ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

ইমরান খান: নতুন হাওয়ায় লাগল কাঁপন

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৫, ২৯ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইমরান খান: নতুন হাওয়ায় লাগল কাঁপন

|| কমলেশ রায় ||

সিনেমার চিত্রনাট্যের মতো তার জীবন। জমজমাট একটা সিনেমা অনায়াসে তৈরি হতে পারে তার জীবনী নিয়ে। নায়িকাদের সঙ্গে তাকে নিয়ে মুখরোচক কেচ্ছা-কাহিনীও তো কম প্রচলিত নয়। বরাবরই তিনি ছিলেন রমণীমোহন ক্রিকেটার। সেই ক্রিকেট মহাতারকা থেকে রাজনীতিক। রাজনীতিক থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী। এই বন্ধুর পথ পেরুতে কত বাঁক, কত সংকট, কত ঝড়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। তবে দক্ষ হাতে সব সামলে নিয়েছেন এই ‘কাপ্তান’।

কে তিনি? এই প্রশ্ন এখন একেবারেই খেলো মনে হতে পারে। তিনি ইমরান খান, স্বভাবজাত এক নেতা। যখন যেখানে যে কাজটি তিনি করেছেন নতুন একটা হাওয়া বয়ে নিয়ে এসেছেন। পাকিস্তানের এবারের ভোটের হাওয়ায় তিনি নতুন এক কাঁপন লাগিয়ে দিয়েছেন।

পাকিস্তানে একাদশ সাধারণ নির্বাচন হয়েছে ২৫ জুলাই। এ লেখা শেষ করা পর্যন্ত বেসরকারি ফলাফলে ১২০ আসনে এগিয়ে ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) পেতে যাচ্ছে ৬১ আসন। পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পাচ্ছে ৪০ আসন।  ভোট হওয়া বাকিগুলোতে এগিয়ে অন্যান্য দল। জাতীয় পরিষদের মোট আসন ২৭২। সরকার গঠন করতে দরকার ১৩৭ আসন। প্রাপ্ত হিসাব বলছে, পাকিস্তানে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হতে যাচ্ছে। আর নতুন প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন ইমরান খান। জয়ের সুবাস পেয়ে তিনি দুর্নীতিমুক্ত নতুন পাকিস্তান গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। গত ২৬ জুলাই দেওয়া এক ভাষণে তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছেন, ‘রাজনীতিতে কিছু পাওয়ার জন্য আমি আসিনি। আমি আমার নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বপ্নের পাকিস্তান গড়তে চাই। মদিনায় যে ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আমি সেই ধরনের রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি। যে কল্যাণকর রাষ্ট্রে বিধবা ও দরিদ্রদের বিশেষভাবে যত্ন নেওয়া হতো।’

এদিকে কারচুপির অভিযোগ করে এরই মধ্যে ভোটের ফল প্রত্যাখান করেছেন পিএমএল-এন প্রধান শাহবাজ শরীফ এবং পিপিপি প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত মোট ভোটার ছিল ১০ কোটি ৬০ লাখ। ভোট পড়েছে ৫০ থেকে ৫৫ ভাগের মতো। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন, ভোট গণনার সময় তাদের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরাও নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ প্রত্যাখান করেছেন ইমরান খান। তিনি বলেছেন, ‘এটা পাকিস্তানের সুষ্ঠুতম নির্বাচন। এ বিষয়ে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা তদন্তের ব্যাপারে সাহায্য করব।’

খেলার মাঠ থেকে ক্ষমতায় পৌঁছাতে ইমরানকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ১৯৯২ সালে অনেক ‘যদি-কিন্তু’ পেরিয়ে তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতে পাকিস্তান। ১৯৯৬ সালে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হন, গঠন করেন পিটিআই। পরের বছর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে দুটি আসন থেকে লড়েন এবং হেরে যান। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন ২০০২ সালের নির্বাচনে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেননি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। তার প্রতি জনসমর্থন বাড়াতে থাকে ২০১১ সালের পর থেকে। আর ২০১৩ সালে নির্বাচনে জিতে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে পিটিআই। তবে এবারের নির্বাচনে তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থন পেয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

ইমরানের এ সাফল্যে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথ। ব্রিটিশ ধনাঢ্য এই নারী এক টুইটে বলেন, ‘অপমান, বাধা ও ত্যাগের ২২ বছর পর তার ছেলের বাবা পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।’ ক্রিকেটের আরেক তারকা ওয়াসিম আকরাম তো নির্বাচনের আগেই টুইট করে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে তার সাবেক অধিনায়ক ইমরানকে অগ্রিম শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ইমরানের জন্ম ১৯৫২ সালে, পাঞ্জাবের লাহোরে এক পশতুন পরিবারে। অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক, ১৯৭৫ সালে। জেমিমার সঙ্গে বিয়ে ১৯৯৫ সালে, বিচ্ছেদ ২০০৪ সালে। সুলেইমান ও কাশেম নামে তাদের দুই ছেলে আছে। ২০১৫ সালে বিবিসির সংবাদ উপস্থাপিকা রেহাম খানকে বিয়ে করেন ইমরান। যদিও সেই বিয়ে টিকেছিল মাত্র ১০ মাস। চলতি বছর ৬৫ বয়সি ইমরান তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেছেন বুশরা মানেকাকে।

পাকিস্তানের রাজনীতি ও নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ নতুন কোনো বিষয় নয়। দেশটির ৭০ বছরের ইতিহাসে প্রায় অর্ধেক সময় ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল সেনাবাহিনী। বাকিটা সময় নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ সম্প্রতি লন্ডনে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে অভিযোগ করেন। তিনি কোনো রাখ-ঢাক না রেখেই আইএসআইয়ের এক জেনারেলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলেন। এই জেনারেল নাকি নওয়াজের দলের প্রার্থীদেরকে দল ছাড়তে ক্রমাগত চাপ দিয়ে গেছেন। নওয়াজ শরীফের একটা কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তিনি বলেছেন, ‘‘অতীতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে মনে করা হতো ‘রাষ্ট্রে ভেতরে রাষ্ট্র’। আর এখন মনে হচ্ছে তারা ‘রাষ্ট্রের ওপরে রাষ্ট্র’।’’ ইসলামাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি শওকত আজিজ সিদ্দিকী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন, পাকিস্তানের বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপ করছে দেশটির সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।

এই সব অভিযোগের সত্যতা মেলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। নির্বাচন কমিশনকে তারা এবার বাধ্য করেছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বড় কিছু কাজ তাদের দিয়ে করাতে। কাজগুলোর একটু ফিরিস্তি দেওয়া যাক। ছাপাখানা থেকে ব্যালট পেপার নির্বাচন কমিশনে পৌঁছে দিয়েছে সেনাবাহিনী। ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পৌঁছানোর কাজ করেছে সেনাবাহিনী। শুধু তাই নয়, এই সেনাবাহিনীই আবার ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট পেপার নির্বাচন কমিশনের স্থানীয় কার্যালয়গুলোতে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছে। তাহলে বুঝুন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কিন্তু তাদের কর্মব্যস্ততা এ টুকুতেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। নির্বাচন-পূর্ব জালিয়াতিতে তারা অংশ নিয়েছেন বলে জোর গুজব রয়েছে।  পিএমএলের (এন ) অনেক প্রার্থীকে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধ্য করেছে। যাদের বেশিরভাগেরই নির্বাচনী প্রতীক ছিল জিপ। এখন সেনা সমর্থক কোয়ালিশন সরকার গঠনের এদেরকে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করা হবে। কেবল নওয়াজ শরীফ নন, পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতারাও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের বিস্তর অভিযোগ তুলেছেন। মোটা দাগে বলতে গেলে, একমাত্র ইমরান খান ছাড়া বাকি সবারই অভিযোগ রয়েছে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।

এত কিছুর পরও নতুন কিছু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে এই নির্বাচন। পাকিস্তানের ইতিহাসে নওয়াজের দল পিএমএল-এন প্রথমবারের মতো সরকারের পূর্ণ মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। এবার নতুন ‘বৈধ’ সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে পারলেই সৃষ্টি হবে নতুন ইতিহাস। এই নির্বাচনের আরেকটি ‘ইতিহাস’ গড়া দিক হলো নারী ভোটার ও প্রার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ। এবার মোট নারী প্রার্থী ছিলেন ৩০৫ জন। এর মধ্যে জাতীয় পরিষদে ১৭১ জন। এত দিন কিছু অতিরক্ষণশীল এলাকায় নারীদের বাড়ি থেকে বের হয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার অনুমতি ছিল না। এসব এলাকার নারীরা ৭০ বছর পর এবার ভোট দিয়েছেন। পাকিস্তানের নতুন আইনে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সংরক্ষিত আসনের বাইরে নিয়মিত আসনগুলোতে কমপক্ষে ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটা হয়ত তারই সুফল। এছাড়াও পাকিস্তানের ইতিহাসে এবারই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে এসব পর্যবেক্ষককে বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানের নতুন সরকারকে অনেক সংকট মোকাবেলা করতে হবে। বার্তা সংস্থা এএফপি পাকিস্তানের নতুন সরকারের সামনে প্রথম পাঁচটি চ্যালেঞ্জ কী হবে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্ব আর সম্পর্কের ভারসাম্য সৃষ্টি করাই হবে প্রথম চ্যালেঞ্জ। সেনাশক্তির হস্তক্ষেপকে সামাল দেওয়ার বিষয়টি এতে বিশেষভাবে উঠে এসেছে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উগ্রবাদ ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। এবারের নির্বাচনী প্রচারণার সময় কয়েকটি হামলায় তিনপ্রার্থীসহ দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। ভোটের দিন কোয়েটায় ভোটকেন্দ্রের কাছে বোমা হামলায় প্রাণ গেছে কমপক্ষে ৩১ জনের। আর হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা। চতুর্থ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা। পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজে যা কার্যকর করা বেশ কঠিন। আর তীব্র পানি সংকট মোকাবেলা হচ্ছে পঞ্চম চ্যালেঞ্জ। ভোটের আগে কিছু এলাকার ভোটাররা  ঘোষণা দিয়েছেন, যে প্রার্থী পানির নিশ্চয়তা দেবে, তাকেই তারা ভোট দেবেন।

পাকিস্তানে এবার ইমরান খানের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠন হতে যাচ্ছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত, লাটাইটা শেষ পর্যন্ত সেনাশক্তির হাতেই থাকবে। সেক্ষেত্রে ইমরান কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন, সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। তার এবারের নির্বাচনী শ্লোগান ছিল, ‘নয়া পাকিস্তান’। তবে ইশতেহারে ‘পুরানো’ পাকিস্তানকে হটানোর মতো ‘নতুন’ বিশেষ কিছু নেই। শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ইমরান খান যদি ‘বেয়ারা’ হয়ে কোনো কারণে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তাহলে কী হতে পারে তার নজির তো সবার সামনে আছেই। নওয়াজ শরীফকে কী মাশুলটাই না দিতে হয়েছে! দ্বন্দ্ব প্রকট হওয়ায় দুর্নীতি মামলা। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়া, প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানো। এবং রাজনীতি থেকে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ। এই প্রবল শক্তিশালী সেনাশক্তিকে সামাল দিয়ে রাজনীতির মাঠে ইমরান খান কতটা ‘অলরাউন্ডার’ নৈপূণ্য দেখাতে পারেন, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়