ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রদীপগুলো আলাদা, কিন্তু আলো একই

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১২, ৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ১৬:৪১, ২৩ নভেম্বর ২০২৩
প্রদীপগুলো আলাদা, কিন্তু আলো একই

‘পিতা গড়ে শুধু শরীর, মোরা গড়ি তার মন,/পিতা বড় কিবা শিক্ষক বড়- বলিবে সে কোন জন?’ কবি গোলাম মোস্তফা তুলনামূলক এই প্রশ্নটির বিচার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি সন্তানের শিক্ষা প্রসঙ্গে মায়েদের ভূমিকার কথা এখানে বলেননি। এই তুলনা বিচারে সম্রাট নেপোলিয়নের ভাষ্য স্মরণ করা যেতে পারে। এই বীর-সম্রাট বলেছেন, ‘মায়ের শিক্ষাই শিশুর ভবিষ্যতের বুনিয়াদ।’ অর্থাৎ পিতা শরীর, শিক্ষক মন গড়ে দিলেও শিশুশিক্ষার হাতেখড়ি যার মাধ্যমে তিনি মা। সব কালে, সব দেশে মায়েরা সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে হাসিমুখে এই দায়িত্বটুকু স্বীকার করেছেন। সুতরাং আজ শিক্ষক দিবসে বাল্য, কৈশোর, যৌবনে সকল শিক্ষাগুরুর প্রতি প্রণতি জানাতে গিয়ে জীবনের প্রথম শিক্ষককে অস্বীকার করি কী করে!

হ্যাঁ, একথা ঠিক সেকালে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর প্রবেশদ্বারে অপেক্ষমান মায়েদের ভিড় চোখে পড়ত না। এ কথাও হয়তো বলা ভুল হবে না, এখনকার মায়েদের মতো তারা শিশু বয়সেই সন্তানের শিক্ষা নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন হতেন না। তাই বলে সচেতন মা সন্তানের বাল্যশিক্ষার বিষয়টি এড়িয়ে যেতেন না। ঘর গৃহস্থালির কাজের ফাঁকে তিনি এই সময়টুকু বের করে নিতেন। মাটির চুলার কাঠ-কয়লা দিয়েও আমি এক মাকে অ আ লেখা শেখাতে দেখেছি। পা ছড়িয়ে বসে কাঁথা সেলাই করতে করতে, আনাজ কুটতে কুটতে মা ছেলেকে পড়াচ্ছেন- গ্রামে, মফস্বলে এ দৃশ্য বিরল নয়। আর এখন তো মায়ের হাত ধরেই শিশু স্কুলে যায়। বাক্যটি লিখতে গিয়ে মনের ঘরে একটি দৃশ্য উঁকি দিয়ে গেল:

নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট, গুজে রাখা হাফ শার্ট; সাদা, বুকে গোল ব্যাচ, পিঠে স্কুল ব্যাগ, গলায় মালার মতো ঝুলছে ওয়াটার পট। মা স্কুল গেটে রিকশা থেকে নেমেই শিশুটিকে দাড়োয়ানের হাতে তুলে দিলেন। খাকি উর্দি পরা দারোয়ান। এই পোশাকেই শিশুটির খুব ভয়! তার মন কিছুতেই টানছে না, অথচ ছোট্ট হাতটি যেন শক্ত কড়ায় আটকে গেছে। ছুটে ফিরে আসার সাধ্য নেই। সে যাচ্ছে আর বারবার ফিরে তাকাচ্ছে। মা হাত নেড়ে অভয় দিচ্ছেন। গেট পেরিয়ে যেতেই শিশুটি মুখোমুখি হলো অজানা এক জগতের। সিসিম দুয়ার যেন খুলে গেল। হঠাৎ পাল্টে গেল তার এতদিনের চেনা-জানা চারপাশ। চোখের সামনে বিশাল মাঠ। রোদ ঝলসে দিচ্ছে ঘাসের শরীর। ছোট-বড়, সমবয়সীর দল মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই গরমেও এত উচ্ছ্বাস! এই ভিড়ে, এই কোলাহলে আজ সে নবাগত।

আচ্ছা, সবাই কি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে? চোখ তুলে তাকানোর সাহসও সে হারিয়ে ফেলেছে। আড় চোখে তার কেবলই রাজ্যের শঙ্কা। হঠাৎ বুক কাঁপিয়ে ঢং ঢং ঘণ্টা বেজে উঠল। একি! মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে গেল মাঠ। যে যার মতো দৌড়ে গেল ক্লাসের দিকে। মাঠজুড়ে ঝুপ করে নেমে এলো কবরের নীরবতা। তার কণ্ঠ চিড়ে বেরিয়ে আসা ‘মা’ ডাক শূন্য মাঠে প্রতিধ্বনি তুলল। হ্যাচকা টানে হাত ছাড়িয়ে নিয়েই সে দৌড় দিল গেটের দিকে। ওপারে মা দাঁড়িয়ে আছেন।

শিশুটি দৌড়াচ্ছে প্রাণপণে। কিন্তু তাকে থেমে যেতে হলো সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অচেনা একজন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি; একটু কি মলিন ছিল? চোখে চারকোণা কালো চশমা। ঠোঁটে নির্ভয়ের মৃদু হাসি। আশ্চর্য এই হাসি আজও মনে আছে! তিনি নেমে এলেন দেবদূতের মতো। চারপাশে কি তিনি মায়া ছড়িয়ে দিলেন? হয়তো তাই। তিনি শিশুটির দিকে মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে বললেন, সাইকেলে চড়বে? উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। শিশুটিকে সাইকেলে চড়িয়ে ‘চলো মায়ের কাছে যাই’ বলে প্যাডেলে পা রাখলেন। চাকা ঘুরতে শুরু করল। ক্রমশ বাড়তে লাগল গতি। কানের পাস দিয়ে সাঁইসাঁই বাতাস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। ক্রিং ক্রিং শব্দ হচ্ছে। একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার বারবার।

বাহ! বেশ লাগছে। স্কুলের ভয় ক্রমশ চাপা পড়ে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের বুকের ওপর কালো চাকার দুরন্ত গতির কাছে। ক্রিং ক্রিং শব্দের কাছে। কানের পাশ ঘেঁষে যাওয়া সোঁ সোঁ বাতাসের কাছে। সাইকেলে চড়ার আনন্দের কাছে। কতক্ষণ এভাবে কাটল মনে নেই। মাঠে কয়েকবার চক্কর খেল সে চড়কির মতো। তারপর হঠাৎ সে নিজেকে আবিষ্কার করল গেটের পাশে, ঠিক মায়ের সামনে। লোকটি এবার নামিয়ে দিলেন। গাল টিপে বললেন, গুড বয়। কাল আবার সাইকেলে চড়াব। যাও। আজ তোমার ছুটি।

আহা! স্কুল এত আনন্দের। আনন্দেরই তো। ওই যে দেবদূতের মত শিক্ষকেরা আছেন। তারাই তো মনের ভুবন নানা রঙে রাঙিয়ে দেন। মনের বন্ধ চোখ তাদের সংস্পর্শে এলেই একে একে খুলতে শুরু করে। কত অজানাকে জানা, কত অচেনাকে চেনা, কত অদেখাকে দেখা হয়ে যায় তখন।

শিশুটি আজ হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে চাকুরে। শিক্ষাজীবনে অনেক শিক্ষকের সহচার্যে আসতে হয়েছে। তারা ভিন্ন প্রদীপ, কিন্তু হৃদয়ে জ্বালিয়েছেন অভিন্ন আলো। ফার্সি কবি, দার্শনিক, ধর্মবেত্তা রুমী যেমন বলেছেন: ‘প্রদীপগুলো আলাদা, কিন্তু আলো একই।’ কত স্মৃতি, কত ফাঁকি, কত তিরস্কার, কত অভিমানে ঠাঁসা সেই জীবন। ঢুলু স্যারের ঢুলে ঢুলে সুর তুলে রোলকল, তাই নিয়ে দুষ্টু ছেলেদের ছড়াকাটা। আকবর স্যারের হাই পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে রাগি চোখে তাকানো। পণ্ডিত স্যারের লিকলিকে বেত। আচ্ছা, হাইস্কুলগুলোতে এখনও কি পণ্ডিত স্যার আছেন? সেখানে এখনও আলাদা করে যত্ন নিয়ে হিন্দু ধর্ম পড়ানো হয়? খুব জানতে ইচ্ছে করে। এই তো গত বছর ফেইসবুকে জানলাম, ‘কেটু স্যার’ চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়াতেন। অভিনব সব উদাহরণ দিতেন। আর্টস ডিপার্টমেন্টের ছাত্রদেরও দেখেছি তার ক্লাসে এসে পেছনের বেঞ্চে বসে থাকত। যে পাতা ফ্যারফ্যার শব্দ করে আঁকাবাঁকা হয়ে ছেঁড়ে সেই পাতার শিরাবিন্যাস জালিকাকার। আর যে পাতা ছিঁড়লে সাঁই করে শব্দ হয়; সোজা ছিঁড়ে যায় সেই পাতার শিরাবিন্যাস সমান্তরাল- স্যার ক্লাসে বুঝিয়ে দিতেন। সেদিন কি বুঝেছিলাম তিনিই আমাদের এরিস্টটল? স্যার কিন্তু আমাদের আলেকজান্ডার মনে করে গর্ব করতেন।

কে না জানে সত্য প্রচারের অপরাধে জ্ঞানসাধক সক্রেটিসকে হেমলকের বিষ পানে আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। সক্রেটিস কখনও জুতা পরতেন না। খালি পায়ে এথেন্সের পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। সামনে যাকে পেতেন শোনাতেন জ্ঞানের কথা। তারই সুযোগ্য শিষ্য প্লেটো। ধনীর দুলাল বিপথগামী প্লেটোকে জ্ঞানের পথে ফিরিয়ে এনেছিলেন সক্রেটিস। আজও সক্রেটিসরা তাই করছেন। গাধা পিটিয়ে মানুষ করে দিচ্ছেন অযুতে-নিযুতে। ছাত্রদের দেখাচ্ছেন জ্ঞানের পথ। শুধু প্লেটোদের সংখ্যা কমছে। তাতে কী! ধন্য শিক্ষাগুরু সক্রেটিস। কারণ তাকে দর্শনের আদি জনক বলা হলেও প্লেটোর হাত ধরেই এর সার্বিক ও পূর্ণাঙ্গ বিকাশ হয়েছিল। প্লেটোর আরেক যোগ্য শিষ্য হলেন এরিস্টটল। মজার বিষয়, প্লেটো যখন এরিস্টটলকে যোগ্য শিষ্য রূপে গড়ে তুলেছেন, চারদিকে তার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তখন মেসেডনের সম্রাট ফিলিপস তাকে ডেকে পাঠালেন। দায়িত্ব দিলেন রাজকুমারকে লেখাপড়া শেখানোর। রাজকুমার আর কেউ নন, মহাবীর আলেকজান্ডার। গৃহশিক্ষক থেকে তাদের সম্পর্ক পরবর্তী সময়ে বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যতদূর জানা যায়, শিক্ষকের অনুগত ছাত্র ছিলেন তিনি। একথা স্বীকার করে আলেকজান্ডার বলেছেন: ‘আমার জীবনের জন্য হয়তো আমি আমার জন্মদাতার কাছে ঋণী। কিন্তু আমাকে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সত্যিকারের মানুষ করে গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু এরিস্টটল।’

শিক্ষাগুরুর ঋণ কখনও শোধ হবার নয়- কথাটি প্রায়ই বলতেন আমাদের জ্যোতিষ স্যার। অথচ অকৃতজ্ঞ মন হারিয়ে ফেলেছে শৈশবের প্রিয় শিক্ষকের মুখ। পুরনো সাইকেল, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো ফ্রেমের চশমা এখনও তাকে আচ্ছন্ন করে। সে অনুভব করে, মনের ঘরে বাজছে ক্রমাগত ক্রিং ক্রিং ক্রিং ক্রিং। এই শব্দ সে কখনও ভুলতে পারবে না। অথচ আজ আর সে কিছুতেই স্যারের মুখটি মনে করতে পারে না। স্মৃতি কুয়াশাচ্ছন্ন। দক্ষ ডুবুরির মতো নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে স্মৃতির অতলে ডুব দেয়। মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে সেই মুখ। একবার, মাত্র একবার কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যর্থ হয়।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়