোনো শিক্ষার্থীই ইচ্ছে করে অনুত্তীর্ণ হতে চায় না। অন্যদিকে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও পড়ার অনেক বিষয় আছে। পড়াশোনা, ভালো ফলাফলের মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র জীবনে সফল হওয়া যায় না। গবেষণা, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়েও জীবনকে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে সৃজনশীলতার চর্চা ব্যক্তির উন্নয়ন ও সাফল্যের জন্যে অতিজরুরি। পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সবাই একদিক দিয়ে ভালো করবে না- এটাই চূড়ান্ত সত্য। কিন্তু এটাও সত্য সবার কোনো না কোনো প্রতিভা রয়েছে। আমাদেরকে সে প্রতিভা কাজে লাগাতে হবে। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্যে পরিকল্পনা করতে হবে। অনেকে মনে করেন, ব্যর্থতাই হলো সফলতার প্রথম ধাপ।

যারা ভালো ফলাফল অর্জন করেছে তাদের দায়িত্বও কম নয়। তারাও অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করতে পারে। তারা কীভাবে পড়াশোনা করেছে, পাঠদানকে আনন্দময় ও উপভোগ্য করে তুলেছে- সে বিষয়ে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিতে পারে। তাহলে অনুত্তীর্ণরা তাদের ত্রুটিগুলো সহজেই অনুধাবন ও সংশোধন করে নতুনভাবে পড়াশোনা শুরু করতে পারবে। আমরা চাই, শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত শক্তি, প্রতিভা, সাধনা বাংলাদেশকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে দিয়ে নিয়ে যাক।

লেখক : গল্পকার ও সম্পাদক, বাঁক

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়