ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দ্রব্যমূল্যের প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৮, ১৮ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্রব্যমূল্যের প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী

কমলেশ রায় : শুরু হয়ে গেছে। খেলা শুরু হয়ে গেছে। ফুটবল বিশ্বকাপের আগেই আরেক খেলা শুরু। খেলোয়াড়রা যে যার মতো খেলে যাচ্ছে। দেদারছে ফাউল করছে। আরো করবে, নিশ্চিত।

রেফারিরা নিশ্চুপ। দেখেও দেখছেন না। হলুদকার্ড, লালকার্ড দেখানো তো পরের কথা। দর্শকরা দাঁত-মুখ চেপে চোখ আধাবোজা করে চেয়ে চেয়ে দেখছে। এছাড়া তাদের অবশ্য উপায়ও নেই। করারও তেমন কিছু নেই, বিরক্তি প্রকাশ করা ছাড়া। গ্যালারি থেকে শোরগোল করেও লাভ নেই। কে শোনে কার কথা? সেই একই চেনা খেলা। জানা একতরফা ফল। চলছে, চলবে জোরকদম। এ কী খেলা চলছে হরদম!

ভাবছেন খেলাটা কী? দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর খেলা। খেলা চলছে। মহাসমারোহে। সারা দেশে।

পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে বরাবরই অপতৎপরতায় মাতে লোভী একটা গোষ্ঠী। আগে থেকেই তারা মাঠে নেমে পড়ে। ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। যাতে সময়-সুযোগ মতো যত ইচ্ছে ‘গোল’ দেওয়া যায়। এসব স্বার্থন্বেষী পবিত্র মাসে তাদের অপবিত্র মনোভাব নির্লজ্জের মতো সামনে নিয়ে আসে। বিবেচনার মাথা খেয়ে বাজার গরম করে। তারপর গরম তাওয়ায় ঝটপট স্বার্থের রুটি ভেজে নেয়। তাদের তো পোয়া-বারো। পকেট ভারী। এদিকে নিত্যপণ্যের বাজার গরমের উত্তাপে ভোক্তাদের হাতে ফোস্কা। তারা ব্যথায় কাতরায়। মানুষ নামের কিছু অবিবেচকের জন্য তাদের করুণা হয়। বাধ্য হয়ে তারা বেশি দামে ভোগ্যপণ্য কেনে আর কায়োমনে বলে, ‘এদের জ্ঞান দাও প্রভু। এদের ক্ষমা করো।’

জ্ঞান এসব পাপীর ঠিকই আছে। তবে সুপথের নয়, বিপথের। সংযমের নয়, লোভের। ক্ষমার যোগ্য কাজ কী এরা করছে? মোটেই না। বরং চমকে দেওয়ার মতো খবর তৈরি করছে। আর যে খবরে যত অস্বাভাবিকতা, সেই খবরের তত চমক, তত কাটতি।

ব্রেকিং নিউজ : বেগুনের কেজি একশ টাকা।

আসলে দ্রব্যমূল্য এখন ‘ধরব’ মূল্য। অবস্থা দেখে তো তাই মনে হয়। তক্কে তক্কে থাকো। সুযোগ মতো ধরো। ধরে ফায়দা লুটো। আর ফায়দার টাকায় পকেট গরম করো। যাকে বলে একেবারে ঝোপ বুঝে কোপ। এই কোপে আমজনতা মানে সাধারণ ক্রেতা বা ভোক্তারা দিশেহারা। তাতে কী? তাতে কার কী? কারও কী তাতে আদৌ কিছু আসে যায়? আসলে ক্রেতার কষ্ট অনুভব করার কেউ নেই। এই রঙ্গভরা বঙ্গদেশে ক্রেতার যেন কোনো ত্রাতা নেই। কোনো ভ্রাতা নেই। কোনো বন্ধু নেই, কোনো সহমর্মী নেই।

তুমি ক্রেতা, সুতরাং তুমি ঠকবে। ঠকেই যাবে। কারণ ঠকাই তোমার ভবিতব্য। ক্রেতারা হলো কেনারাম। ক্রেতারা হলো ঠকারাম। কেনারাম কিনে যা। ঠকারাম ঠকে যা। আর ধরারাম যত ইচ্ছে ধরে যা। বেচারাম বুক ফুলিয়ে বেচে যা। ধরারাম আর বেচারামদের বেজায় দাপট। সেই দাপটে ইচ্ছেমতো তারা বদলে দেয় দৃশ্যপট।

‘ম্যাঙ্গো পিপল’ (আমজনতা) সব বুঝে। বুঝেও কিছু করতে পারে না। শুধু চেয়ে চেয়ে দ্যাখে। আর ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হয়। কখনও সখনও নিজস্ব পরিসরে বেফাঁস সত্যি কথাটা মুখ ফসকে বলে ফেলে। আরে বাবা, আর কত। সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে, নাকি?

স্কুল শিক্ষার্থীরা অনেক সময় সহপাঠীর সঙ্গে একটা মজা করে। বলো তো, যার হায়া নেই। বেহায়া। যার আদব নেই। বেয়াদব। যার শরম নেই। বেশরম। যার গুণ নেই? অনেক সময় উত্তর মেলে বেগুন। বেগুন আর রসিকতা করার পর্যায়ে নেই। ৪০-৫০ টাকার বেগুন দুই-তিনদিন ধরে ৭০-৮০ টাকা বিকোচ্ছিল। আজ সেঞ্চুরি মেরেছে। একটা বিষয়ে বেগুনকে বাহবা দিতেই হয়। সেটা হলো তার ধারাবাহিকতা। বছরে কমপক্ষে একবার সে সেঞ্চুরি মারবেই। এই কারণেই সবজিটি ব্যাটসম্যানদের কাছে অনুপ্রেরণার হয়ে ওঠতে পারে। আপনার প্রিয় সবজি কী? হয়ত বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান উত্তর দেওয়া শুরু করলেন : বেগুন।

বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমেছে। খুচরা বিক্রেতাদের জন্য মূল্যছাড় দিয়েছে বিপণনকারী কোম্পানিগুলো। পাঁচ লিটারের বোতলে ৪৩ থেকে ৫৭ টাকা পর্যন্ত। সাধারণ ক্রেতাদের লাভের খাতায় শূন্য। লবণের দরও পড়েছে। আগের তুলনায় লবণে কেজি প্রতি ১০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে খুচরা বিক্রেতারা। সুযোগ থাকার পরও কোম্পানিগুলো গায়ে দর কমাচ্ছে না। কমাবে কেন? তাহলে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে খাতির কমে যাবে তো। ক্রেতারা এমন কে, যে তাদের খাতির করতে হবে?

আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমেছে। অথচ আমাদের দেশে বেড়েছে কেজিতে প্রায় ৫ টাকা। পেঁয়াজের ঝাঁজও বেড়েছে। ৩০ টাকার দেশি পেঁয়াজ বেড়ে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। চিয়ার্স! হাফ সেঞ্চুরি। উদযাপনে ব্যাট তুলুন, হেলমেট খুলবেন না।

কাঁচাবাজারে হঠাৎ করেই যেন আগুন লেগেছে। গরুর মাংস ৫০০ টাকার নিচে মিলছে না। মাছ, মুরগি অনেকটা  লাফিয়েছে। জায়গা ও প্রকার ভেদে ইচ্ছে-স্বাধীন। ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। সবজিও তাতে শামিল। বেগুন তো সুপারস্টার। দেশি শসা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। মাঝারি লেবুর হালি ৪০ টাকা, দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। কাঁচামরিচের ঝাল এ বছর অতটা বাড়েনি। সেঞ্চুরি করেনি। তারপরও কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়। অথচ আড়তে কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে এর অর্ধেক দামে। খুচরা বাজারে অন্যান্য সবজিও ষাটের নিচে পাওয়া মুশকিল। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম, এ কারণেই দাম বেড়েছে, এই খোঁড়া যুক্তি এ বছর অন্তত খাটে না।

এবার সরবরাহ প্রচুর, তারপরও এ অবস্থা। আদা ও রসুনের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। সব মিলিয়ে সীমিত আয়ের মানুষ অনেকটা অসহায়।

তাহলে উপায় কী? নজরদারির ব্যবস্থা করা। করুন। দ্রব্যমূল্য মনিটরিং টিম, ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ যা যা দরকার মাঠে থুক্কু বাজার তদারকিতে নামিয়ে দিন। যৌক্তিক মূল্য তালিকা শুধু বাজারের এক কোনায় টাঙানোই থাকে কোনো কাজে আসে না। একেবারে ‘নামে আছে কাজে নেই’-এর মতো অবস্থা। সামগ্রিক পরিস্থিতি দেখে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে: সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তারা করছেনটা কী?

চক্র। চক্রকারে চক্র। গালভরা নাম ‘সিন্ডিকেট’। এরা শক্তিশালী, ক্ষমতারও বেশ দাপট। এরা অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর তাই কেন যেন শেষ পর্যন্ত সবাই থমকে যায়। হয়ত থমকে যেতে হয়। ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে?’ সিন্ডিকেটের শেকলে বাঁধা ভোক্তারা। এই জাল থেকে সহজে মুক্তি নেই। আদৌ কী মুক্তি নেই? ভোক্তা অসহায়। অতীতেও ছিল। বর্তমানেও আছে। হয়ত ভবিষ্যতেও তাই থাকবে।

শক্তহাতে ‘সিন্ডিকেট’ কী দমন করা যায় না? যায়, হয়ত যায়। নাগরিক হিসেবে আইন আর অধিকারের কথা মাথায় রেখে বললে অবশ্যই যায়। রাষ্ট্রের হাত তো ততধিক শক্ত। সে কারণেই আমরা আশাবাদী হতে চাই।

আমদানিকারক, উৎপাদক, পাইকারী ব্যবসায়ী, খুচরা ব্যবসায়ী সবাই নায্য ব্যবসা করুন, সহনীয় লাভ করুন, ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় রাখুন। ভোগ্যপণ্যের গলাকাটা দাম তুলে দিবালোকে পকেটকাটার ফন্দি আটবেন না। দোহাই আপনাদের, দোহাই। ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠল, লিখে আবদার করছো, ঠিক আছে। কিন্তু উনারা শুনলে তো?

তারপরও আমরা মানে ভোক্তারা বলব। বলতেই থাকব। ভুলে যাবেন না, ভোক্তারা মুখ ফিরিয়ে নিলে আপনাদের পণ্যের কী হাল হবে? ব্যবসার কী হাল হবে? মানুষ কিন্তু অভিযোজনশীল প্রাণী। চেষ্টা করলে ছাড়তে পারবে না, এমন কোনো পণ্য নেই। আর তাই ভোক্তারা ক্ষেপে গেলে মুশকিল। মুখ ফিরিয়ে নিলে আরো মুশকিল। ভেতরে ভেতরে স্বল্প পরিসরে হলেও সুক্ষ্ম এই বোধ হয়ত সচেতন অনেক ভোক্তাকে নাড়া দিচ্ছে। তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

দ্রব্যমূল্য যারা ইচ্ছে করে বাড়ান, তারা সতর্ক হোন। তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। দ্রব্যমূল্য বাড়ার পাশাপাশি মড়ার ওপর ঘাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। আর্থিক ক্ষতি হয়ত পুষিয়ে নেওয়া যায়, শারীরিক ক্ষতি সহজে পূরণ করা যায় না। যারা এ কাজ করছে, তারা একটু ভাবুক। ভেবে দেখুক, তাদের সাময়িক ফায়দার জন্য আশপাশের মানুষের কী ক্ষতিটাই না তারা করছে। আরেকজনকে মেরে কিংবা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে পকেট ভারি না করলেই কী নয়? তাদের মানবিকতা জাগবে কবে? কবে শুভবুদ্ধির উদয় হবে?

সমাজে সবারই শুভবুদ্ধির উদয় হওয়াটা খুব জরুরি। ভেতরে সততা ধারণ ও লালন করা খুব প্রয়োজন। এই চর্চাটা সবার ভেতরে শুরু হোক।

অনেক ভালো ভালো কথা বলা হলো। অনেক আশার কথা বলেছি। কিন্তু সব আশা যদি ভেঙে পড়ে? পড়লে পড়ুক। পরিস্থিতি তো নাজুকই। আমাদের সমাজে ‘ধরব’ মূল্যের প্রবণতা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। নিত্যপণ্য নিয়ে ধান্ধাবাজরা এর চেয়ে আর কত বেশি ধান্ধাবাজি করবে? তাই আমাদের আর ভেঙে পড়ার কিছু নেই।

যার কেউ নেই, তার পরম করুণাময় আছেন। আমরা যখন ভীষণ রকম অসহায় হয়ে পড়ি তখন তিনিই আমাদের আশ্রয়। অন্ধকারে আলোর দিশা। অগতির একমাত্র গতি।  আর কিছু না হোক, তার কাছে তো প্রার্থনা করতে পারি।

এই সংযমের মাসে, এই পবিত্র মাসে, হে প্রভু, হে সর্বশক্তিমান, হে মহান, তুমি সবাইকে সৎ করো দাও। সবাইকে বোধসম্পন্ন মানুষ করে দাও, পূর্ণাঙ্গ-পরিশুদ্ধ মানুষ করে দাও। ও গো দয়াময়, তোমার দরবারে এই অভাজনের মতো কোটি কোটি বাঙালি বান্দার সেটাই প্রার্থনা।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবক।

 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মে ২০১৮/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়