ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম : সমুখে শান্তি পারাবার

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১১ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম : সমুখে শান্তি পারাবার

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (ফাইল ফটো)

|| অজয় দাশগুপ্ত ||

মন খারাপ করা বিষণ্ণ বিকেল সিডনিতে। শীতকাল এসেছে মন উদাস করা বিকেল নিয়ে। আমি একা বসে ছাব্বিশ বছর আগের দুটো ত্রৈমাসিক পত্রিকা দেখছিলাম।

দেশ থেকে আসার সময় কত কিছু ফেলে এসেছি। আসার পর ও কতকিছু এখনো ফেলে দেই ফেলে দিতে হয়। অথচ গুপ্তধনের মত আগলে রাখা আরো কিছু বইপত্রের ভেতর রেখে দিয়েছি এ দুটো। কত এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। কত কত এগিয়েছে আমাদের প্রকাশনা। এখন প্রায় সকালে উঠে দেখি রঙিন ছবিতে ঝলমলে লেখকদের মুখ। সাথে তাদের লেখা। আমি ও বাদ পড়িনা। তবু এই রং আর জৌলুসকে ম্লান করে দেয়া এই দুই আটপৌরে ম্যাগাজিন আমাকে ঋনে আবদ্ধ করে রেখেছে। করে রেখেছে শিল্পমুগ্ধ। ছাব্বিশ বছর আগে তখনকার এক ত্রিশ পেরুনো লেখকের দূর্বিনীত স্পর্ধাকে সম্মান করা সম্পাদককে কি আমি ভুলতে পারি? ত্রৈমাসিক দুটো খুলে দেখলাম এমন কি সম্পাদকীয় ও লিখেননি তিনি। মানে এক চিলতে জায়গাও নিজের জন্য রাখেননি। দরকার পড়েনি তাঁর। পুরো পত্রিকায় যে শিল্পবোধ যে রুচি আর মনন সেটাই তিনি। আর তা তিনি জানতেন বলে সম্পাদকীয়র নামে একফোঁটা জায়গা নিতে চাননি।

অথচ এ দুটোর অঙ্গসজ্জা কিছুই না। ছাপা ও ভালো না। সম্ভবত লিথো প্রেসে ছাপা। তারপর ও আপনি পাবেন নতুন কিছু। পড়তে পড়তে মনে হবে আলোময় হয়ে ওঠেছে অন্তর। এই যে আলো দেয়া সে কাজটাই করে গেছেন সারা জীবন। প্রথম আলাপ খামের চিঠিতে। কি সৌভাগ্য তখন কোন ইলেকট্রনিক যাদু বাক্স ছিল না। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ হতো হয় লেখা চিঠিতে নয় ফোনে নয়তো বা দেখা করে। আমার মত তরুণ লেখককে অবজ্ঞা বা পাত্তা না দেয়ার একশ একটা কারণ থাকার পরও তিনি সে লেখা প্রাপ্তির উত্তর দিয়েছিলেন দেরিতে লিখতে হয়েছে বলে দুঃখ  প্রকাশ করে। এই সৌজন্য বা বিনয় এখন আছে? না আমরা তার ধার ধারি? এখন আমরা মুখের ওপর বড় কথা আর কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলাকেই আধুনিকতা মনে করি। বলছিলাম তাঁর বিনয়ের কথা। সে বিনয় আর ঔদার্য মানুষটিকে কখনো ছোট হতে দেয়নি।

অথচ তাঁর তেজ ও দেখেছি আমি। ১৯৯৫ সালে আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ করতেন যারা দল ও বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতেন কেবল তারা। তাদের কপালে তখন দুর্ভোগ। রাজপথে নেমে আসা সত্যিকার মানুষ ও সত্যিকার ভক্তদের মিছিলে জাতীয় শোকদিবস ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এখনকার মত কাঙালি ভোজের নামে চাঁদাবাজি বা পাড়ায় মহল্লায় হৈ হৈ করা কোনো শোক ছিল না সেদিন। তখন যারা বুদ্ধিজীবী বা সুশীল তাদের অনেকেই গা ঢাকা দিয়ে সবুর করছিলেন কখনো যদি আওয়ামী লীগের সুদিন আসেতো তারা বেরিয়ে আসবেন আর না হলে নাই। এই দ্বিচারিতার আমলে তিনি তাঁর ভূমিকা রেখেছিলেন দৃঢ়। সেই দৃঢ়তায় আলোয় উদ্ভাসিত আমি কাছ থেকে পাশে বসে দেখেছি কী অনুপম ললিত বাণী।

সে শোকসভায় গিজগিজ করা মানুষের সাথে পাল্লা দেয়া সরকারি টিকটিকির দল। ভয়হীন আমার হারানোর মত কোনো পুঁজি ছিল না তখন। তার ওপর দেশজুড়ে বিএনপি জামায়াতের কঠিন স্বাধীনতাবিরোধী আচরণ। ইতিহাস বিকৃতি। তাই মূল প্রবন্ধ পাঠ আমার জন্য বিষয় ছিল না। বরং ছিল সম্মানের। কিন্তু তাঁর অবস্হান ছিল ভিন্ন। তিনি বিটিভিতে মুক্তধারা নামে একটি অনুপম অনুষ্ঠান করতেন। আরো কত কি। তারপর ও তিনি সাহস করে বলেছিলেন। শেখ মুজিব, তাঁর দেখা মুজিব ভাইয়ের বঙ্গবন্ধু হবার অনন্য অসাধারণ গল্প। আমরা সবাই জানি এদেশের এক ধরনের অভিজাত বা এলিট শ্রেণি তাদের ইগোর জন্য কখনো বঙ্গবন্ধুকে আপন করতে পারেনি। একটি নামকরা পত্রিকার সাবেক সম্পাদক ব্যরিস্টার আজীবন বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে আপন পিতার রক্তের সাথে বেঈমানি করে গেলেন এই কারণ। তারা যদি স্যারের এই ভাষণটি শুনতেন আমার ধারণা লজ্জায় মারা যেতেন।

সে বচনামৃত এখনো কানে লেগে আছে। আজ আমাদের সমাজে সত্য বলার মানুষ বড় কম। দেশে গিয়ে দেখেছি চটজলদি পাবার লোভে উন্মাদ হয়ে যাওয়া লেখক শিল্পী বা সুধী সমাজ হয় তোষণে নয়তো স্তাবকতায় ব্যস্ত। কারো সময় নাই জাতি বা সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার। এই কঠিন সময় এসেছে অন্ধ বিবেকের হাত ধরে। সেই বিবেক জাগিয়ে তোলার মানুষ ছিলেন তিনি। একজন মানুষের বাচন আর কথা বলা কত সুন্দর হতে পারে তাঁকে না দেখলে বা না শুনলে বোঝা কঠিন। অধ্যাপক অনেকেই বটে কিন্তু স্যার বা প্রিয় মানুষ হয়ে ওঠা সবাই পারেন না। এজন্য যে ভালোবাসা আর দরদ থাকতে হয় সেটা ছিল তাঁর মননে চরিত্রে। সাধারণ মানুষ অথচ কাজ ছিল অসাধারণ।

সে অসাধারণত্ব ছিল তাঁর পুঁজি। সে কারণে অবসরে যাবার পর প্রাপ্য টাকায় ত্রৈমাসিক পত্রিকা বের করার ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন। আজকাল তেম কোনো পত্রিকাও বের হয় না। যাতে মনের আনন্দে ডানা মেলতে পারে নবীন লেখক, যেখানে লিখে নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজতে পারেন নামী লেখক। তিনি যদি সম্পাদক না হনতো দেশে আর কে বা কারা সম্পাদক? সমাজ ও সংস্কৃতিতে এমন কিছু মানুষ আসেন জায়গা করে নেন যাঁরা চলে গেলে এক বিপুল শূন্যতা তৈরি হয়। এঁরা যদি নিস্ক্রিয়ও থাকেন সমাজ শক্তি পায়। জাতি জানে কোথাও তাদের একজন অভিভাবক আছেন যিনি দেখছেন। সে ধরনের মানুষ ছিলেন স্যার। জীবনে ধান্দাবাজি বা চতুরতার মত বাজে বিষয়গুলোকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর সম্পর্কে বলতে বা লিখতে গিয়ে এমন শব্দগুলো ব্যবহার করতেও গা ঘিন ঘিন করে ওঠে।

ঐ যে বলছিলাম যতদিন দেশকে ভালোবাসবো যতদিন প্রাণ আছে ততদিন ইনি বেঁচে থাকবেন অন্তরে। সব মানুষ অন্তরে জায়গা করে নিতে পারে না। এর জন্যে চাই ভালোবাসা। সে ভালোবাসা ছিল বলেই তাঁর প্রয়াণে মন খারাপ হয়ে আছে। স্যার যখন রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বলতেন সব সময় তাতে নতুন কিছু থাকতো। আরো দশজন বা কথিত আলোকিতদের মত তারুণ্য নিয়ে ছেলে খেলা করেননি। কারণ তাঁর রুচি তাঁর মননই ছিল অগ্রগামী। রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রায় যে গানটির ব্যবহার হয়েছিল সে গানটির কথা মনে পড়ছে-

সমুখে শান্তি পারাবার/ভাসাও তরণী হে কর্ণধার.... সে বিশ্বপিতা সে অমোঘ নিয়তি ক্রোড়পেতে নিয়ে গেছে তাঁকে। এমন মেধাবী মানুষকে আত্মা শান্তি দেবেই। বিদেশে মন খারাপ করা বিকেলের পড়ন্ত আলোয় প্রণাম জানাই তাঁকে। আর কি কখনো হবে, এমন মানুষ হবে?

শুভ বিদায় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। ভালো থাকবেন সদা ঋজু উন্নত নাসা অমায়িক আচরণ আর পরিশীলিত ভাষায় বেঁচে থাকবেন আমাদের অন্তরে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ মে ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়